মোঘল আমলের স্থাপত্যকলার আদলে গড়ে তোলা ইমারত বাংলাদেশে খুব একটা চোখে পড়ে না, আবার একেবারেই চোখে পড়ে না তাও বলা যাবে না। যেগুলো আছে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা হয় না বললেই চলে। তার পরেও মানবসমাজের নিত্যকার মূল্যবোধ ও জনরুচির রূপান্তর, জীবনযাত্রাগত পরিবর্তন প্রভৃতি কারণে এ দেশের স্থাপত্যশিল্পের কালানুক্রমিক শোভা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ খুব একটা দেখা যায় না।
আমি ভ্রমণপ্রিয় মানুষ, তাই যখনই কোনো পুরোনো দিনের ইমারতের কথা শুনি, তখনই চেষ্টা করি সময় সুযোগমতো ঘুরে আসতে। কথা হচ্ছিল আমার অফিসের গ্রাহক হেলাল ভাইয়ের সাথে আমাদের মোঘল আমলের স্থাপত্যকলার ইমারত প্রসঙ্গে। হেলাল ভাই আমার কথার রেশ টেনে ধরে বলেন, বাংলাদেশের চৌষট্টি জেলার মধ্যে কেবল সিলেটের ছবিই যদি ফিরে দেখা হয়, দেখা যাবে এক-দেড়দশক আগেও নয়নাভিরাম যে বাড়িগুলো নগরীর আনাচেকানাচে ছিল, সেখানে এখন বহুতল অট্টালিকা। মানিক ভাই বললেন, সিলেটে কয়েকটি ভবন এখন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে; জানান দিচ্ছে আমাদের অতীত ঐতিহ্যের। ঠিক তেমন একটি ভবন সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় অবস্থিত। বর্তমানে যা রিজেন্ট পার্ক রিসোর্ট নামে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। সাথে সাথে ছক করে ফেললাম আসছে সপ্তাহেই যেতে হবে। হাবিব ভাইকে বললাম, আপনাকে আমার সঙ্গী হিসেবে থাকতে হবে। ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৮টা হবে মোবাইল ফোনের ডাকাডাকিতে ঘুম থেকে উঠতেই হলো। ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে নিলাম নতুন গন্তব্য পানে যাব বলে; অপেক্ষা শুধু মানিক ভাইয়ের জন্য। অপেক্ষার প্রহর গোনা সবচেয়ে কঠিন কাজ।
শেষ পর্যন্ত মানিক ভাইয়ের দেখা পেলাম। আমরা চললাম নতুন গন্তব্য পানে। আমাদের চার চাকার গাড়ি চলছে এগিয়ে মহাসড়ক পেরিয়ে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম সেই পুরোনো দিনের রাজবাড়ির কাছে, যা বর্তমানে রিজেন্ট পার্ক রিসোর্ট নামে পরিচিত। পুরোনো আমলের চুনসুরকির দেয়াল দেখেই অনুমেয় হলো আমার চলে এসেছি আমাদের গন্তব্যে।
প্রবেশপথের দরজা খোলা হলো, দেখা পেলাম ধানক্ষেত আর পুকুরের। মানিক ভাই বললেন সদর দরজা আরও সামনে। আমি বললাম এখানেই নেমে যাই, হেঁটে ভেতরে যাই। দূর থেকে দেখতে পেলাম রাজবাড়িতে প্রবেশের সদর দরজা। শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশ; নেই কোনো কোলাহল। গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যদেবের লুকোচুরি খেলা। পুকুরপাড়ে শানবাঁধানো ঘাট। কয়েক জনকে দেখলাম বড়শি দিয়ে মাছ শিকারে ব্যস্ত। আমরা এসে পৌঁছালাম সদর দরজায়। প্রবেশ করলাম জমিদারবাড়িতে। প্রবেশদ্বার পেরিয়ে কিছু দূর যেতেই হাতের ডানে দেখতে পেলাম পূজামণ্ডপ। এখানে দুর্গাপূজা হতো, তবে বর্তমানে এটি রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ খাবারের ঘর হিসেবে ব্যবহার করছেন। হাতের বাঁয়েই দেখা পেলাম ধবধবে সাদা রঙের ভবনের। অসাধারণ কারুকাজ দেখেই বোঝা যায় অতীত ঐতিহ্যের।আমি কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লাম দোতলা ঘরে। প্রতিটি ঘর যেন বহন করছে তার মোঘল আমলের স্থাপত্যকলার। আরেকটু সামনে গিয়ে পেলাম কাঠের দোতলা বাড়ি, যা এখন নেই বললেই চলে। দেখতে পেলাম গাছে আম, লিচু ধরে আছে।
যেভাবে যাবেন
সিলেটের বাইরে থেকে যাঁরা আসবেন, তাঁরা শহর সন্নিকট হওয়ার বেশ আগে, সুরমা নদী পেরোনোর আগে অর্থাৎ দক্ষিণ সুরমায়, আব্দুস সামাদ ই-স্কয়ারে নেমে যাবেন। নেমেই দেখবেন সুবিশাল নর্থ-ইস্ট মেডিকেল কলেজের কম্পাউন্ড চোখে পড়বে। এখান থেকে আপনাকে নর্থ-ইস্ট মেডিকেলের সামনের দিক দিয়ে জলালপুর রোডের গাড়ি ধরতে হবে। শেয়ারের সিএনজিচালিত ট্যাক্সি করে গেলে জনপ্রতি লাগবে ১০ টাকা, টাউনবাসে করে গেলে ৫ টাকা। ট্যাক্সি কিংবা বাস বা রিকশা সবই পাওয়া যায়। ট্যাক্সি রিজার্ভ চুক্তিতে গেলেও স্কয়ার থেকে ৫০-৬০ টাকার বেশি ভাড়া লাগার কথা নয়। সিলাম রিজেন্ট পার্ক রিসোর্ট বললে যেকোনো চালকই ঠিকঠাক রিসোর্ট তোরণে নামিয়ে দেবেন আপনাকে। এই রিসোর্ট থেকে সিলেটের যেখানেই যেতে চাইবেন সহজে এবং অনায়াসেই পারবেন।