ইংরেজি ‘জার্নাল’ এবং ‘ইজম’ থেকে জার্নালিজম বা সাংবাদিকতার উৎপত্তি। ‘জার্নাল’ শব্দের অর্থ কোনো কিছু প্রকাশ করা এবং ‘ইজম’ শব্দের অর্থ অনুশীলন বা চর্চা করা। সে হিসেবে কোনো কিছু জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য যে চর্চা বা অনুশীলন তাকে সাংবাদিকতা বলা হয়। আর যিনি সংবাদপত্রের জন্য সংবাদ সংগ্রহ করেন ও লেখেন তিনিই সাংবাদিক।
তথ্যপ্রযু্ক্তি যুগের বিশালতায় সীমিত গণ্ডিতে সাংবাদিকতাকে আটকে রাখা যায় না। মার্কিন সাংবাদিক আর ডি ব্লুমেনফ্রেল্ডের বলেছেন, “যিনি সংবাদ সংগ্রহ করে তা প্রকাশ উপযোগী করেন এবং সংবাদ সংক্রান্ত কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনিই সাংবাদিক।”
অস্বীকার করার জো নেই বাংলাদেশ একটি অপরাধপ্রবণ দেশ এবং যথাযথ প্রতিবেদন সংবাদপত্রে প্রকাশের কারণে অপরাধ প্রবণতা কমে বলে ধারনা করা হয়। পাশাপাশি উন্নয়নমূলক ও মানবিক কাজ প্রকাশের মাধ্যমে ভাল কাজে মানুষকে উৎসাহী করা হয়।
সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। কেউ কেউ এটাকে নেশা হিসেবে মানতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ রূপান্তরের যে প্রচেষ্টা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে তাতে মফস্বল সাংবাদিকতা এবং মফস্বল সংবাদপত্রের অবদানও কম নয়।
একটু মনোসংযোগ করলেই আমরা বুঝতে পারি মফস্বল সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীরা নিজ নিজ এলাকার অবহেলিত, অনুন্নত, উন্নয়ন বঞ্চিত জনপদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেন। খুন, ধর্ষণ, বাল্য বিবাহ, অশিক্ষা, অপচিকিৎসা, যৌতুক, গ্রামের সরল মানুষদের নানাভাবে প্রতারিত হওয়া, জবর দখল, সন্ত্রাস, দলাদলি, অগ্নিকাণ্ড, পাহাড়ধস, লোডশেডিং ইত্যাদির শিকার হওয়া মানুষগুলোর পক্ষে কথা বলেন।
তবে সঠিক প্রশিক্ষণ, পেশাদারিত্বের অভাব, অধিক টাকার লোভ ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সাংবাদিকদের মাঝে বিভক্তি বাড়ছে। অপরদিকে অনেক সময় সাংবাদিকদের কাউকে কাউকে সাংঘাতিক, হলুদ সাংবাদিক, চাঁদাবাজ সাংবাদিক, সিন্ডিকেট সাংবাদিক, বিজ্ঞাপন সাংবাদিক, রাজনৈতিক সাংবাদিক, গলাবাজ সাংবাদিক, এমনি এমনি সাংবাদিক, ক্রেডিট পরিবর্তন সাংবাদিক, দালাল সাংবাদিক ইত্যাদি অসুন্দর অভিধায় ভূষিত করা হয়। আমরা এ পরিস্থিতির বদল চাই। আমরা চাই, সাংবাদিকতার আড়ালে তথ্য বানিজ্যের বদলে তা তথ্য সেবায় নিবেদিত হোক।
জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি সাংবাদিকতার মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করতে হলে এ পেশার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ, কঠোর পরিশ্রমী, সময়ানুবর্তী, সাহসী, কৌতুহলী, বুদ্ধিদীপ্ত, ক্ষিপ্র, প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন, দল নিরপেক্ষ, সৎ, ধৈয্যশীল, ভদ্র, সৌজন্যবোধ সম্পন্ন, কুটবুদ্ধিসম্পন্ন, রস ও সাহিত্যবোধ সম্পন্ন হওয়াসহ নানা গুণে গুনান্বিত হতে হয়।
তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের বই পড়া ও লেখার অভ্যাস সাংবাদিকদের জন্য অতিরিক্ত গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাংবাদিকতাকে পেশা কিংবা নেশা হিসেবে নেওয়া সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীরা এসব গুণাবলী চর্চার মাধ্যমে সফল সাংবাদিক হওয়ার পথে এগিয়ে যান। পেশাদারিত্ব অর্জনের জন্য দেশ-বিদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে খোঁজখবর রাখাটা জরুরি। দেশ-বিদেশের সংবাদপত্র পড়া, টিভির নিউজ দেখা, ইন্টারনেটে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো ব্রাউজ করা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিচরণ করা ভালো সাংবাদিক হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ভালো সাংবাদিক হওয়ার জন্য সাংবাদিকতাই পড়ে আসতে হবে এমনটা জরুরি নয়। তবে বিষয়টি পড়া থাকলে তা ভালো সাংবাদিক হতে অবশ্যই সাহায্য করে। স্থানীয় পত্রিকা ও অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে সাংবাদিকতা বিষয় পড়ে আসা ব্যক্তি নিয়োগ দেওয়া সম্ভব না হলেও তাদেরকে পত্রিকায় নিয়োগ প্রদানের সময় ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি পাস করুন। যারা ইতোমধ্যে নিয়োগপ্রাপ্ত কিন্তু এসএসসি পর্যন্ত ওঠেননি, তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্যতর করার পদক্ষেপ নিন। সাংবাদিকদের লেখা অধিকতর বস্তুনিষ্ঠ হবে।
সহকর্মী এক সাংবাদিকের সাথে একদিন কক্সবাজার প্রেসক্লাবে যাই। সময় কাটাতে স্থানীয় দৈনিকগুলোয় চোখ বুলাতে গিয়ে বেশ কয়েকটি সংবাদ ভিন্ন ভিন্ন সাংবাদিকের নামে হলেও দাঁড়ি, কমাসহ মিল থাকার বিষয়টি প্রথম টের পাই। আমি বুঝতে পারি এলাকার কোন একজন তা লিখে রিপোর্টারের নাম পরিবর্তন করে বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠানো হয়েছিল। প্রিন্টমিডিয়ার সম্পাদকবৃন্দরা মিলে এ ধরনের ‘সিন্ডিকেট সাংবাদিক’ মতান্তরে ‘ক্রেডিট পরিবর্তন সাংবাদিক’ এর কাজগুলোকে নিরুৎসাহিত করুন।
সারাদিন ব্যবসা করেন, পত্রিকায় সংবাদ না পাঠালেও সমস্যা নেই। প্রেসক্লাবে অন্তর্ভূক্ত থাকার কারণে প্রাপ্ত নগদ নারায়নই উপরি আয় কিংবা সাংবাদিক পরিচিতির কারণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেলেই হয়। কদাচিৎ রাতে কোনো সাংবাদিককে তেল মেরে তার সংবাদটি নিজের নামে মেইল করলেন। এই ধরনের ‘এমনি এমনি সাংবাদিক’দের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের উদ্যোগ নিন। পত্রিকার মান বাড়বে।
মফস্বল সাংবাদিকের অনেকেই সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। প্রত্যেকের কাছেই তার পেশাটি অনেক ভালবাসার। সমাজের সিংহভাগ মানুষই কোনো না কোনোভাবে সাংবাদিকদের দ্বারা উপকৃত হন কিন্তু এ পেশার মানুষগুলোকে অপমান আর নিরুৎসাহিত করার মানুষেরও অভাব নেই।
কিছু মানুষ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অনেক সময় সাংবাদিকদের দ্বারস্থ হন। যোগসাজশে টাকার বিনিময়ে মিথ্যা কিংবা অতিরঞ্জিত সংবাদ প্রকাশের এই ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ মফস্বলে একটু বেশিই ঘটে। আমি বিশ্বাস করি, প্রশিক্ষিত বার্তা সম্পাদক মাত্রই তেমন সংবাদ বুঝতে পারেন। সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে তেমন সংবাদ প্রকাশ থেকে বিরত থাকুন।
অন্যদিকে জনগুরুত্বপূর্ণ ও নির্যাতিত-বঞ্চিত মানুষের সংবাদও অনেক সময় অর্থের বিনিময়ে বাতিল করা হয়। জনগণের বিপদাপদ ও মামলা-মোকদ্দমায় পক্ষপাতিত্ব কিংবা পুলিশের সাথে খাতিরের সুযোগে দু’পয়সা হাতিয়ে নেন কতিপয় ‘দালাল সাংবাদিক’। অনেক সময় পারিতোষিক নিয়ে অনিয়ম, দূর্নীতির সংবাদও তারা এড়িয়ে যান। এই ধরনের ‘ধান্দাবাজ সাংবাদিক’দের লাগাম টেনে ধরুন। ‘অপ সাংবাদিকতা’ ধীরে ধীরে লোপ পাবে। মানুষের নির্ভেজাল দোয়া পাবেন।
তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সংবাদ কম্পোজ, মেইল ব্যবহার, সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার ইত্যাদি করতে না পারা সাংবাদিকবৃন্দ নিজেরাই মেধার দৌড়ে পিছিয়ে যাচ্ছেন। অন্যজন দিয়ে সংবাদ লিখানোতে বৈচিত্রতা ফুটিয়ে তোলা কষ্টকর। সংবাদকে সমৃদ্ধ ও বস্তুনিষ্ঠ করার জন্য অনেক সময় ইন্টারনেটের সাহায্য নিতে হয়। তাই মফস্বল সাংবাদিকেরকে অন্তত পূর্বোক্ত তিনটি বিষয়ে প্রশিক্ষিত করার ক্ষেত্রে সম্পাদকবৃন্দ প্রতিযোগিতা করুন। ‘আমার পত্রিকার সবাই নিজের সংবাদ নিজে কম্পোজ করেন, তথ্য সাহায্যের জন্য সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করতে জানেন এবং সংবাদটি নিজেই মেইল করেন।’ বুক ফুলিয়ে এটি বলার মাঝে অন্যরকম আনন্দ পাবেন।
কিছুদিন পূর্বে স্থানীয় এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রসূতিসেবার নিম্নমান নিয়ে একটি সংবাদ পড়ি। পরবর্তীতে একদিন সে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক ‘ছোট ছেলেটা’ দেখি প্রেসক্লাবে ফুলের তোড়া গ্রহণ করে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেয় এবং প্রেসক্লাবকে প্রয়োজনীয় সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে যায়। কয়েক মাস আগে একটি অনলাইন নিউজ কার্যালয়ে গিয়ে দেখি, কতিপয় সাংবাদিক হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার সুযোগে পুলিশের জব্দকৃত ইলিশ থেকে নিজেদের জন্য কিছু লুকিয়ে ফেলে।
বলি খেলার নামে যখন জুয়ার আসর বসতে দেখি, তখন সাধারণ মানুষ মনে করেন পুলিশ ও সাংবাদিকদের উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমেই অনৈতিক কাজটি সম্পাদিত হয়। আর আমাদের এলাকাটি এত উপার্জন সহায়ক যে, এখানে ডাক্তার কিংবা পুলিশ যারাই আসেন বদলি হওয়ার পরেও তাঁরা ঘুরে ফিরে এ এলাকায়ই থেকে যান। কেহ চেম্বার করেন, কেউ বা সপরিবারে থাকেন। তাই তাচ্ছিল্যভরে মানুষকে বলতে শুনি, উনারা তো আমাদের এলাকায় ‘দুবাই’ আসেন! প্রথিতযশা সাংবাদিক আবদুল কুদ্দুস রানার ফেসবুক মন্তব্য, ‘সাংবাদিকতার এই মহান পেশাকে কাজে লাগিয়ে কিছু লোক লাভবান হচ্ছে। তবে সাংবাদিক এবং পুলিশ প্রশাসন দেশপ্রেম ও নৈতিকতায় উদ্ভুদ্ধ হলে সমাজটি সহজেই পরিশুদ্ধ হতো।’
অপসাংবাদিক গোত্রের সদস্য নেহায়েতই কম – বিশ্বাস করতে ভাল লাগে। রাশেদ দিদারুলের ফেসবুক মন্তব্য, ‘বর্ষায় প্রায়ই বিশাল সাগরের খানিক জল ঘোলাটে ও ময়লা দেখায়, তবে তা কেবল সামনের দিকে, একটু দুরে তাকালেই দেখা যায় দিগন্ত অবধি অফুরন্ত ঝলমলে নীল জলরাশি।’ আমরা চাই, ভাল সাংবাদিকদের সাহচর্যে হলুদ সাংবাদিকবৃন্দের কলব থেকে ‘ঘোলাটে ময়লা’ বিদুরিত হোক। ‘একটি ভাল সংবাদপত্র নিজেই দেশের কন্ঠস্বর হিসেবে কাজ করে’ আর্থার মিলারের এ কথা আমরা বিশ্বাস করতে চাই।
আমরা চাই, সমাজের আয়নায় পরিণত হোক সাংবাদিকদের লেখনি, যা দেখে মানুষ সচেতন হবেন। তাদের লেখা-পড়ে মানুষ ভাল কিছু শিখবেন, উৎসাহিত হবেন, ভাল কাজ করতে অনুপ্রেরণা পাবেন। পাশাপাশি অপরাধমূলক সংবাদ পড়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন যাতে সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়।
আমরা চাই, এলাকার অন্যায়, অত্যাচার, বঞ্চনা, শোষণের বিপক্ষে সাংবাদিকের ক্যামেরা যথাযথ কাজ করুক ও ভাল কাজের প্রশংসার বাস্তব ছবি ফুটে উঠুক, সমাজ উপকৃত হোক।