জাতীয় বাজেটের ১২ শতাংশের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না দেশের শিক্ষা খাতের বরাদ্দ। যদিও দীর্ঘদিন ধরে এই খাতে বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষা খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
অন্যদিকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দিক থেকেও শিক্ষা খাতের বরাদ্দ ২ শতাংশের ঘরেই আটকে আছে। এই হার ৬ শতাংশ করার দাবি থাকলেও এর ধারেকাছেও যেতে পারছে না বাংলাদেশ।
শিক্ষাবিদসহ শিক্ষা খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলে আসছিলেন, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ পিছিয়ে থাকার ফলে গুণগত শিক্ষার প্রসারে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে পরিকল্পনা করে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। একই সঙ্গে বরাদ্দ স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যয় করতে হবে।
কিন্তু উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল সোমবার আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তাতেও সেই পুরোনো বৃত্তেই আটকে আছে শিক্ষার বাজেট। আসন্ন অর্থবছরের জন্য শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৯৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মোট জাতীয় বাজেটের ১২ দশমিক ১ শতাংশের মতো। আর জিডিপির হিসাবে তা ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এবার মোট জাতীয় বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে প্রায় ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা।
বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন ৯৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল। তখন জাতীয় বাজেট ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছিল। এই হিসাবে তখন জাতীয় বাজেটের প্রায় ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল।
এবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেট টাকার অঙ্কেও কমেছে। এ মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৫ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বিদায়ী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল ৩৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন দুটি বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য এবার ৪৭ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে তা ছিল ৪৪ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের জন্য ১২ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে ১১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল।
বাজেট বরাদ্দে পিছিয়ে বাংলাদেশ
শিক্ষা খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জিডিপির হিসাবে এ অঞ্চলের দেশ ভুটান, নেপাল, আফগানিস্তান, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের চেয়ে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ কম।
শিক্ষা খাতের বাজেট নিয়ে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। ওই প্রবন্ধে বলা হয়, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত এক বছর বাদে বাকি বছরগুলোতে শিক্ষায় বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ১২ শতাংশের নিচে ছিল। ১২ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছিল কেবল ২০২২-২৩ অর্থবছরে। বাকি অর্থবছরগুলোর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ১১ দশমিক ৪১ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ছিল ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এই সময়ে জিডিপির হিসাবে শিক্ষায় বরাদ্দের হার ছিল ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ১১ শতাংশ।
আসন্ন বাজেটে শিক্ষা খাতে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রেখে ২০৩০ সালের মধ্যে তা কীভাবে ২০ শতাংশে উন্নীত করা যায়, তার পথরেখা দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটেনি।
শিক্ষা খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষার গুণমান বাড়াতে হলে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে কাজ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এম আবু ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, ইউনসেকোর চাওয়া ছিল জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ এবং জিডিপির হিসাবে ৪ থেকে ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া। কিন্তু এর কাছেও যাওয়া যায়নি। সেই গতানুগতিক বরাদ্দই করা হয়েছে। তবে স্কুল ফিডিং খাতসহ বেশ কিছু খাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটা ভালো দিক।