সরকারি একটি সংস্থার পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবেরা। তাঁরা পর্ষদে সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারি টাকায় অধিগ্রহণ করা জমিতে ফ্ল্যাট নির্মাণ করছেন। ব্যয় করা হচ্ছে প্রকল্পের টাকা। সেই ফ্ল্যাট আবার নিজেদের নামে খুবই কম দামে বরাদ্দ নিয়েছেন সচিবেরা।
ঘটনাটি ঘটেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষে (বাসেক)। বিভিন্ন সময় সেতু কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পর্ষদে থাকা সচিবেরা যেমন ফ্ল্যাট নিয়েছেন, তেমনি দেওয়া হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালী আমলাদের। ফ্ল্যাট পাওয়া সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার সংখ্যা ৩২। তাঁদের মধ্যে চারজন চাকরিতে রয়েছেন। দুজন অবসরের পর বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে (এডিবি)
সরকারের পক্ষ থেকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। বাকিরা অবসরে গেছেন।
সচিবদের বাইরে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিবসহ বিভিন্ন পদের কর্মকর্তারা পেয়েছেন ফ্ল্যাট। সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাসহ ঘনিষ্ঠরাও পেয়েছেন পানির দামের ফ্ল্যাট।
বিভিন্ন সময় সেতু কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পর্ষদে থাকা সচিবেরা যেমন ফ্ল্যাট নিয়েছেন, তেমনি দেওয়া হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালী আমলাদের। ফ্ল্যাট পাওয়া সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার সংখ্যা ৩২।
সরকারি সংস্থার পরিচালনা পর্ষদে থেকে নিজেদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়াকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার বলে উল্লেখ করেছেন দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটি সুস্পষ্টভাবে অনাচার।
ফ্ল্যাট নেওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ও মাহবুব হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস, তোফাজ্জল হোসেন মিয়া প্রমুখ। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সচিব আনিছুর রহমানও পেয়েছেন ফ্ল্যাট। তাঁরা সবাই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন ও প্রভাবশালী আমলা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
সচিবদের বাইরে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিবসহ বিভিন্ন পদের কর্মকর্তারা পেয়েছেন ফ্ল্যাট। সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাসহ ঘনিষ্ঠরাও পেয়েছেন পানির দামের ফ্ল্যাট।
সচিবদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হচ্ছে রাজধানীর উত্তরায়। জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য। সরেজমিনে ২০ মে দেখা যায়, সচিবদের জন্য নির্মাণাধীন ভবনের সামনে বড় খোলা জায়গা। পাশে একটি বড় জলাধার। সব মিলিয়ে মনোরম পরিবেশ। ভবনগুলো করা হচ্ছে বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে। ফলে আলো-বাতাসের কোনো কমতি নেই।
সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারত্বে (পিপিপি) ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১০ সালে। এর আওতায় বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত উড়ালসড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্প এখনো শেষ হয়নি। এই প্রকল্পে যাঁদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাঁদের জন্য ‘পুনর্বাসন ভিলেজ’ নির্মাণের লক্ষ্যে উত্তরা মডেল টাউনের (তৃতীয় ধাপ) বড়কাঁকর, বাউনিয়া ও দ্বিগুণ মৌজায় ৪০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয় আরেকটি প্রকল্পের আওতায়। ওই জমিতে ১২টি ভবনে ১ হাজার ৩৪৪টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য কেনা ৪০ একর জমি থেকে ১ দশমিক ১৫ একর জমি নিয়ে চারটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে তিনটি ভবন সচিব ও বড় আমলাদের জন্য। তাতে ১৬৮টি ফ্ল্যাট রয়েছে। ইতিমধ্যে ১৪০টি ফ্ল্যাট বরাদ্দ হয়ে গেছে। বাকিগুলো ভবিষ্যতে সচিব ও কর্মকর্তাদের মধ্যে বরাদ্দের চিন্তা রয়েছে বলে সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে। সচিব ও কর্মকর্তাদের ভবনগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। কর্মকর্তারা কে কোন ভবনে এবং কোন ফ্ল্যাট পাবেন, তা-ও প্রাথমিকভাবে ঠিক করে রাখা হয়েছে। সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, সচিবদের ভবনের সামনের খোলা জায়গাসহ জমির পরিমাণ চার একরের মতো।
চারটির মধ্যে একটি ভবন রাখা হয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মচারীদের জন্য। যেখানে ফ্ল্যাট রয়েছে ১১২টি।
বিগত সময়ে আমলাতন্ত্র যূথবদ্ধতার মাধ্যমে নানা সরকারি সুবিধা নিয়েছে। বর্তমান সরকারকে অবশ্যই পুরো বিষয়টির তদন্ত করে দেখতে হবে। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান
যেসব কর্মকর্তা সচিব পদে থেকে এসব ফ্ল্যাট নিয়েছেন, তাঁদের অনেকের আবার রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্লট রয়েছে। সরকারি পদে থেকে তাঁরা ঢাকায় জমি ও ফ্ল্যাট দুটোই নিয়েছেন।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি পদে বসে নিজের জন্য কোনো সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই। আইন ও নীতিবিরোধী এমন কিছু হয়ে থাকলে অবশ্যই তদন্ত করা হবে। কেউ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে থাকলে তা বাতিল করা হবে।
যেসব কর্মকর্তা সচিব পদে থেকে এসব ফ্ল্যাট নিয়েছেন, তাঁদের অনেকের আবার রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্লট রয়েছে। সরকারি পদে থেকে তাঁরা ঢাকায় জমি ও ফ্ল্যাট দুটোই নিয়েছেন।
ফ্ল্যাটগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টরে। জায়গাটি দিয়াবাড়ি এলাকার মধ্যে। পাশেই রাজউকের উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প। সেখানকার রাস্তাঘাট প্রশস্ত। কাছেই মেট্রোরেল স্টেশন। সরেজমিনে নির্মাণকাজ দেখে বোঝা যায়, ভবনগুলো খুব মজবুত ও সুন্দর নকশায় তৈরি হচ্ছে। প্রকল্পের ভেতরের রাস্তাঘাট প্রশস্ত, খোলা জায়গা অনেক। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে অনেকটা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে।
উত্তরায় অনেকটা খোলা জায়গা রেখে নির্মিত ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের দাম কত হতে পারে, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল দেশের একটি সুপরিচিত আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে। প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ভালো কোনো আবাসন প্রতিষ্ঠান সেখানে ফ্ল্যাট বিক্রি করলে দাম রাখবে প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ, ১ হাজার ৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের দাম পড়বে ১ কোটি ৯২ লাখ থেকে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, সচিব ও কর্মকর্তাদের প্রায় ১ হাজার ৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের দাম ধরা হয়েছে ৬০ লাখ টাকা। কর্মচারীদের ফ্ল্যাটগুলো কিছুটা ছোট (প্রায় ১ হাজার ২০০)। সেগুলোর দাম ধরা হয়েছে ৪৫ লাখ টাকা করে। বরাদ্দপ্রাপ্তরা পৌনে দুই থেকে পৌনে চার লাখ টাকা পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধ করেছেন।
সরেজমিনে নির্মাণকাজ দেখে বোঝা যায়, ভবনগুলো খুব মজবুত ও সুন্দর নকশায় তৈরি হচ্ছে। প্রকল্পের ভেতরের রাস্তাঘাট প্রশস্ত, খোলা জায়গা অনেক। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে অনেকটা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে।
ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নির্ধারিত ফ্ল্যাটের আয়তন প্রায় ১ হাজার ১০০ থেকে প্রায় ১ হাজার ৩০০ বর্গফুটের মধ্যে। দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ থেকে ৫৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ, সচিবেরা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের প্রায় সমান দামে, তাঁদের চেয়ে ভালোভাবে নির্মাণ করা ফ্ল্যাট নিয়েছেন। টাকাও এককালীন দিতে হচ্ছে না। সহজ শর্তে কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ রয়েছে।
সচিবদের ভবনের নির্মাণকাজও করা হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য নেওয়া পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায়। পুনর্বাসনের জন্য ২০১১ সালের অক্টোবরে ‘সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রজেক্ট’ শীর্ষক প্রকল্প নেওয়া হয়। শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ২১৭ কোটি টাকা। প্রকল্পটি ২০১৪ সালে শেষ হওয়ার কথা। যদিও তা হয়নি। সর্বশেষ ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। কয়েক দফা বাড়ানোর পর আগামী মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বাড়ি ও জমির ক্ষতিপূরণ আলাদাভাবে পেয়েছেন। পাশাপাশি তাঁদের বসবাসের জন্য স্বল্প মূল্যে ফ্ল্যাট দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে জন্যই জমি অধিগ্রহণ ও আবাসন প্রকল্প নেওয়া হয়। পুনর্বাসন ‘ভিলেজে’ বিদ্যালয়, মসজিদ, কমিউনিটি সেন্টার, কমিউনিটি মার্কেট, কমিউনিটি ক্লিনিক, খেলার মাঠ, অভ্যন্তরীণ সড়ক, নালা, গভীর নলকূপসহ নানা সুবিধা রয়েছে।
সেতু কর্তৃপক্ষ আইনে কোথাও এভাবে ভবন নির্মাণ করে সরকারি কর্মকর্তাদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার বিধান নেই। নিজেদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণের চিন্তা থেকেই বাড়তি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল বলে অভিযোগও রয়েছে।
সেতু কর্তৃপক্ষ স্বায়ত্তশাসিত সরকারি প্রতিষ্ঠান। এটি চলে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি বোর্ডের মাধ্যমে। এই বোর্ডের চেয়ারম্যান পদাধিকারবলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা উপদেষ্টা। বাকি ১৪ জন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব। এর মধ্যে সেতু বিভাগের সচিব ও সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালকের পদে একই ব্যক্তি দায়িত্ব পালন করেন।
সেতু কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পর্ষদে প্রতিরক্ষা, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, স্বরাষ্ট্র, বিদ্যুৎ, ভূমি, পানিসম্পদ, অর্থ বিভাগ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবেরা পদাধিকারবলে সদস্য।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ৩১ মে অনুষ্ঠিত সেতু কর্তৃপক্ষের ১০৭তম বোর্ড সভায় সচিব ও কর্মকর্তাদের ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের নীতিমালা অনুমোদন দেওয়া হয়। সে সময়ের বোর্ডের প্রায় সব সদস্য এবং পরবর্তী সদস্যরা ফ্ল্যাট নেন। বোর্ডের বৈঠকে অনুমোদনের সময় বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন ‘ভিলেজ’ নির্মাণের পর কিছু জমি অব্যবহৃত থেকে যায়, যা অন্য কোনো কাজে ব্যবহারের সুযোগ নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় গৃহায়ণ নীতিমালার আলোকে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। অবশ্য সেতু কর্তৃপক্ষ আইনে কোথাও এভাবে ভবন নির্মাণ করে সরকারি কর্মকর্তাদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার বিধান নেই। নিজেদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণের চিন্তা থেকেই বাড়তি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল বলে অভিযোগও রয়েছে।
২০১৮ সালে আবাসন প্রকল্প নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সেতু বিভাগে খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, বেলায়েত হোসেন, আবু বকর ছিদ্দীক, মনজুর হোসেন ও ফাহিমুল ইসলাম (রেলসচিব) সচিব এবং নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের সবাই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ক্ষতিপূরণ প্রকল্পের জায়গায় করা ভবনে ফ্ল্যাট নিয়েছেন। বর্তমান সচিব আবদুর রউফ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি ফ্ল্যাট নেননি।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সেতু বিভাগে থাকার সময় তাঁর ইচ্ছাতেই প্রকল্পের জমিতে সরকারের কর্মকর্তাদের ফ্ল্যাট দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তিনিই আওয়ামী লীগ সরকারপন্থী প্রভাবশালী আমলা ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠজনদের ফ্ল্যাট দেন। পরে তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিব হন। সেখান থেকেও তৎকালীন সরকার-ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের ফ্ল্যাট দেওয়ার বিষয়ে প্রভাব খাটান।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। তাঁকে প্রকাশ্যে দেখা যায় না। মুঠোফোন বন্ধ থাকায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
ফ্ল্যাট নেওয়া সচিব ও সচিব পদমর্যাদার সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের মধ্যে আরও রয়েছেন নাজমুল আহসান, মো. মইনুল কবির, ফাতিমা ইয়াসমিন, শরিফা খান (বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক), হাবিবুর রহমান, হুমায়ুন কবীর, গোলাম মো. হাসিবুল আলম, এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী, আমিনুল ইসলাম খান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মামুন আল রশীদ, মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান (বর্তমানে কৃষিসচিব), সেলিম রেজা, মোহাম্মদ শহীদুল হক, কাজী শফিকুল আযম, জাফর আহমেদ খান, আব্দুল জলিল, জুয়েনা আজীজ, নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, মোফাজ্জেল হোসেন প্রমুখ।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব সেলিম রেজা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জ্যেষ্ঠ অ্যাসাইনমেন্ট কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন। চাকরি থেকে অবসরের পর তাঁকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য করা হয়েছিল। ফ্ল্যাট নেওয়ার বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে জানান, বিধিসম্মত বলেই তো সেতু বিভাগ তাঁকে ফ্ল্যাট দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের শাসনামলের এক যুগের বেশি সময় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন ওবায়দুল কাদের। এ সময় তাঁর একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করা শফিকুল করিম ও গৌতম চন্দ্র পাল ফ্ল্যাট নিয়েছেন। তৎকালীন মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব আবুল তাহের মো. মহিদুল হক, ব্যক্তিগত সহকারী মতিন হাওলাদার ও জাহাঙ্গীর কবির এবং ওই সময় মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগের দায়িত্বে থাকা দুজন কর্মকর্তা আবু নাছের ও শেখ ওয়ালিদ ফয়েজ ফ্ল্যাট পেয়েছেন। সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের দেহরক্ষীর দায়িত্ব পালন করা পুলিশের কনস্টেবল শরিফুল ইসলামকেও ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে কর্মচারীদের ভবনে।
সেতু বিভাগের বোর্ডের সদস্য না হয়েও জনপ্রশাসন, অর্থ, প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, ভূমিসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়, আইএমইডি (পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা), ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মকর্তারাও ফ্ল্যাট পেয়েছেন।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বরাদ্দ দেওয়ার পরও ফ্ল্যাট বেঁচে যেতে পারে। সেগুলোও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে নতুন করে বরাদ্দ দেওয়ার চেষ্টা আছে। এ জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ফ্ল্যাট বরাদ্দের নীতিমালা সংশোধনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে শেষ সময়ে তৎকালীন সরকার নীতিমালা সংশোধন করতে পারেনি।
সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের জন্য সব মিলিয়ে প্রায় ২০৬ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়। এর মধ্যে সরকারি জমি প্রায় ১৭৭ একর, যার সিংহভাগ রেলের। মাত্র ২৯ একর জমি ব্যক্তিমালিকানাধীন। অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য উত্তরায় অধিগ্রহণ করা হয় বেশি জমি, পরিমাণ ৪০ একর।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজউক উত্তরা তৃতীয় পর্বে এখন প্রতি শতাংশ জায়গা কেনাবেচা হচ্ছে ১ কোটি ৩০ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকায়। অর্থাৎ সচিব-কর্মকর্তারা যে ১১৫ শতাংশ জমিতে ফ্ল্যাট পাচ্ছেন, সেই জমির দাম প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। এ জমি তাঁরা অনেকটা বিনা মূল্যে পেয়েছেন।
এর আগে উত্তরাসহ বিভিন্ন স্থানে রাজউক এবং জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ফ্ল্যাট তৈরি করে বিতরণ করেছে। তবে তা লটারির মাধ্যমে বিতরণ করা হয় এবং তা সবার জন্য উন্মুক্ত। তবে সেতু কর্তৃপক্ষের অধীনে নির্মিত হতে থাকা ফ্ল্যাট শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেওয়া হচ্ছে।
সেতু বিভাগের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, সচিব ও কর্মকর্তাদের জন্য ভবন নির্মাণের ঠিকাদার আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের মালিকানাধীন ক্যাসল কনস্ট্রাকশন। তাদের সঙ্গে তিনটি ভবন নির্মাণে ৯০ কোটি টাকায় চুক্তি রয়েছে। আরেকটি ভবনের কাজ এখনো শুরু হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেতু বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারি আবাসন সুবিধা পান না। তাঁদের অবসর-পরবর্তী সুবিধাও অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের মতো নেই। তাঁদের মধ্যে ফ্ল্যাট বরাদ্দ হলেও মানা যেত। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের অনেক কর্মকর্তা দুই মাসের কম সময় সেতু বিভাগে চাকরি করে ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়ে গেছেন। সেতু বিভাগের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র নেই, এমন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা শুধু প্রভাবশালী হওয়ার কারণে ফ্ল্যাট পেয়েছেন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিগত সময়ে আমলাতন্ত্র যূথবদ্ধতার মাধ্যমে নানা সরকারি সুবিধা নিয়েছে। বর্তমান সরকারকে অবশ্যই পুরো বিষয়টির তদন্ত করে দেখতে হবে। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১০ সালে। ঢাকার বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত এটি যাওয়ার কথা। তবে ১৫ বছরেও এর পুরো কাজ শেষ হয়নি।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক এ এইচ এম সাখাওয়াত আখতার ২১ মে প্রথম আলোকে বলেন, বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তারা জুন মাস থেকে কাজ শুরু করবে।
বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (এফডিইই) কোম্পানি লিমিটেডে চীনের শেনডং ও সিনোহাইড্রো এবং থাইল্যান্ডের ইতালিয়ান থাইয়ের মধ্যে শেয়ার নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ ছিল নির্মাণকাজ। আগে ওই তিন প্রতিষ্ঠানের যথাক্রমে ৩৪, ১৫ ও ৫১ শতাংশ শেয়ার ছিল। আইনি জটিলতায় ইতালিয়ান থাই হেরে যাওয়ায় এখন তিন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৮০, ১৯ ও ১ শতাংশে।
এফডিইই কোম্পানি লিমিটেডের প্রকল্প সমন্বয়কারী মিসবাহিল মোকার রাবিন ২১ মে প্রথম আলোকে বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তাঁরা গত ছয় মাস কাজ করতে পারেননি। সরকার এখন তাঁদের কাজ করতে বলেছে। জুনের শেষ নাগাদ কাজ আবার শুরু করা যাবে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ কিলোমিটার। বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত অংশ চালু করা হয় ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে। কারওয়ান বাজারে নামার পথটি চালু হয় গত বছরের মার্চে। এটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। যথাসময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় মানুষ সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।