চীনের আগমনে বাংলাদেশের পানিসম্পদ নিয়ে নতুন দৃশ্যপট
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 14-04-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

চীন ও ভারতের সঙ্গে বোঝাপড়া করে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদা পূরণের প্রচেষ্টা এই অঞ্চলের জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির ভারসাম্য রক্ষার কৌশলকেই তুলে ধরে।  

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ২৬-২৯ মার্চ চীনে চার দিনের এক গুরুত্বপূর্ণ সফরে যান। লক্ষণীয় যে এ বছর বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে।  

 

 

প্রধান উপদেষ্টা দ্বিপক্ষীয় সফরের জন্য প্রথমে চীনকেই বেছে নিয়েছেন। তিনি নয়াদিল্লি সফরের প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া পাননি। ১৯৭৫ সাল থেকে চীন বাংলাদেশকে ৭.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে, যা তাকে বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম ঋণদাতা বানিয়েছে।

এই সফর ঢাকার সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্কের জোরালো অবস্থান তুলে ধরে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার নতুন অধ্যায় সূচিত করেছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
চার দিনের এই সফরে বাংলাদেশ ও চীন অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করে।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা–সংক্রান্ত একটি চুক্তি এবং বিনিয়োগ, অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও সাংস্কৃতিক বিনিময়বিষয়ক আটটি সমঝোতা স্মারক। উভয় দেশ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) জোরদার ও চীন-বাংলাদেশ ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারত্ব এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার করে।

চীনের সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশকে অবকাঠামোগত প্রকল্পের জন্য ২.১ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেয়, যা বাংলাদেশের আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরে।

 

পানিসম্পদে বেইজিং-ঢাকা সহযোগিতা

ইউনূসের চীন সফরে বাংলাদেশের পানিসম্পদ খাত ছিল প্রধান আলোচ্য বিষয়গুলোর একটি। এই খাত নানা সমস্যায় জর্জরিত। দেশের বার্ষিক ভূপৃষ্ঠস্থ পানির প্রবাহ প্রায় ১ হাজার ২১০ ঘনকিলোমিটার আর ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্ভরণ ২৮ থেকে ৬৫ ঘন কিলোমিটারের মধ্যে। পানি ব্যবহৃত হয় ৮৬ শতাংশ কৃষির জন্য, ১২ শতাংশ গৃহস্থালির জন্য এবং মাত্র ২ শতাংশ শিল্পক্ষেত্রে।

বাংলাদেশ তার উজানের প্রতিবেশীদের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল। কারণ, দেশের ৯০ শতাংশের বেশি নদী ভারত, মিয়ানমার ও চীন থেকে প্রবাহিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং অনিয়মিত আবহাওয়াজনিত কারণে দেশের পানিব্যবস্থা আরও চাপে পড়েছে। দেশের নিচু ভূপ্রকৃতি, বিস্তৃত বন্যা-ভূমি এবং দীর্ঘ উপকূলরেখা বাংলাদেশকে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।  

তিব্বতে ইয়ারলুং জাংবো গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন

তিব্বতে ইয়ারলুং জাংবো গ্র্যান্ড ক্যানিয়নছবি: এএফপি

পরিস্থিতি গুরুতর। ‘বাংলাদেশের শুকিয়ে যাওয়া নদীসমূহ’ শীর্ষক একটি গবেষণায় নদী ও বদ্বীপ গবেষণাকেন্দ্র (আরডিআরসি) দেখিয়েছে, দেশের সরকারি তালিকাভুক্ত ১ হাজার ১৫৬টি নদীর মধ্যে অন্তত ৭৯টি নদী শুকিয়ে গেছে বা শুকিয়ে যাওয়ার পথে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তিস্তা।

এই গবেষণা বলছে, বাংলাদেশ এককভাবে এ সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। এ জন্য প্রয়োজন উজানের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সহযোগিতা। পূর্বাভাস আরও উদ্বেগজনক। অনুমান করা হয়, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি সাতজন বাংলাদেশির একজন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হতে পারে।

অধ্যাপক ইউনূস চীনের কাছে নদী ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা চান এবং বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনার জন্য ৫০ বছরের একটি দীর্ঘমেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান তৈরির অনুরোধ করেন।

 

অধ্যাপক ইউনূসের বেইজিং সফর চীন-বাংলাদেশ পানি প্রকল্প সহযোগিতায় সম্ভাব্য নৈকট্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর বাস্তব হলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-চীন প্রতিযোগিতার কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হতে পারে।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই সফরের সময় দুই দেশ বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পে (টিআরসিএমপি) চীনের অংশগ্রহণে সম্মত হয়। আগে চীন ও ভারত—উভয়েই প্রকল্পটিতে আগ্রহ দেখিয়েছিল। ২০২০ সালে চীন শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে সহায়তার জন্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল।

২০২৪ সালের জুলাইয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্প ভারতের হাতে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু হাসিনার পতনের পর, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়নার জন্য টিআরসিএমপির মাস্টারপ্ল্যান তৈরির সময়সীমা ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। এর খসড়া ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ প্রস্তুত হওয়ার কথা ছিল। এই পরিবর্তন হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত দেয়।

 

ইয়ারলুং জাংবো-যমুনা নদী ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট

ইউনূসের সফরে আলোচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ইয়ারলুং জাংবো-যমুনা নদীর ওপর বৃহৎ পানি প্রকল্পগুলোর সম্ভাব্য প্রভাব। এই নদী বাংলাদেশ, চীন ও ভারত হয়ে প্রবাহিত। দুই দেশ এই গুরুত্বপূর্ণ নদী বিষয়ে পানিসংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদানের সমঝোতা স্মারকের বাস্তবায়ন পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে সম্মত হয়।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, চীন ইয়ারলুং জাংবো নদীতে ১৩৭ বিলিয়ন ডলারের মেদোগ জলবিদ্যুৎ বাঁধ প্রকল্প অনুমোদন করে। এই নদী ভারত প্রবেশের পর ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত এবং বাংলাদেশে যমুনা নামে প্রবাহিত হয়। চীনের এই প্রকল্প ভারতের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অরুণাচল প্রদেশ ও আসামের জন্য ব্রহ্মপুত্র নদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ এই প্রকল্প নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেনি। তবে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় চীনের কাছে চারটি গুরুত্বপূর্ণ নথি চায়—পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন, সম্ভাব্যতা যাচাই, জলবায়ু প্রভাব বিশ্লেষণ এবং দুর্যোগ প্রভাব বিশ্লেষণ।

এই লেখা লেখার সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ চীন থেকে কোনো জবাব পায়নি। যদিও চীনা কর্মকর্তারা বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছেন যে এটি একটি রান অব দ্য রিভার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হবে এবং এতে পানিপ্রবাহ সরানো হবে না।

ভারতের সঙ্গে পানি সহযোগিতা নিয়ে পথচলা

৫৪টি নদী ভারত ও বাংলাদেশে যৌথভাবে প্রবাহিত হয়। তাই পানি বিষয়ে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল ভারতের ওপর। এই ৫৪টির মধ্যে মাত্র আটটি নদীর জন্য দুই দেশের মধ্যে চুক্তি আছে। গঙ্গার পানি বর্তমানে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় পড়ে। তিস্তা নিয়ে অন্তর্বর্তী চুক্তি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গা পানিচুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালে। চুক্তিটি নবায়নের কথা রয়েছে। যদিও এর শর্ত নির্ভর করবে ভারত-বাংলাদেশ রাজনৈতিক সম্পর্ক ও ভারতের পানি চাহিদার ওপর। ২০২৫ সালের মার্চে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা কলকাতায় অনুষ্ঠিত যুগ্ম কারিগরি কমিটি ও যৌথ নদী কমিশনের ৮৬তম বৈঠকে অংশ নেন।

তিস্তা বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে চতুর্থ বৃহত্তম আন্তসীমান্ত নদী। এটি নিয়ে আলোচনার অচলাবস্থা এখনো কাটেনি। ২০১১ সালে একটি খসড়া চুক্তিতে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল যে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ পানি বাংলাদেশ পাবে, ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ ভারত পাবে এবং বাকি অংশ থাকবে পরিবেশ রক্ষায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে এটি চূড়ান্ত হয়নি। ভারত ও বাংলাদেশ—উভয় সরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজি করানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

অধ্যাপক ইউনূসের বেইজিং সফর চীন-বাংলাদেশ পানি প্রকল্প সহযোগিতায় সম্ভাব্য নৈকট্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর বাস্তব হলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-চীন প্রতিযোগিতার কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হতে পারে। যদিও বাংলাদেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো উন্নয়নে চীনের ভূমিকা বাড়ছে, তবু ভারতের সঙ্গে ফলপ্রসূ সম্পর্ক অপরিহার্য। কারণ, বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী ভারতের দিক থেকেই প্রবাহিত হয়।

অমিত রঞ্জন রিসার্চ ফেলো, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর

জেনেভিয়েভ ডনেলন-মে গবেষক, অক্সফোর্ড গ্লোবাল সোসাইটি
তিংক চায়না থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ

 

শেয়ার করুন