সাগরপাড়ের বাসিন্দা আবদুল গফুরের (৫৬) কাছে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলা নতুন কিছু নয়। জন্মের পর থেকেই এসব দুর্যোগ দেখে আসছেন তিনি। কিন্তু এখন যেভাবে জলোচ্ছ্বাস কিংবা সাগরের ঢেউয়ে বসতভিটা বা জমিজিরাত নষ্ট হচ্ছে, আগে তেমনটা দেখেননি।
আবদুল গফুরের বাড়ি কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর মাতারবাড়ী ইউনিয়নের জালিয়াপাড়া গ্রামে। তিনি মৎস্যজীবী। এই গ্রামে অন্তত দুই হাজার মানুষের বসবাস। বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষা এ গ্রামের পশ্চিমে কোহেলিয়া নদী।
কয়েক বছর ধরে এ গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে গত পাঁচ বছরে এ গ্রামে বসতবাড়ি হারিয়েছে অন্তত ১০০ পরিবার। বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিক জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে তাদের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে যায়। ফলে বসতবাড়ি হারিয়ে গ্রামের অনেকেই এখন পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। গফুরও ঘরবাড়ি হারিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ু নিয়ে নতুন শঙ্কার জানান দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) আর্থ, অ্যাটমোস্ফিয়ারিক এবং প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস বিভাগের একদল গবেষক।
গৃহহারা ১০০ পরিবারের মধ্যে আছেন গ্রামের মৎস্যজীবী নূর হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক যুগ ধরে তাঁরা ওই গ্রামে বসবাস করছেন। বর্ষার মৌসুমে জলোচ্ছ্বাসের সময় তাঁদের ঘরবাড়িতে আগে তেমন পানি উঠত না। কিন্তু পাঁচ-ছয় বছর ধরে জলোচ্ছ্বাস নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবেই একবার বড় জলোচ্ছ্বাসের কবলে তাঁদের ঘরবাড়ি ভেঙে যায়। এখন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকছেন।
স্থানীয় মাতারবাড়ী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে এই জালিয়াপাড়া। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ আলীর কথা, বেড়িবাঁধ নির্মাণ না করলে সামনে আরও শ দুয়েক পরিবার তাদের বসতবাড়ি হারাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ঝড়ঝঞ্ঝা-জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের, বিশেষ করে উপকূলের মানুষের কাছে নতুন কিছু নয়। এর সঙ্গে লড়াই করেই বেঁচে থাকতে শিখেছেন এসব অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রকৃতি যেন বেশি বৈরী। জালিয়াপাড়া গ্রামের মানুষ শুধু নয়, এমন অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের দীর্ঘ উপকূলে থাকা অনেক মানুষের।
গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। আগে যে ধরনের বড় ঝড় ১০০ বছরে একবার হতো, এখন তা ১০ বছরেই হতে পারে। এই ঝুঁকি অঞ্চলভেদে ও মৌসুমভেদেও ভিন্ন হতে পারে।
বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদদের কথা, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমনটা হচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ু নিয়ে নতুন শঙ্কার জানান দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) আর্থ, অ্যাটমোস্ফিয়ারিক এবং প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস বিভাগের একদল গবেষক।
গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। আগে যে ধরনের বড় ঝড় ১০০ বছরে একবার হতো, এখন তা ১০ বছরেই হতে পারে। এই ঝুঁকি অঞ্চলভেদে ও মৌসুমভেদেও ভিন্ন হতে পারে।
দেশে বাড়ছে এসব ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কাও। বাংলাদেশের উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি ১০ গুণ বাড়তে পারে।
বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু নিয়ে আরও শঙ্কা আছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভবিষ্যতে প্রাক্-মৌসুমি বা মৌসুমি বায়ু পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের প্রবণতা বাড়তে পারে। এতে অসময়ে প্লাবিত হবে নতুন নতুন এলাকা ও কৃষিজমি। দেশের উপকূলীয় এলাকায় কৃষি এবং সার্বিকভাবে জনজীবনে এর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।
বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ুঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশের এই ভয়ানক ভবিষ্যতের চিত্র উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়ান আর্থ নামের বিজ্ঞান সাময়িকীতে। ১১ এপ্রিল এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) সদস্য ও বুয়েটের পানিসম্পদ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন এ গবেষণায় যেদিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে, তা আমাদের নতুন দিকের সন্ধান দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় আমরা যেসব পরিকল্পনা করছি, তাতে এ গবেষণার ফলাফল ব্যাপক সহায়তা করবে। আমাদের অভিযোজন পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে—এ গবেষণা সেই দিকেরই নির্দেশ দিচ্ছে।’
বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ুঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশের এই ভয়ানক ভবিষ্যতের চিত্র উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়ান আর্থ নামের বিজ্ঞান সাময়িকীতে। ১১ এপ্রিল এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
কেন এই গবেষণা
এ কথা এখন বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত যে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। বাংলাদেশের অবস্থান এমন একটি ভৌগোলিক স্থানে যেখানে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে। এটি নিচু বদ্বীপ অঞ্চল। এখানে আছে ফানেল আকৃতির উপকূল। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, তীব্র ঘূর্ণিঝড় এবং মৌসুমি বৃষ্টিপাত—বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির দিক প্রকট করছে।
নতুন এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম তথ্য-সংকটাপন্ন কিন্তু দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল। বৈজ্ঞানিকভাবে, বাংলাদেশ হলো জটিল ও ক্রমিক দুর্যোগ বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
এমআইটির এই গবেষকদের একজন এবং প্রতিষ্ঠানটির আর্থ, অ্যাটমোস্ফিয়ার অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সাই জ্যান্ডার সাভেলা প্রথম আলোকে ই-মেইলে বলেন, ‘বাংলাদেশ যে পরিমাণ ঝুঁকির মুখোমুখি, তা সর্বোচ্চ মানের মডেলিং, সর্বোত্তম বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং জরুরি সহযোগিতা দাবি করে। আমরা এখানে যে বিষয়গুলো তুলে ধরেছি, তা কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং ভিয়েতনাম, দক্ষিণ চীন, ইন্দোনেশিয়া ও অন্যান্য সমমানের বদ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর জন্যও প্রাসঙ্গিক হবে।’
নতুন এ গবেষণায় যেদিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে, তা আমাদের নতুন দিকের সন্ধান দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় আমরা যেসব পরিকল্পনা করছি, তাতে এ গবেষণার ফলাফল ব্যাপক সহায়তা করবে। আমাদের অভিযোজন পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে—এ গবেষণা সেই দিকেরই নির্দেশ দিচ্ছে
আইপিসিসি সদস্য ও বুয়েটের পানিসম্পদ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম
এ উপমহাদেশের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত যোগাযোগের কথা উল্লেখ করে সাভেলা বলেন, ‘যদিও আমি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং সেখানে কাজ করি, তবে আমি ভারতের সন্তান এবং বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের সঙ্গে আমার গভীর শিকড় রয়েছে। এ অঞ্চল আমার জন্য বৈজ্ঞানিক এবং ব্যক্তিগত—উভয় দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে পেরে আমি অপার আনন্দ ও শক্তি অনুভব করি।’
গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি হলো: ভবিষ্যতের ঝুঁকি বোঝার জন্য শুধু অতীতের পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করা যাবে না। জলবায়ু ইতিমধ্যেই পরিবর্তিত হচ্ছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের পুনরাবৃত্তির হার বাড়ছে। আমাদের গবেষণার ফলাফল দেখায়, যেসব ঝড়-জোয়ারকে আগে ১০০ বছরে একবারের ঘটনা বলে ধরা হতো, সেগুলো এই শতাব্দীর শেষের দিকে প্রতি ১০ বছর বা তারও কম সময়ে একবার করে ঘটতে পারে।’
কীভাবে হলো গবেষণা
এ গবেষণায় একটি সমন্বিত বিশ্লেষণ ও জলগতিশীলতা মডেল (হাইড্রোডাইনামিক) ব্যবহৃত হয়েছে। তিনটি প্রধান বিষয়কে কেন্দ্র করে এই বিশ্লেষণগুলো করা হয়েছে। সেগুলো হলো কৃত্রিম ঘূর্ণিঝড় বিশ্লেষণ, জলোচ্ছ্বাসের জলগতিশীলতা সিমুলেশন এবং পরিসংখ্যানভিত্তিক বিশ্লেষণ।
গবেষণায় প্রথমে একটি কৃত্রিমভাবে তৈরি ঘূর্ণিঝড় ট্র্যাক সেট ব্যবহার করা হয়েছে। যার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যেমন ঘূর্ণিঝড়ের স্বাভাবিক প্রবণতা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাংলাদেশের জলোচ্ছ্বাসে কীভাবে প্রভাব ফেলে, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মোখায় ক্ষতিগ্রস্ত সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সৈকতের বালিয়াড়ি ভেঙে আবাসিক এলাকার ঘরবাড়িতে ঢুকছে পানি। ২০২৩ সালের মে মাসে
কৃত্রিমভাবে এই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণে ইমানুয়েলস মডেল বেশ পরিচিত। একে বলা হয় স্টর্ম বা সিনথেটিক ট্রপিক্যাল সাইক্লোন জেনারেশন মডেল বা স্টর্ম। যে তিন গবেষক এই গবেষণার কাজ করেছেন, তাঁদেরই একজন কেরি ইমানুয়েল। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মডেলটিতেই কৃত্রিম ঝড় তৈরি করে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি দেখা হয়। এ গবেষণায় ১৭৬০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশের উপকূলে সংঘটিত বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়ের বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
এরপর এই কৃত্রিম ঘূর্ণিঝড়গুলো ব্যবহার করে একটি যাচাইকৃত জলগতিশীলতা মডেলের মাধ্যমে জলোচ্ছ্বাসের সিমুলেশন চালানো হয়েছে। এই মডেল জোয়ার-ভাটার প্রভাব এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়টি আধুনিক ও নির্ভুল আঞ্চলিক সমুদ্রতল মানচিত্র (বাথিমেট্রি) ব্যবহার করে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারে।
এই মডেল সামনে রেখে গবেষণায় দেখানো হয়েছে, সীমিত আকারেও যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তবে শতাব্দীর শেষে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের সময় জোয়ারের উচ্চতা ৪ দশমিক ৯ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। যদি মাঝারি মাত্রার পরিবর্তন হয়, তবে এর উচ্চতা হতে পারে ৫ মিটার। আর যদি পরিবর্তনের গতিধারা তীব্র হয়, তবে জোয়ারের উচ্চতা বাড়তে পারে ৫ দশমিক ৪ মিটার।
সম্ভাব্য ক্ষতি এবং ক্ষতির এলাকা
গবেষণায় বাংলাদেশের ওপর ঝড়ের জোয়ারসংক্রান্ত ঝুঁকি মূল্যায়ন করা হয়েছে। মূল্যায়নগুলো তিনটি স্তরে করা হয়েছে জাতীয় স্তরে, আঞ্চলিক স্তরে (গঙ্গা, মেঘনা অববাহিকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চল) এবং স্থানীয় স্তরে।
গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাবের ক্ষেত্রে তিনটি পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা হয়। একটি হলো স্বাভাবিক, একটি মাঝারি এবং তৃতীয়টি তীব্র। বৈশ্বিক সমাজ ও অর্থনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য পরিবর্তন তুলে ধরতে অংশত আর্থসামাজিক পথনির্দেশ (এসএসপি) আইপিসিসির একটি মডেল। ২০২১ সালে এটি প্রকাশিত হয়। এই মডেলই ২১০০ সাল পর্যন্ত তিন ধরনের পরিস্থিতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব ব্যাখ্যা করা হয়েছে এ গবেষণায়।
এই মডেল সামনে রেখে গবেষণায় দেখানো হয়েছে, সীমিত আকারেও যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তবে শতাব্দীর শেষে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের সময় জোয়ারের উচ্চতা ৪ দশমিক ৯ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। যদি মাঝারি মাত্রার পরিবর্তন হয়, তবে এর উচ্চতা হতে পারে ৫ মিটার। আর যদি পরিবর্তনের গতিধারা তীব্র হয়, তবে জোয়ারের উচ্চতা বাড়তে পারে ৫ দশমিক ৪ মিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি—এই দুই পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়েই এই পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে।
অথচ শত বছরে দেশের উপকূলে দেখা দেওয়া ঘূর্ণিঝড়ের সময় জোয়ারের উচ্চতা প্রায় সাড়ে ৩ মিটার। সেই তুলনায় এই শতকের শেষে যদি সীমিত আকারের পরিবর্তনও হয় তবু জোয়ারের উচ্চতা প্রায় দেড় মিটার বেড়ে যেতে পারে।
যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাদও দেওয়া হয়, তাহলে শুধু ঝড়ের গতিধারার পরিবর্তনের ফলে জোয়ার বাড়বে যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৬ মিটার এবং শূন্য দশমিক ৯ মিটার।
আঞ্চলিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে ঝড়ের জোয়ারের প্রভাব অঞ্চলভেদে ভিন্ন। উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রামের উত্তর অংশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হলো চট্টগ্রামের উত্তরাংশ, এরপর মেঘনা অঞ্চল এবং গঙ্গা অঞ্চল। চট্টগ্রামের দক্ষিণাংশ ঝুঁকির দিক থেকে চতুর্থ স্থানে।
ঝড়ের ঝুঁকি ১০ গুণ বেড়েছে
জলবায়ু পরিবর্তনের গতি এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস কত ঘন ঘন হতে পারে, তা তুলে ধরা হয়েছে গবেষণায়। বাংলাদেশের উপকূলে অতীতের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় যেমন ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড় বা ১৯৯১ সালের (গোর্কি) ঘূর্ণিঝড়ের ধরন দেখে পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। গবেষকেরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরার জন্য এবং কার্যকর অভিযোজন কৌশল তৈরির জন্য এটা দরকার।
একাধিক মডেলভিত্তিক বিশ্লেষণ, বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের উপাত্ত, এসব ঘূর্ণিঝড়ের ফিরে আসার সময় ও ভবিষ্যৎ জলবায়ু দৃশ্যপট নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে—মাঝারি থেকে উচ্চমাত্রার কার্বন নিঃসরণ চলতে থাকলে শতকের শেষ দিকে ঘূর্ণিঝড়জনিত জলোচ্ছ্বাসের গড় প্রত্যাবর্তন সময় ১০ গুণ কমে যেতে পারে, অর্থাৎ ঝুঁকি ১০ গুণ বাড়তে পারে।
ঝোড়ো হাওয়া আর জলোচ্ছ্বাসের কবলে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার আকমল আলী ঘাট জেলেপল্লি এলাকা। ২০২৩ সালের ২৬ অক্টোবর তোলা
পাল্টাতে পারে ঘূর্ণিঝড়ের সময়
বাংলাদেশে বিপজ্জনক জলোচ্ছ্বাস এখনো মূলত বর্ষার আগে ও বর্ষার পরই হয়ে থাকে। বর্ষার আগে বলতে মার্চ থেকে মে এবং বর্ষার পরের মৌসুম বলতে অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসকে বোঝানো হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘূর্ণিঝড়ের বিরতির সময় ৭৫ দিন থেকে কমে মাত্র ১৫ দিন হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গবেষণায় বলা হচ্ছে, প্রায় সব জলবায়ু পরিস্থিতিতেই এই ধ্বংসাত্মক জলোচ্ছ্বাসগুলো বছরের আরও দীর্ঘ সময়জুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে এবং এর তীব্রতাও বাড়ছে। বিশেষ করে বর্ষাকালীন (আগস্ট ১-১৫ এবং সেপ্টেম্বর) ও বর্ষা-পরবর্তী (ডিসেম্বর ১ এবং ১৫) সময়গুলোতে জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি বাড়ছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, বর্ষা মৌসুমে (আগস্টের মাঝামাঝি) পানির স্তর অনেক উঁচু থাকে। ঠিক সেই সময় যদি ভারী বৃষ্টিপাত হয় তাহলে বর্ষার সঙ্গে ও উপকূলীয় প্লাবনের সম্মিলিত ঝুঁকি অনেক বেড়ে যেতে পারে। এই ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে যদি ঘূর্ণিঝড়জনিত ভারী বৃষ্টিপাতও সঙ্গে থাকে।
ভবিষ্যতের এই যে পরিবর্তন তার জন্য বাংলাদেশকে এখনই প্রস্তুত হতে হবে বলে মনে করেন গবেষক সাই সাভেলা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুর্যোগ হওয়ার পর কিছু করার চেয়ে নতুন চরমভাবাপন্ন পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তুত হতে হবে। প্রথাগত মানসিকতা থেকে বের হয়ে ভবিষ্যতের ঝুঁকির জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার মতো সক্রিয় মানসিকতা দরকার।’
সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হলো চট্টগ্রামের উত্তরাংশ, এরপর মেঘনা অঞ্চল এবং গঙ্গা অঞ্চল। চট্টগ্রামের দক্ষিণাংশ ঝুঁকির দিক থেকে চতুর্থ স্থানে।
প্রকৃতি এখনই বৈরী
বর্ষা শেষে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা দাতিনাখালি গ্রামের মানুষেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাঁদের ভয়, কখন ঝড় আসে। এখন কেমন জানি বর্ষার পরে ঝড়ের পরিমাণ বেড়ে গেছে, মনে করেন এ গ্রামের আবদুল আলিম (৫০)। তিনি বলছিলেন, আগে জলোচ্ছ্বাস হতো না বললেই চলে। ঝড় হতো। আর এখন ঝড় হলেই তার সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস হয়।
উপজেলার আরেক গ্রাম বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের জেলে হাফিজুর রহমান (৭০) ও একই গ্রামের ফাতেমা খাতুন জানান, জলোচ্ছ্বাস হলেই নদীর লবণপানিতে খাবার পানির আধার পুকুর-দিঘি তলিয়ে যায়। এ ছাড়া জমিতেও লবণাক্ততার পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। মানুষ বর্তমানে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় পানি কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছে।
মোখা, হামুন ও তারপর মিধিলি। ২০২৩ সালে তিন-তিনটি ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে বাংলাদেশে। এক বছরে তিনটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার বিষয়টি জলবায়ুবিশেষজ্ঞদের কারও কারও মতে অস্বাভাবিক।
বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ এবং ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ কমলেও বাড়ছে বড় বা শক্তিশালী ঝড়ের সংখ্যা। আবহাওয়া ও জলবায়ুবিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অন্যান্য সাগরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গোপসাগরেও তাপমাত্রা বাড়ছে। এর ফলে ঘূর্ণিঝড়গুলো হয়তো তীব্র হচ্ছে। কিন্তু এর সংখ্যা কমছে।
১৯৪৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রতি দেড় দশক ধরে হিসাব করে দেখা গেছে, ১৯৪৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত সময়ে ঘূর্ণিঝড় উৎপত্তি হয়েছে ২০টি। সবচেয়ে বেশি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সময়ে। এ সময় ৫২টি ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি হয় বঙ্গোপসাগরে। এরপরই রয়েছে ১৯৭৮ থেকে ১৯৯২ সাল। এ সময়ে উৎপত্তি হওয়া প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ছিল ৩০। ১৯৯৩ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত সময়ে ২২টি, এরপর ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে ২৪টি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি হয়েছে।
বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় কমে যাওয়া এবং বড় ঝড়ের শঙ্কা বেড়ে যাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ছে। তাপমাত্রা বাড়ছে ভূপৃষ্ঠেরও। উভয় মিলে চরমভাবাপন্ন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সহায়ক পরিবেশে বিঘ্ন ঘটছে। তাই বড় ঝড়ের শঙ্কা বাড়ছে।
২০২১ সালে নাসা সেন্টার ফর ক্লাইমেট সিমুলেশনের (এনসিসিএস) করা ‘এক্সপ্লোরিং পাস্ট অ্যান্ড ফিউচার ট্রপিক্যাল সাইক্লোনস ইন দ্য বে অব বেঙ্গল উইথ হাইএন্ড কম্পিউটিং’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘উষ্ণ জলবায়ুর কারণে ভবিষ্যতে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা প্রত্যাশিত সংখ্যার চেয়ে কমে যেতে পারে। তবে উত্তর বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি বায়ুর পরবর্তী সময়ে বেশি শক্তির ঘূর্ণিঝড় হতে পারে। এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের ওপর।’
বঙ্গোপসাগরে তীব্র মাত্রার ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি আইপিসিসির পর্যবেক্ষণেও আছে।
অধ্যাপক এ কে সাইফুল ইসলাম আইপিসিসির সেই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেন, বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় কমলেও এখন যেসব ঝড় আসছে, সেগুলো তীব্র হচ্ছে। এবং তা আরও হতে পারে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বায়ুর পানি বহন করার ক্ষমতা ৭ শতাংশ বেড়ে যাবে।
দুর্যোগ মোকাবিলায় কী পরিবর্তন দরকার
এমআইটির এ গবেষণা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য আগাম সতর্কতা এবং টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের এখন একটি পূর্ণাঙ্গ ঝুঁকিভিত্তিক পরিকল্পনা দরকার। বর্তমানে যেসব অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ হচ্ছে, তার ভিত্তি অনেকটাই ঐতিহাসিক জলবায়ু তথ্যের ওপর। কিন্তু অনেক অঞ্চল ও জনসংখ্যা এখনো বিপৎসংকুল ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যদি আমরা ভবিষ্যতের দুর্যোগ পুনরাবৃত্তির ধরন অনুযায়ী আমাদের নকশার মান, নীতিমালা ও আর্থিক পরিকল্পনা হালনাগাদ না করি, তাহলে আমরা এমন এক পৃথিবীর জন্য নির্মাণ করে যাব, যা বাস্তবে আর নেই।’
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ২০০৯ সালে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (বিসিসিএসএপি) গ্রহণ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এটাই ছিল সরকারের বড় ধরনের নীতি ও পরিকল্পনা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এরই মধ্যে নানা ধরনের বিষয় যুক্ত হয়েছে। নতুন নতুন ক্ষতি ও শঙ্কার কথা উঠে এসেছে নানা ধরনের গবেষণায়।
জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে লোকালয়। চট্টগ্রামের পতেঙ্গার আকমল আলী ঘাট জেলেপল্লি এলাকা থেকে ২০২৩ সালের ২৬ অক্টোবর তোলা
জলবায়ুবিশেষজ্ঞ হাসীব মুহাম্মদ ইরফানুল্লাহ্ দীর্ঘ সময় ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের নানা দিক নিয়ে গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। তিনি বলছিলেন, বিসিসিএসএপি এখন একটি অচল দলিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন পর্যন্ত এটি নিয়েই আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে। এখন পর্যন্ত যেসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, তা-ও এর ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু ২০২২ সালে বাংলাদেশ সরকার ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান (জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা—এনএপি) গ্রহণ করে। এটি এখনো কার্যকর নয়। এটি আমরা হাতে নিয়ে বসে আছি, কিন্তু কোনো কাজ করছি না।
কাঠামো, পরিকল্পনা, নকশায় যেসব পরিবর্তনের কথা এমআইটির গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের দুর্যোগবিশেষজ্ঞরাও এর সঙ্গে একমত।
দুর্যোগবিশেষজ্ঞ গওহার নাইম ওয়ারা বলছিলেন, ‘এমআইটির গবেষণায় সবচেয়ে বেশি চমকে দেওয়া তথ্য হচ্ছে ‘গড় ঝড়-জোয়ারের প্রত্যাবর্তন মেয়াদকাল উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। এমন হলে বিপদের মাত্রা, সময় এবং অবস্থানের রকমফের হবে। চেনা সাইক্লোন, চেনা বন্যাকে অচেনা লাগবে। সাইক্লোন মোকাবিলায় উপকূলের বহু প্রজন্মের অর্জিত জীবন দক্ষতা জ্ঞান আর কাজে আসবে না। বিষয়গুলো আমলে নিয়ে আমাদের এলাকাভিত্তিক এবং মৌসুমভিত্তিক ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণের বা ফলিত গবেষণার পদক্ষেপ নিতে হবে।’
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। ওই ঝড়ে জোয়ার এবং ঘূর্ণিঝড় পতনের সময় একসঙ্গে হয়েছিল বলে মানুষের মৃত্যু অনেক বেশি হয়েছিল। তবে গত চার দশকে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় রাষ্ট্রের ক্ষমতা অনেক বেড়েছে। তবে বহুদিন বড় ঘূর্ণিঝড় না হওয়ায় আমাদের প্রস্তুতিতে আলস্য ভর করেছে বলে মনে করেন গওহার নইম ওয়ারা।
বন্যা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, নদীভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে ‘ডেলটা প্ল্যান-২১০০’ বা বদ্বীপ পরিকল্পনা করা হয়েছে। ভবিষ্যৎ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা এর একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।
এখন এমআইটির গবেষণা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত নিয়ে অন্য নানা নতুন গবেষণাকে আমলে নিয়ে বদ্বীপ পরিকল্পনায় প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা দরকার মনে করেন জলবায়ুবিশেষজ্ঞ এ কে এম সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রতি পাঁচ বছর পরপর এ পরিকল্পনার পর্যালোচনার কথা আছে। সেটা করার ক্ষেত্রে নতুন এই গবেষণার ফলকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।
[তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কল্যাণ ব্যানার্জি, সাতক্ষীরা ও রুহুল বয়ান, মহেশখালী, কক্সবাজার]
অভিমত
আমরা সবাই জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। এ-সংক্রান্ত নানা ধরনের বিপদ রয়েছে দেশটির। যেমন বাংলাদেশ নিচু বদ্বীপ অঞ্চল, এর উপকূল ফানেল আকৃতির। এখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তীব্র ঘূর্ণিঝড় এবং মৌসুমি বর্ষার হুমকিও আছে। এই বদ্বীপ এত ঝুঁকিতে, কিন্তু এখানে এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি অনেক। যুগপৎ এবং ধারাবাহিক ঝুঁকি বোঝার জন্য এখানে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজনীয়তা অনেক। এসব কারণেই বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত গবেষণার এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই অঞ্চলের বিপদের ধরন, পরিমাণ ও জটিলতা বিবেচনায় সবচেয়ে উন্নত মডেলিং, উন্নত মানের বিজ্ঞান এবং জরুরি সহযোগিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের গবেষণার ফলাফল কেবল এ দেশের জন্য নয়; বরং ভিয়েতনাম, দক্ষিণ চীন, ইন্দোনেশিয়া এবং একই রকম অন্য উপকূলীয় ও বদ্বীপ অঞ্চলের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হবে। এমআইটি ‘ক্লাইমেট গ্র্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’ নামের একটি প্রকল্প চালু করেছে। বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের কাজটি এই প্রকল্পের অধীনেই করা।
সাই চ্যান্দের র্যাভেলা
আমি মার্কিন নাগরিক, সেখানেই কাজ করি। তবে জন্মেছি ভারতে। আর বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে আমার গভীর পারিবারিক সম্পর্ক আছে। তাই আমার কাজের ক্ষেত্র ও ব্যক্তিগত জীবন—দুই অর্থেই এ অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ। আমি বাংলাদেশিদের সঙ্গে কাজ করেছি। তাদের কাছ থেকে শেখার সুযোগ পেয়েছি। তাদের উদারতা আমাকে আপ্লুত করেছে। আমি আশা করি, আমাদের এই কাজ সার্থক হবে এবং এই অঞ্চলের মানুষের কল্যাণ ও স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
প্রশ্ন হলো, এই গবেষণার মাধ্যমে আমরা কী বার্তা দিতে চাই।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি হলো, আমরা ভবিষ্যতের ঝুঁকি বোঝার জন্য শুধু অতীতের তথ্যের ওপর নির্ভর করতে পারি না। জলবায়ু তো পাল্টাচ্ছে, আর ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনাগুলোও বারবার ঘটছে। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, আগে যেসব ঝড়-জলোচ্ছ্বাসকে মনে করা হতো ১০০ বছরে একবার ঘটে, সেগুলো এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ প্রতি ১০ বছর বা তারও কম সময়ে ঘটতে পারে। আমরা হাজার হাজার কৃত্রিম ঘূর্ণিঝড়ের সিমুলেশন চালিয়ে এমন পূর্বাভাস পেয়েছি। অর্থাৎ যেটা আগে ছিল বিরল, এখন সেটা স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।
দ্বিতীয়ত, আমরা এখন দেখছি অনেক ঝুঁকি একসঙ্গে আসছে। যেমন কোনো বছর ঘূর্ণিঝড় আর বর্ষার সময় একসঙ্গে হচ্ছে, আবার কোনো সময় তাপপ্রবাহ আর ঘূর্ণিঝড় একসঙ্গে আসছে। এ ধরনের একসঙ্গে আসা ঝুঁকিগুলো বেশির ভাগ পরিকল্পনায় বিবেচনা করা হয় না, অথচ বাস্তবে এর প্রভাব মোকাবিলা করতে গেলে এগুলো খুব জরুরি।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশের উচিত জলবায়ু পরিবর্তনের কর্মসূচিগুলোকে এখনই ভালোভাবে ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে করা। স্রেফ অতীতের জলবায়ু তথ্যের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের উপকূলে এখন বহু অবকাঠামোতে বিনিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু অনেক অঞ্চল ও জনগোষ্ঠী এখনো ঝুঁকির মধ্যে রয়ে গেছে। যদি আমরা ভবিষ্যতের ঝুঁকির যথাযথ মূল্যায়ন না করি, তাহলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে যাবে। তাই আমি বলছি, দুর্যোগ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তৎপরতা নয়, বরং সামনে আসা চরম বিপদের জন্য আগেভাগেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এটা করতেই হবে যদি দেশটি আগামীর জটিল ও ব্যাপক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সফল হতে চায়।
বাংলাদেশকে এখনই অতীতনির্ভর তথ্যের বাইরে এসে ঝুঁকিভিত্তিক ও ভবিষ্যৎমুখী জলবায়ু পরিকল্পনা নিতে হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার অনুমান, সীমিতসংখ্যক অতীত ঘূর্ণিঝড় এবং অপরিবর্তিত জোয়ারের তথ্যের ওপর নির্ভর করে আগে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আমাদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এই পদ্ধতি এখন আর যথেষ্ট নয়। এটি অত্যন্ত জরুরি বার্তা; অবিলম্বে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত।
বর্তমানে অবকাঠামোগুলোকে মূল্যায়ন করতে হবে গতিশীল ও নানামুখী পরিকল্পনার ভিত্তিতে। এমনভাবে করতে হবে যেন ভবিষ্যতের জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য গতিপথগুলো সেখানে প্রতিফলিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, এতে ঘূর্ণিঝড় ও বর্ষার একসঙ্গে হানা, জোয়ারের তীব্রতা বৃদ্ধি, পানি সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা এবং বিভিন্ন ঝুঁকির ধারাবাহিক প্রভাব বিবেচনায় আনতে হবে। কমজোর পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে বড় পরিসরে বিনিয়োগ করা যাবে না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, অভিযোজন কৌশল অবশ্যই এমন হতে হবে যেন তা দিয়ে সব রকম বিপদ মোকাবিলা করা যায়। এগুলো বাস্তবসম্মত ও গতিশীল হতে হবে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশ এসব নিয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে।
সাই চ্যান্দের র্যাভেলা সিনিয়র রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, এমআইটি