গাড়িচালক স্বামী মামুন হোসেন (২৮) স্ত্রীকে ফোন দিয়ে বাড়ির খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। এরই মধ্যে স্ত্রী সুলতানা আক্তার জানালেন, তিনি দুপুরের খাবার খেয়ে ফোন করবেন। খাবার শেষে সুলতানা ফোন করলেন, তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন মামুন। ফোন ধরে বলেছিলেন, ঘুম ভাঙলে কথা বলবেন। কিন্তু সেই না-বলা কথা আর বলা হয়নি মামুনের। এর আগে ঢাকার রাজপথে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। পরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় তাঁর। স্বামীর সঙ্গে শেষ কথাটুকু বলতে না পারার আক্ষেপটা সারা জীবনই বয়ে বেড়াতে হবে সুলতানাকে।
১৯ জুলাই বিকেলে ঢাকার মহাখালী ফ্লাইওভার এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মামুন হোসেন। তখন ওই এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ চলছিল। নিহত মামুনের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী সদর উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের জালিয়াল গ্রামে। পরদিন ২০ জুলাই বিকেলে গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে মামুনের লাশ দাফন করা হয়। পরিবারের উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে অনেকটাই নির্বাক মামুনের বাবা-মা। স্বামীর শোকে অনেকটা পাথর বনে গেছেন স্ত্রী সুলতানা আক্তার। মামুনের সাড়ে তিন বছরের ছেলে মো. মুছাব হাসান এখনো জানে না তার বাবা আর কখনো ফিরবে না।
আজ শনিবার সকালে জালিয়াল গ্রামের হাবিব উল্যাহ ব্যাপারীর বাড়িতে কথা হয় নিহত মামুনের বাবা-মা, স্ত্রীসহ প্রতিবেশীদের সঙ্গে। মামুনের বাবা আবদুল মতিন জানান, সেদিন ১৯ জুলাই বিকেলে আসরের নামাজ পড়ে মহাখালী ফ্লাইওভারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তাঁর ছেলে মামুন। হঠাৎ একটি গুলি মামুনের পেছন দিয়ে পেটের ডান পাশে ঢুকে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যেই সড়কে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তখন ওই এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ চলছিল। মামুনকে লুটিয়ে পড়তে দেখে এগিয়ে আসেন আশপাশের পথচারীরা। তাঁরা তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান।
মামুন হোসেনছবি সংগৃহীত
আবদুল মতিন বলেন, খবর শুনে তিনি ছুটে যান ওই হাসপাতালে। সেখান থেকে ছেলেকে নিয়ে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানকার পরিস্থিতি তখন এতটাই খারাপ, চিকিৎসা করানোর মতো কোনো অবস্থা ছিল না। পরে ছেলেকে নিয়ে যান মহাখালীর একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু সেখানেও মেলেনি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা। অনেক চেষ্টা করেও কোনো চিকিৎসককে হাসপাতালে আনতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। পরে বিনা চিকিৎসায় শুক্রবার রাত তিনটায় ওই হাসপাতালে মারা যান তাঁর ছেলে। সেখান থেকে পরদিন বিকেলে লাশ গ্রামের বাড়িতে এনে দাফন করেন।
আবদুল মতিন বলেন, তিনি পেশায় গাড়িচালক। ঢাকায় এক চিকিৎসকের গাড়ি চালান তিনি। তাঁর চার ছেলে। তাঁদের মধ্যে তিনজনই তাঁর দেখাদেখি গাড়ি চালক হয়েছেন। দীর্ঘদিন গাড়ি চালিয়ে সন্তানদের বড় করেছেন। তাঁরা কাজ শুরু করেছেন অন্যের গাড়ি চালিয়ে। এরই মধ্যে মনে হলো, নিজেদের যদি একটি গাড়ি থাকত, তাহলে ছেলেরা চালিয়ে রোজগার করতে পারতেন। এরই মধ্যে তাঁর মালিক (অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক সেনা কর্মকর্তা) নিজের একটি প্রাইভেট কার বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ধারদেনা করে চলতি মাসের শুরুতে ওই গাড়ি কিনে মেজ ছেলে মামুনকে চালাতে দেন। ছেলে গাড়ি পেয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু একটি গুলি তাঁর সেই স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছে।
মামুনের স্ত্রী সুলতানা আক্তার বলেন, শেষবার যখন কথা হয়, তখন তাঁর স্বামী বলেছিলেন, ঢাকায় অনেক গন্ডগোল হচ্ছে। তাই তিন দিন ধরে বাইরে বের হতে পারছেন না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিন-চার দিন পর বাড়িতে আসবেন; কিন্তু সেই আসা আর হলো না। এর আগে স্বামীর লাশ দেখতে হয়েছে তাঁকে। এখন একমাত্র অবুঝ ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর যত চিন্তা। বাবা মারা গেছেন, এটুকু বোঝার বয়সও হয়নি তার।
সুলতানার শাশুড়ি ফাতেমা খাতুন বলেন, বাড়িতে ঘরের ভিটা ছাড়া তাঁদের কোনো জায়গা নেই। চার ছেলের তিনজনকে বিয়ে করিয়েছেন। ছোট্ট একটি টিনের ঘরে অনেক কষ্ট করে ছেলে, ছেলের বউ, নাতিদের নিয়ে থাকতে হয়। আশা ছিল, ছেলে গাড়ি চালিয়ে বাড়তি রোজগার করবেন। পরিবারের হাল ধরবেন; কিন্তু সব আশা শেষ হয়ে গেছে। ছোট্ট নাতির দিকে তাকালে বুকটা ফেটে যায়। সে কাকে বাবা বলে ডাকবে?