সাতসকালে হুইসেল বাজিয়ে তিনটি মাইক্রোবাসে করে আদালতে নেওয়া হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম, সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, সাবেক ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র, সাবেক বিমানমন্ত্রী ফারুক খান, সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর আলম এবং ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগারওয়ালাকে।
হাজতখানার সামনে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে দেখা যায়। আজ বৃহস্পতিবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। আর বাকি ব্যক্তিদের বিভিন্ন মামলায় কারাগারে পাঠানো হয় বা গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
আসামিরা আদালতে ঢোকার সময় প্রবেশের দুটি প্রধান ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বারবার বলছিল, আদালতের সামনে বাইরের জনসাধারণ থাকতে পারবেন না। এর আধা ঘণ্টা পর ৭টা ৪৫ মিনিটের দিকে প্রথমে হাজতখানা থেকে বের করে আনা হয় সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারকে। তিনি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরেছিলেন। সাধন চন্দ্রের পেছনে ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক, তাঁর সঙ্গে ছিলেন নারায়ণ চন্দ্র। আর সবার পেছনে ছিলেন আতিকুল ইসলাম ও জাহাঙ্গীর আলম।
বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্যের উপস্থিতিতেই তাঁদের আদালতের এজলাসকক্ষে তোলা হয়। এর ঠিক ১০ মিনিট পর আদালতে আসেন বিচারক। তখন রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাধন চন্দ্র মজুমদার, ফারুক খান, আব্দুর রাজ্জাকসহ অন্যরা কোন কোন মামলার আসামি, তা জানানো হয়। এক এক করে তাঁদের প্রতিটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আসামিপক্ষ থেকে প্রত্যেকের জামিন চেয়ে আবেদনও করা হয়।
তবে জামিনের বিরোধিতা করে আদালতে বক্তব্য দিতে শুরু করেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী।
সাবেক মন্ত্রী ফারুক খানের পক্ষের আইনজীবী আদালতকে বলেন, তাঁর মক্কেল বয়স্ক মানুষ। তিনি পারকিনসন রোগে আক্রান্ত। জামিন দিলে তিনি পলাতক হবেন না।
আসামিপক্ষের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর পিপি ওমর ফারুক ফারুকী আদালতকে বলেন, মামলার তদন্ত চলমান। আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচার মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আদালত ফারুক খানের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম, সাবেক ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্রকে আদালতকক্ষে তোলা হচ্ছেছবি: আসাদুজ্জামান
ফারুক খানের পর সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের পক্ষে জামিন আবেদন করেন তাঁর আইনজীবী। আতিকুলের আইনজীবী আদালতকে বলেন, হত্যা মামলায় তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। তিনি নির্বাচিত মেয়র ছিলেন। আসামিপক্ষের আইনজীবীর ‘নির্বাচিত মেয়র’ শব্দ উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে আদালতে উপস্থিত বিএনপির সমর্থক ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা তীব্র বিরোধিতা করেন। এ সময় বিচারক আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা ব্যাড সাউন্ড করবেন না।’
সব আইনজীবীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে তখন পিপি ওমর ফারুক ফারুকী আদালতকে বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সুষ্ঠু ভোট হয়নি। কারচুপির মাধ্যমে মেয়র হয়েছিলেন আতিকুল। আদালত শুনানি নিয়ে মোহাম্মদপুর থানার একটি হত্যা মামলায় তাঁর জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। আতিকুল গতকাল বুধবার গ্রেপ্তার হন।
এরপর নিউমার্কেট থানার মামলায় গ্রেপ্তার আব্দুর রাজ্জাকের জামিন চেয়ে আবেদন করা হয়। তাঁর পক্ষের আইনজীবী আদালতকে বলেন, তাঁর মক্কেল অসুস্থ। তাঁকে জামিন দেওয়া হোক। আদালত আব্দুর রাজ্জাকের জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। নতুন করে আদাবর থানার একটি হত্যা মামলায় আব্দুর রাজ্জাককে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
পল্টন থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগারওয়ালাকে। পল্টন ও আদাবর থানার পৃথক দুটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে সাধন চন্দ্র মজুমদারকে। পল্টন থানার একটি হত্যা মামলায় নারায়ণ চন্দ্র চন্দকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
আতিকুল বাদে ফারুক খান, রাজ্জাক, সাধন চন্দ্র, নারায়ণ চন্দ্রসহ অন্যরা সম্প্রতি গ্রেপ্তার হলে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। দুই দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ফারুক ও রাজ্জাককে আদালতে তোলা হয়। অন্যদের বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য আজ আদালতে হাজির করা হয়।
আদালতকক্ষে তোলা হচ্ছে আতিকুল ইসলামকেছবি: আসাদুজ্জামান
সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর আলমের জামিনের শুনানি করেন তাঁর আইনজীবী। তিনি আদালতকে যুক্তি দেখিয়ে বলছিলেন, ‘স্যার, উনি সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন। তিনি কোনো খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। চাকরিজীবনে তিনি সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বপালন করেছেন।’
আসামিপক্ষের আইনজীবীর এই কথার তীব্র প্রতিবাদ করেন ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেই ভিডিওতে এই সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর আলমকে দেখা গেছে। এই ভিডিওতে আরও দেখা গেছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকেও। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদিও পালিয়ে গেছেন।’
ওমর ফারুক ফারুকী আরও বলেন, ‘ভিডিওতে একজন পুলিশ কর্মকর্তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলছিলেন, ‘গুলি করে করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা, একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না। এইটা হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়।’
উভয় পক্ষের শুনানি শেষে জাহাঙ্গীর আলমের জামিন আবেদন নাকচ করেন আদালত। মোহাম্মদপুর থানার আরেকটি হত্যা মামলায় নতুন করে জাহাঙ্গীর হোসেনকে দেখানো হয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে আদালতকক্ষে তোলা হচ্ছে সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, সাধন চন্দ্র মজুমদার ও নারায়ণ চন্দ্র চন্দকেছবি: আসাদুজ্জামান
ঢাকার সিএমএম আদালতের দ্বিতীয় তলায় ২৮ নম্বর আদালতে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফারুক খান, আব্দুর রাজ্জাক, সাধন চন্দ্র, নারায়ণ চন্দ্রদের গ্রেপ্তার দেখানো ও জামিন আবেদনের শুনানি শেষ হয়। পরে বিচারক এজলাস ত্যাগ করেন। তখন আদালতকক্ষে উপস্থিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা আসামিদের আদালতকক্ষ থেকে হাজতখানায় নেওয়ার উদ্যোগ নেন। তখন আদালতের তৃতীয় তলায় ওঠার সিঁড়িতে কয়েকজন লোককে দেখা যায়। তখন দাঁড়িয়ে থাকা ওই সব লোকেদের উদ্দেশে একদল আইনজীবীকে বলতে শোনা যায়, ‘এই আপনারা কারা?’ তখন ওই সব লোককে সেখান থেকে চলে যেতে বলা হয়। কাউকে কাউকে ধাওয়া দেওয়া হয়।
সকাল সাতটার পর থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সিএমএম আদালতের সামনে অবস্থান করে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের নেতাদের মামলার শুনানির সময় আদালতের সামনে যাতে কোনো জনসাধারণ ভিড়তে না পারেন, সে ব্যাপারে সতর্ক অবস্থান নিয়েছিলেন পুলিশ সদস্যরা। উৎসুক কাউকে দেখলেই তাঁকে আদালতের সামনে থেকে চলে যেতে বলা হয়।
আতিকুল রাজ্জাক ৫) আদালতের সিঁড়ি দিয়ে সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, সাধন চন্দ্র মজুমদার, সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামকে নামিয়ে আনছে পুলিশছবি: আসাদুজ্জামান
গত মঙ্গলবার আব্দুর রাজ্জাক ও ফারুক খানের রিমান্ড শুনানির সময় ঢাকার সিএমএম আদালতের সামনে বিক্ষোভ করেন আওয়ামী লীগপন্থী একদল আইনজীবী। আদালতের সামনে থেকেই সেদিন আব্দুর রাজ্জাকের এক আত্মীয়কে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। এ ঘটনার পর থেকেই আদালতপাড়ায় সতর্ক অবস্থান নিয়েছে পুলিশ।
ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাঁর সরকারের সাবেক বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সরকারি আমলা, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার ৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।