২০২৪ সালের জুন মাসের শেষভাগেও ফেসবুক ছিল ‘উচ্চবংশীয়’ এক ছাগলের দখলে। এনবিআরের এক কর্তার ছেলে নাকি ১৫ লাখ টাকায় ছাগল কিনেছেন, এই নিয়ে তোলপাড়। তারপর বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁসের খবর এল। অর্ধকোটি টাকার ড্রাইভার, শতকোটি টাকার পিয়ন, একের পর এক ইস্যু এসে হাজির হচ্ছিল। সরকারদলীয়রা বোধ হয় ভেবেছিলেন, কোটা সংস্কারের ‘ছোটখাটো’ আন্দোলনটিও নানা ইস্যুর আড়ালে চাপা পড়ে যাবে। চাপা তো পড়েইনি, বরং ধীরে ধীরে চাপ বেড়েছে। শুরুতে ছোটখাটো ট্রল, শ্লেষ মেশানো ফেসবুক পোস্ট, হাস্যরসাত্মক মিম। একসময় এসবই গিয়ে ঠেকেছে #StepDownHasina-তে। ‘দফা এক দাবি এক,/ শেখ হাসিনার পদত্যাগ’। আগস্ট আসতে আসতে ছাত্র–জনতা এ ধরনের পোস্টের সঙ্গে জুড়ে দিতে শুরু করেছেন—‘লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার’; অর্থাৎ মিম, ট্রল, কৌতুকের ছলে ইনিয়ে–বিনিয়ে বলা আর নয়। কথা স্পষ্ট—স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পদত্যাগ চাই।
এর মাত্র দুই সপ্তাহ আগেও ‘স্বৈরাচার’ বলা তো দূরের কথা, অধিকাংশ নেটিজেন ‘শেখ হাসিনা’ নাম উল্লেখ করে যৌক্তিক সমালোচনা করতেও ভয় পেতেন। পুলিশি হয়রানি, হামলা, মামলায় গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার সরকার অত্যন্ত জোরালোভাবে এই ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছিল। কীভাবে ভয়ডরের বাঁধ ভেঙে গেল?
ছাত্র–জনতাকে স্যালুট জানানো রিকশাচালকের এই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। পরে ‘ই–আরকি’ ছবিটি ব্যবহার করে
১৪ ও ১৫ জুলাই: তুমি কে, আমি কে
১৪ জুলাই। সংবাদ সম্মেলনে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রসঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?’
রাতেই প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। হাজারো তরুণ স্লোগান দিলেন, ‘তুমি কে আমি কে,/ রাজাকার রাজাকার’। ভিডিও দেখে পরদিন সকালে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল ফেসবুক। একদল বলে, ‘এ ধরনের স্লোগান দেওয়া ঠিক হলো না।’ অন্যরা বললেন, ‘ওদের স্লোগানে শ্লেষ মেশানো। ক্ষোভটা ধরতে পারছেন না!’
আন্দোলনের আঁচ ক্যাম্পাসের গণ্ডি পেরিয়ে জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছে গেল সেদিনই। বিশেষ করে তখন, যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ, যুবলীগের নৃশংস হামলার ছবি–ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। তখনো অনেকে নাম উল্লেখ না করে আড়েঠাড়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
ষুশ্মিট আষিফ নামের এক প্রকৌশলী যেমন ১৫ জুলাই ফেসবুকে লেখেন, ‘আপনার বান্ধবী আপনাকে আচার খেতে দিলে সেটাকে কী বলবেন? সই–র আচার।’
ক্যারিবীয় রেগে গায়ক বব মার্লের গান ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলনের কার্ড হয়ে
১৬ ও ১৭ জুলাই: সে আগুন ছড়িয়ে গেল
১৬ জুলাই সকালে তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলকের ফেসবুক পোস্ট মারফত জানা গেল, অনলাইন শিক্ষার প্ল্যাটফর্ম টেন মিনিটস স্কুলের ৫ কোটি টাকার বিনিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। কেন? পলক নিশ্চুপ। তবে কিনা আগের রাতেই টেন মিনিটস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক পোস্ট দিয়েছিলেন, ‘রক্তাক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমার ক্যাম্পাসে রক্ত কেন? প্রতিবাদ জানাই।’ এ ঘটনায় মজা করে কেউ কেউ ফেসবুকে লেখেন, ‘সম্পর্ক বদলে গেল একটি পলকে।’
বিকেলে সারা দেশের মানুষকে স্তব্ধ করে দেয় এক তরুণ, যাঁর নাম আবু সাঈদ। বন্দুকের সামনে বুক পেতে জীবন দেওয়া এক বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রের ছবি হয়ে ওঠে আন্দোলনের প্রতীক। অনেকেই প্রোফাইল পিকচারে দিতে শুরু করেন আবু সাঈদের ছবি।
১৬ জুলাই রাতে বিভিন্ন ক্যাম্পাসের হল থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করার ছবি–ভিডিও আসতে থাকে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে অনেক ছাত্রলীগ নেতা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দল থেকে পদত্যাগ করতে শুরু করেন।
আন্দোলন যে আর শুধু ‘কোটা সংস্কার’–এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সেটা তখন স্পষ্ট। ১৭ জুলাই নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী যেমন ফেসবুকে লেখেন, ‘আপনারা যাঁরা ভাবছেন আন্দোলনটা স্রেফ একটা চাকরির জন্য, তাঁরা বোকার স্বর্গে আছেন। আপনারা এর সবগুলো স্লোগান খেয়াল করেন।…এই আন্দোলন রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা আছেন, তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে দেশের মালিক তাঁরা নন। আসল মালিক জনগণ।’
কালো শাড়ি পরে শেখ হাসিনার সেদিনের বক্তৃতা তরুণদের উত্তেজিত করে দেয় আরও। কেউ কেউ লেখেন, ‘নুসরাত ফারিয়া তো দেখছি নুসরাত ফারিয়ার চেয়ে ভালো অভিনয় করেন।’ (মুজিব সিনেমায় শেখ হাসিনার চরিত্রাভিনেত্রী)
ভয় ছাপিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে, টের পাওয়া যায়। কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ ১৭ জুলাই লিখলেন, ‘লেখা আছে হাতের রেখায়,/ জাহাজ ডুববে অহমিকায়’।
‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির আগে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল এই ডিজিটাল পোস্টার
১৮ থেকে ২৫ জুলাই: পানি লাগবে?
শুরুটা ঢাকার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর একে একে ধানমন্ডি, উত্তরা, মিরপুর। চট্টগ্রাম, সিলেটসহ সারা দেশ থেকে ফেসবুকে জমা পড়ে ছাত্র–জনতার ওপর হামলা; পুলিশ ও ছাত্রলীগ–যুবলীগের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, বিভিন্ন ভবনে আগুন দেওয়ার ভীতিকর সব ছবি–ভিডিও। ক্যাম্পাসে–হাসপাতালে আহত আন্দোলনকারীরা কাতরাচ্ছেন, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে গুলিবিদ্ধ এক বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র বলছেন, ‘আমি ঠিক আছি মা, একটু অ্যাজমার সমস্যা…’; পুলিশের সাঁজোয়া যান থেকে ধাক্কা দিয়ে এক তরুণের নিথর দেহ ফেলে দেওয়া হচ্ছে, বন্ধুর মৃতদেহ পতাকা দিয়ে ঢেকে বহন করে নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এমন অজস্র ভিডিও দেখে রাগে-ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে জনতা।
১৮ আগস্ট ফেসবুক ঘাঁটতে গিয়ে দেখা গেল, নির্মম ভিডিওগুলোর বেশির ভাগই ফেসবুকের নীতিমালার বেড়াজালে পড়ে মুছে গেছে। কিন্তু একটি ভিডিও মুছে যায়নি। চারদিকে ছোটাছুটি, কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া। এত সব হট্টগোলের মধ্যে এক তরুণ জনে জনে গিয়ে বলছেন, ‘পানি লাগবে, পানি?’ নাম মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। আন্দোলনকারীদের মধ্যে পানি বিতরণ করার এই ভিডিও ধারণের কিছুক্ষণ পরই তাঁর মৃত্যু হয়। মুগ্ধর এই এক ভিডিও প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে দেয় দাবানলের মতো।
তরুণ অ্যাকটিভিস্ট সাইয়েদ আবদুল্লাহ ১৮ জুলাই লেখেন, ‘নাম–ঠিকানাসহ শাহাদাতবরণকারী ছাত্রদের নোট লিখছিলাম
একে একে।… একে একে বড় হচ্ছে তালিকা।…আমার হাত কাঁপছে...আমি আর লিখতে পারছি না...’
সেদিন রাতেই সরকারের নির্দেশে সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হলো। ২৪ জুলাই রাতে সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু করা হয় ঠিকই, তবে তত দিনে ঝরে গেছে আরও অনেক প্রাণ।
মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ সড়কেছবি: প্রথম আলো
২৬ থেকে ৩১ জুলাই: রক্তের রং লাল
জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে দলে দলে শিক্ষকেরাও যুক্ত হতে থাকেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে। শিক্ষকেরা কাঁদছেন, পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি করে ছাত্রছাত্রীদের ছাড়িয়ে আনছেন, মিছিলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন—এসব ভিডিও ও ছবি সবার মনোবল বাড়িয়ে দেয় আরও।
আরও বহু ছবি–ভিডিও সে সময় প্রভাব ফেলেছে। এক আন্দোলনকারীকে পুলিশ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে চাইছে, আর তিনি জানালার গ্রিল আঁকড়ে ধরে বলছেন, ‘আমার একটা ছোট বোন আছে, স্যার।’ এক ছাত্রী পুলিশ ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘আমার ওপর দিয়ে চালান।’ ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোরদের হাতকড়া পরিয়ে হাজতে নেওয়া হচ্ছে। এমন দৃশ্য অনেকেরই চোখ ভিজিয়েছে। মারা যাওয়া কিশোর–তরুণদের ছবি আর ফেসবুক পোস্টগুলো তখন ঘুরেফিরে বারবার আসছিল ফেসবুক ফিডে।
জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ থেকে ধার করে ছাত্র–জনতার অনেকেই তখন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হব।’
কিন্তু তাঁরা যে দ্বিগুণ নয়, অগণিত হয়ে উঠছেন, সেটা বোঝা যায় ৩০ জুলাই। মৃতদের জন্য কালো রং দিয়ে শোক পালন করতে বলেছিলো সরকার। অথচ ছাত্র–জনতার আহ্বানে প্রোফাইল পিকচারে লাল রং জুড়ে দিতে শুরু করেন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। এক দিনেই ‘নীল’ ফেসবুক ‘লাল’ হয়ে ওঠে প্রতিবাদে।
স্লোগানে, দেয়াললিখনে তখন ‘খুনি হাসিনা/ গদি ছাড়’ কথা উঠে আসতে শুরু করেছে মাত্র। তবে ‘সহজ টার্গেট’ হয়ে যাওয়ার ভয়ে ফেসবুকে সরাসরি লিখতে সাহস পাচ্ছিলেন না অনেকে।
৩১ জুলাই রাতে ভাইরাল হয় ইউল্যাবের অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের একটি বক্তব্যের ভিডিও। সেখানে তিনি বলেন, ‘তারা হত্যাকাণ্ডের বিচার করবে না। কারণ, তারা নিজেরাই হত্যাকারী...বর্তমান সরকারকে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে পদত্যাগ করতে হবে।’
১ থেকে ৫ আগস্ট: এক দফায় একাত্ম
আগস্টের শুরুতে এসে আর কোনো লুকোছাপা থাকে না। অজস্র মানুষের প্রোফাইল পিকচারে দেখা যায়, লাল রঙের পটভূমিতে লাল রঙে লেখা: ১। দফা আর দাবি তখন একটাই।
তৌসিফ তানজিম আহমেদ নামের এক তরুণ লিখলেন, ‘যুগের সাথে সাথে নতুন শব্দ তৈরি হয়। এ বছরের অনন্য উদ্ভাবন—ফ্যাসিনা।’
ততক্ষণে ফেসবুকে মানুষও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। মামলা, হামলার তোয়াক্কা না করে স্পষ্ট ভাষায় লিখতে শুরু করেন, ‘খুনি হাসিনার পদত্যাগ চাই।’
ছাত্র–জনতা যেন নিশ্চিত হয়ে গেছেন, শেখ হাসিনার পতন অনিবার্য। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ছাত্র ফাহিম কবির ২ আগস্ট লেখেন, ‘আমাদের আরেকটু দূর যাওয়া বাকি। ক্লান্ত হয়ে গেলে বারবার মনে করবেন, আমাদের প্রচুর “পানি লাগবে, পানি”।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ৪ মার্চ ঢাকামুখী লংমার্চের ডাক আসে। ‘ছাড়তে হবে ক্ষমতা, ঢাকায় আসো জনতা’ লেখা একটি পোস্টার চোখে পড়ে ফেসবুক ফিডজুড়ে।
‘সবাই মোবাইলের ডিসপ্লেতে নিজের নাম, রক্তের গ্রুপ, ঠিকানা, ইর্মাজেন্সি কন্টাক্ট নম্বর দিয়ে রাখবেন,’ এমন পোস্টের গণ–শেয়ার দেখে বোঝা যাচ্ছিল, মৃত্যুভয় ভুলে পরদিন পথে নামবেন অনেকেই।
৫ আগস্ট। সকাল থেকে থমথমে পরিস্থিতি। বেলা ১১টার দিকে ইন্টারনেট আবারও বন্ধ। দুপুরে ইন্টারনেট আসার পর একটি ভিডিওই ঘুরেফিরে আসতে থাকে বারবার, হেলিকপ্টার থেকে নেমে গাড়িতে উঠছেন শেখ হাসিনা। সঙ্গে লাগেজ।