টিএসসির সামনের প্রাঙ্গণে কেউ আলপনা আঁকছেন, কেউ রঙিন কাগজ দিয়ে বানাচ্ছেন ফুল। রাস্তার উল্টো দিকে নাটমণ্ডলের সামনেও একই চিত্র। শিক্ষার্থীদের কেউ নাটকের সেট বানাচ্ছেন, কেউ প্রপস, কেউ কেউ মহড়ায় নিজেদের ঝালিয়ে নিচ্ছেন।
গত দুই দিন টিএসসি নাটমণ্ডলে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা গেছে। এই ব্যস্ততার কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮তম কেন্দ্রীয় বার্ষিক নাট্যোৎসব। থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের এটি সবচেয়ে বড় আয়োজন। নিজেদের ব্যবহারিক কাজ নিয়ে শিক্ষার্থীরা এ উৎসব আয়োজন করেন। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকের পাশাপাশি সব শ্রেণির দর্শকের সুযোগ হয় বৈচিত্র্যপূর্ণ নতুন নাটক দেখার।
‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়, আজ সৃষ্টি-সুখে উল্লাস কর’ স্লোগান হৃদয়ে ধারণ করে আজ ৩ ডিসেম্বর মঙ্গলবার থেকে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে শুরু হচ্ছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় বার্ষিক নাট্যোৎসব’। উদ্বোধন করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান। ১১ দিনের ১৮তম এ উৎসবে বিভাগের স্নাতক সমাপনী সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের নির্দেশিত ১৮টি নাটক মঞ্চস্থ হবে। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে শুরু হবে নাটক। এই উৎসবের উদ্বোধনী সন্ধ্যায় বাংলার দেশজ নাট্যের খ্যাতিমান পালাকার ইসলাম উদ্দিনকে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের জন্য বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হবে।
রয়েছে তাঁর পারফরম্যান্সও; ‘কমলার রানী সাগরদিঘী পালা’ পরিবেশন করবেন তিনি। উদ্বোধনী মঞ্চায়ন নাটক বাদল সরকার রচিত, টুম্পা রানি দাশ নির্দেশিত নাটক ‘সুটকেস’।
১১ দিনের ১৮তম এ উৎসবে বিভাগের স্নাতক সমাপনী সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের নির্দেশিত ১৮টি নাটক মঞ্চস্থ হবে। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে শুরু হবে নাটক।
কেউ কেউ মহড়ায় নিজেদের ঝালিয়ে নিচ্ছেনথিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ, ঢাবি
শীতের শুরুতে আয়োজিত এ উৎসব ব্যতিক্রম। নাটক নিয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি নিজেদের ব্যবহারিক কাজ নিয়ে শিক্ষার্থীরা এ উৎসব আয়োজন করে ঠিক পেশাদার নাট্যদলের মতোই। নানা কারণে এবারের উৎসব বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে বলে জানালেন বিভাগের শিক্ষকেরা। উৎসব এবার ১৮ বছর পূর্ণ করেছে এবং একই সঙ্গে বিভাগের তিন দশক পূর্তি উদ্যাপন করছে। চেয়ারপারসন কাজী তামান্না হক সিগমা তো বটেই, থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক রহমত আলী, ইস্রাফিল শাহিন, আশিকুর রহমান লিয়নকে দেখা গেল ব্যস্ত উৎসব নিয়ে। চেয়ারপারসন কাজী তামান্না হকের তথ্যে, এমনিতে বার্ষিক উৎসবের কাজ শুরু হয় অনেক সময় হাতে নিয়ে। এবার নানা কারণে শুরু হয়েছে দেরিতে। মাত্র ২২ দিন সময় নিয়ে উৎসবের প্রস্তুতি। তবে বিভাগের পথচলার ৩০ বছর পূর্তি এবং নতুন সময়কে ধারণ করে এবার আরও আড়ম্বর এবং অর্থবহ করতে চাচ্ছেন তাঁরা।
থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ, ঢাবি
নাট্যশিল্পের মুক্ত ভাষায় পরিবেশনাবিদ্যার বিচিত্র পদ্ধতি ও প্রণালির সংশ্লেষ ঘটিয়ে দৈশিক ও বৈশ্বিক জীবনবাস্তবতার বিশেষ বোধ সৃজন এই বিভাগের অভিমুখ। এবারের উৎসবে প্রদর্শিত নাটকগুলো আমাদের সামষ্টিক জীবনের দ্রোহ, সাম্য, সম্প্রীতি ও সংহতির এক বহুত্ববোধক বাংলাদেশের রূপকল্প তুলে ধরবে বলেই বিশ্বাস
কাজী তামান্না হক, চেয়ারপারসন, থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ
চেয়ারপারসনের ভাষ্যে, নাট্যশিল্পের মুক্ত ভাষায় পরিবেশনাবিদ্যার বিচিত্র পদ্ধতি ও প্রণালির সংশ্লেষ ঘটিয়ে দৈশিক ও বৈশ্বিক জীবনবাস্তবতার বিশেষ বোধ সৃজন এই বিভাগের অভিমুখ। এবারের উৎসবে প্রদর্শিত নাটকগুলো আমাদের সামষ্টিক জীবনের দ্রোহ, সাম্য, সম্প্রীতি ও সংহতির এক বহুত্ববোধক বাংলাদেশের রূপকল্প তুলে ধরবে বলেই বিশ্বাস।
কমলা রানীর সাগর দীঘি পরিবেশন করবেন ইসলাম উদ্দিন পালাকারফাইল ছবি
পথচলার ৩০ বছর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের অন্তর্ভুক্ত সাবসিডিয়ারি বিষয়ে ১৯৮৯ সালে ‘নাট্যকলা’ অধ্যয়ন চালু হয়। ১৯৯৪ সালে নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগ নামে পূর্ণাঙ্গ বিভাগ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। ২০০৯ সালে নাট্যকলা বিভাগ নামে স্বতন্ত্ররূপে আত্মপ্রকাশের পর ২০১৪ সালে থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ নামকরণ হয়। নাট্যচর্চা ও বহুমুখী জ্ঞানের যৌথ অভিব্যক্তি প্রকাশের তীর্থস্থান হিসেবে এই বিভাগ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সত্তার শিকড়ে প্রোথিত হয়েছে বলে মনে করেন বিভাগের শিক্ষকেরা।
২০১৯ সালে বিভাগের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে বের হওয়ার একটি প্রকাশনায় বিভাগের তৎকালীন শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ লিখেছেন, ‘এই বিভাগ চার বছরের স্নাতক ও এক বছরের স্নাতকোত্তর পাঠক্রমের মাধ্যমে “থিয়েটার” ও “পারফরম্যান্স” অধ্যয়নের এক আত্মবাচক হাতিয়ার তুলে দিতে চায় শিক্ষার্থীদের হাতে। পাঠক্রমের মাধ্যমে অভিনয়ের বিভিন্ন পদ্ধতির উপর এমনভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যাতে পাশ্চাত্যের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশের একটি সেতুবন্ধ ঘটে।’
বিভাগের স্মৃতিচারণা তিনি লিখেছেন, ‘আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলাম ২৯ জুলাই ১৯৮৯ এবং সে বছরেই সরাসরি কলা অনুষদের ডিনের তত্ত্বাবধানে, সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসেবে “নাট্যকলা” অধ্যয়ন চালু হয়। তৎকালীন ডিন অধ্যাপক আবদুল মোমেন চৌধুরীর অফিসে বসে ক্লাসসংক্রান্ত প্রথম সেই নোটিশ লিখতে আমার অবস্থা এমন হয়েছিল, যা কখনো ছাত্র হিসেবে পরীক্ষার হলে হয়নি—চলতি বাংলায় ঘাম ছুটে গিয়েছিল। সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসেবে নাট্যকলায় প্রথম ক্লাসের আগে, আমি নিজের বাসা থেকে ঝাড়ু আর ঝাড়ন এনে, নিজের হাতে ক্লাসরুম ঝাড়ু দিয়েছিলাম, বেঞ্চি মুছেছিলাম...।’
বিভাগ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দর্শকের সামনে প্রায়োগিক অভিব্যক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠনে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। এর পর থেকে বহু বৈচিত্র্যময় ও সৃজনশীল নাট্য প্রযোজনা দ্বারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রেখেছে অনন্য অবদান। বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের নাট্যাঙ্গনে ভূমিকা রেখেছেন নানাভাবে।
১৯৯৪ সালে নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগ নামে পূর্ণাঙ্গ বিভাগ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। ২০০৯ সালে নাট্যকলা বিভাগ নামে স্বতন্ত্ররূপে আত্মপ্রকাশের পর ২০১৪ সালে থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ নামকরণ হয়।
স্যুটকেস নাটকের দৃশ্য। ছবি: আয়োজকদের সৌজন্যেথিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ, ঢাবি
ঢাকার পথে ইসলাম উদ্দিন
দেশজ নাট্যের আখ্যান, অভিনয়শৈলী ও নাট্যরস পরিবেশনার সুনিপুণ রূপকার ইসলাম উদ্দিন। নানা সময়ে পালা নাট্যের প্রশিক্ষক হিসেবে ইসলাম উদ্দিন অবদান রেখেছেন।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেশজ পরিবেশনার নন্দন-কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেন এই লোকশিল্পী।
কেউ আলপনা আঁকছেন
বিভাগীয় প্রধানের বলেন, ‘সংস্কৃতির এক জীবন্ত কিংবদন্তি ইসলাম উদ্দিন পালাকারের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অভিজ্ঞান হলো “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ নাট্যজন সম্মাননা ২০২৪”।’ সোমবার সন্ধ্যায় কথা হয় এই গুণী শিল্পীর সঙ্গে। জানালেন, আজ সকালেই ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করবেন।
অল্প কথায় প্রতিক্রিয়া জানালেন, ‘১৯৯৭ সালে জামিল স্যার আমাকে এখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর অনেকবার সেখানে গেছি। তাদের সঙ্গে অনেক কাজ করেছি। দেশ–বিদেশে নানা পুরস্কার পেলেও আমার কাছে এই সম্মাননা বিশেষ পাওয়া। এতে শিক্ষক-ছাত্রদের মূল্যায়ন আছে। ছাত্ররা আমাদের ভবিষ্যৎ। তারা আমারে ওস্তাদ বলে ডাকে, আমাকে সম্মান করে। এ আমার পরম পাওয়া।’