ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা মিলেছে। শুধু তাই নয়, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে আসছে ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত আরও বেশ কয়েকজন অভিযুক্তের নামও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষার্থী বলছেন, ভুক্তভোগী তার সাক্ষাৎকারে যা বলেছে এবং অভিযোগপত্রে যা লেখা আছে, তা সত্য। কিন্তু ভয়ে এত দিন তারা কেউ মুখ খুলতে সাহস করেননি । এ সময় তারা ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার প্রধান সহযোগী তাবাসসুম ছাড়াও নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত আরও কয়েকজনের নামও প্রকাশ করেন।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রশাসন বরাবর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের লিখিত অভিযোগ করেন শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুন। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ১২ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন ফুলপরী। এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড়, বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, গলায় গামছা পেঁচিয়ে ঝোলানো, ময়লা গ্লাস চেটে পরিষ্কার করানোসহ নানাভাবে নির্যাতন করা হয় তাকে। ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদার নেতৃত্বে তাবাসসুমসহ ৭ থেকে ৮ জন এই নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। নির্যাতনের সময় ফুলপরীকে হুমকি দিয়ে সানজিদা বলেন, ‘তুই যদি প্রশাসনের কাছে কোনো অভিযোগ দিস, তাহলে তোকে মেরে কুত্তা দিয়ে খাওয়াব; যা বলেছি তা মনে থাকে যেন।’
ঘটনার মূল অভিযুক্ত সানজিদা ও তাবাসসুমকে শনাক্ত করতে পারলেও বাকি অভিযুক্তদের চিনতে না পারায় তাদের ব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি ভুক্তভোগী। আর ঘটনার ছয় দিন পেরিয়ে গেলেও বাকি অভিযুক্তদের শনাক্ত করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও হল প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি।
তবে নাম গোপন রাখার শর্তে কয়েকজন শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেছেন, ১২ ফেব্রুয়ারি গণরুমে যেসব নির্যাতনের বর্ণনা ভুক্তভোগী দিয়েছেন, সেসব সত্য। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সানজিদা ও তাবাসুসম ছাড়াও সেখানে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান মীম, চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী হালিমা খাতুন ঊর্মি ও ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী মাওয়াবিয়া নির্যাতনের ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন। তারা ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী এক শিক্ষার্থী জানান, ঘটনার রাতে সানজিদার নেতৃত্বে দুইজন এসে ভুক্তভোগীকে গণরুমে নিয়ে যান। তবে বাকি দুইজনকে চিনতে পারেননি প্রত্যক্ষদর্শী।
এদিকে, তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. রেবা মণ্ডল বলেন, আমাদের তদন্ত কার্যক্রম চলমান। তদন্তের স্বার্থে এখন কিছু বিষয় বলা যাচ্ছে না। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা কাজ শেষ করতে পারব।
প্রসঙ্গত, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ সহসভাপতি সানজিদা ও তার সহযোগী তাবাসসুমের বিরুদ্ধে প্রশাসন বরাবর ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের লিখিত অভিযোগ করেন নবীন শিক্ষার্থী ফুলপরী। এ ঘটনায় ১৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও হল প্রশাসন পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। আর এ ঘটনায় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন সামনে রেখে ওই দিন বিকেল ৪টায় হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবী গাজী মো. মহসীন। ১৬ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসককে তিন দিনের মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটিকে ১০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ সময় অভিযুক্ত সানজিদা ও তাবাসসুমকে ক্যাম্পাসের বাইরে রাখতে বলা হয়। পরে ১৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর হল ছেড়ে চলে যান অভিযুক্তরা। সর্বশেষ ১৮ ফেব্রুয়ারি তদন্তের স্বার্থে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘ঘটনার বিষয়ে কারও নিকট কোনো তথ্য-প্রমাণাদি থাকলে তা লিখিত আকারে বা সশরীরে প্রশাসন কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. রেবা মণ্ডল ও সংশ্লিষ্ট তদন্ত কমিটির অফিসে ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টার মধ্যে জমা দেওয়ার অনুরোধ করা হলো।’ আর একই দিন তদন্ত কমিটির ডাকে বাড়ি থেকে ক্যাম্পাসে আসেন ভুক্তভোগী ফুলপরী।