করোনাভাইরাসের এই বৈশ্বিক মহামারিতে সারা পৃথিবী থমকে গেছে প্রায়। বানচাল হয়ে গেছে ভ্রমণপিপাসু মানুষের ঘুরে বেড়ানোর সব পরিকল্পনা। এই আবদ্ধ ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে ভ্রমণের স্মৃতিচারণ, ছবি দেখা আর গল্পেই মনকে মানিয়ে নেওয়া। করোনা দেশে বিস্তারের ঠিক কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম সেভেন সিস্টার্সের ক্ষুদ্রতম রাজ্য ত্রিপুরায়। গত পর্বে লিখেছিলাম ত্রিপুরার অন্যতম দর্শনীয় স্থান ঊনকোটি নিয়ে। আজ পাঠকের জন্য থাকছে ত্রিপুরা ভ্রমণের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব ‘মেলাঘর’। আশা করি, এই ঘরবন্দি সময়ে তা কিছুটা হলেও মনের খোরাক মেটাবে।
প্রায় ২০০ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে ঊনকোটি থেকে আগরতলা ফিরে আসলাম। রাতটা শহরে না কাটিয়ে নতুন কোথায় কাটানো যায় ভাবতেই ভাবতেই মেলাঘরের সাগরমহলের কথা মাথায় আসল। যেহেতু আগামীকাল নীরমহল দেখতে মেলাঘর যাওয়ার পরিকল্পনা, তাই আজই পৌঁছাতে পারলে সব দিক থেকেই বেশ ভালো হয়। তবু দূরত্বের কথা চিন্তা করে একটু দ্বিধায় ছিলাম।
ভিনদেশের অপরিচিত এক এলাকায় রাতবিরাতে গিয়ে না আবার থাকার জায়গা নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়! আগরতলার অধিবাসী মনোজ দাকে ফোন দিতেই তিনি আশ্বস্ত করলেন, কীভাবে যেতে হবে জানালেন। পুরো ট্যুরেই আগরতলার এই ভ্রমণপিপাসু মানুষটির আন্তরিকতার কথা না বললেই নয়। একজন পর্যটকের মন তো এমনই উদার হওয়া উচিত। পরিকল্পনা অনুযায়ী ট্রেন থেকে নেমে শহরে আর না ঢুকে সিপাহীজলা মেলাঘরের দিকে রওনা হলাম। অল্প অপেক্ষাতেই বাস পেলাম। আগরতলা থেকে মেলাঘরের দূরত্ব ৫৩ কিলোমিটার, প্রায় দুই ঘণ্টার যাত্রা। জার্নিটা একটু বেশি হলেও রাতে মেলাঘর লেকের পাড়ে বসে চাঁদ দেখার লোভনীয় চিন্তাটা মাথায় ঘুরছিল। পৌঁছাতেই সাড়ে ৭টা বাজল। মেলাঘর বাজারে ঘুরেফিরে একদফা মিষ্টি খেয়ে সাগরমহলের দিকে রওনা হলাম।
মূল সড়ক থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে প্রাকৃতিক লেক রুদ্রসাগরের পাশেই সাগরমহলের অবস্থান। অন্ধকার রাস্তা ধরে হাঁটতে কিছুটা ভয়ই লাগছিল। সরু রাস্তা লেকের কাছে এসে শেষ হলো। জলাভূমির অদূরে টিমটিমে আলোতে দেখা যাচ্ছিল আগরতলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান নীরমহল। স্থানীয় একজনকে পেয়ে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিল সাগরমহলের প্রধান ফটক। আগরতলার সরকারি এই গেস্ট হাউস অবস্থানের কারণে বেশ পরিচিত। এ ছাড়া নানা সময় বাংলাদেশের অনেক নেতা এখানে আত্মগোপনেও ছিলেন বলেও জানা যায়। চারপাশ অন্ধকার দেখেই বুঝতে পারছিলাম আসন্ন বিপদের কথা। গেট ধরে ভেতরে কিছুটা ঢুকে জানতে পারলাম, সাগরমহল গত কয়েক মাস ধরে বন্ধ। এই সংবাদের জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না। যা হোক ভগ্ন হৃদয়ে মেলাঘরে ফিরে এলাম। রাতে থাকার জন্য হোটেলের খোঁজ করতে গিয়ে আরো হতাশ হলাম, যেখন দেখলাম বোর্ডিং টাইপের যে দুটো হোটেল আছে একটাতেও রুম খালি নেই। ভিনদেশের সীমান্তঘেঁষা এই এলাকায় রাতবিরাতে থাকার জায়গার সংকটের কথা চিন্তা করে কিছুটা দুশ্চিন্তাই হচ্ছিল। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে সোনামুড়া বর্ডারের দিকে রওনা হলাম। একটা লোকাল ট্রান্সপোর্ট পেলেও ছাড়তে বেশ দেরিই করল। তবু অল্প সময়েই পৌঁছালাম সোনামুড়া। বর্ডারের পাশেই আমাদের কুমিল্লা জেলা। কুমিল্লার বন্ধুদের মুখে বহুবার এই বর্ডারের নাম শুনেছি, তবু কখনো ভাবিনি এখানে এসেই রাত কাটানোর সুযোগ হবে। এখানকার লোকজন অনেকটা কুমিল্লার টোনে কথা বলে। আগরতলার অনেক জায়গাতেই কুমিল্লা এবং সিলেটের ভাষার টানই কানে আসে বেশি। আসলে ভাষাকে তো আর কাঁটাতার দিয়ে আটকে দেওয়া যায় না। সোনামুড়ার প্রায় সবারই আত্মীয়-স্বজন আছে ওপারে। এদিকে বেশ কিছু মসজিদ-মাদ্রাসা চোখে পড়েছে, যেটা অন্যদিকে চোখে পড়েনি। আবার মন্দিরও আছে অনেক। যতই মিল থাকুক ওপারের সঙ্গে তবু মানচিত্র এখন আলাদা, তাই বাস্তবতাও আলাদা। রাত বাড়ছে বেশ। হোটেল খুঁজে বেশ গলদঘর্ম হয়ে অবশেষে তুলনামূলক একটু খরুচে হলেও ভালো একটা থাকার ব্যবস্থা হলো হোটেল সরোজিনীতে।
বেশ সকালেই উঠলাম সময়টাকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে। আশপাশ ঘুরে দেখলাম। দেখা হলো আমাদের কুমিল্লার দুঃখ গোমতীর এ পাড়ের অংশ। এখনো বেশ প্রাণবন্ত, সতেজ। এই নদীর ওপর একটা ঝুলন্ত ব্রিজও আছে। এমন নদী দেখলে আসলে দেশের নদীগুলোর দুরবস্থার কথা চিন্তা করে কষ্টই বাড়ে কেবল।
হোটেল থেকে নাশতা সেরে অটো নিয়ে রওনা হলাম নীরমহলের উদ্দেশে। অল্প সময়েই পৌঁছালাম রাজঘাট। এখান থেকেই নীরমহলের নৌকা ছেড়ে যায়। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল পানির ওপর ভেসে থাকা নীরমহল। নীরমহল মূলত স্বাধীন ত্রিপুরার শেষ রাজা বীর বিক্রম মাণিক্য বাহাদুরের গ্রীষ্মকালীন প্রমোদভবন। হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণে নির্মিত প্রাসাদটির কাজ শেষ হয় ১৯৩৮ সালে। জলের মধ্যে এমন মহল ত্রিপুরা ছাড়া সমগ্র ভারতে কেবল রাজস্থানেই দেখা যায়।
শিডিউল ইঞ্জিন নৌকার অপেক্ষা না করে ৩৫০ টাকায় রিজার্ভ নৌকা ঠিক করে রওনা হলাম। লেকে পানকৌড়ি ছাড়াও বেশ কিছু পাখির দেখা মিলল। যতই কাছাকাছি যাচ্ছিলাম ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম অসাধারণ এই শুভ্র প্রাসাদ দেখে। দাঁড় টানা নৌকায় আধা ঘণ্টা লাগল পৌঁছাতে। দিনের প্রথম পর্যটক হিসেবে টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। এখানে ক্যামেরার জন্য টিকেটের চাইতেও বেশি চার্জ দিতে হয়।
প্রাসাদটি মূলত অন্দরমহল ও বাহিরমহল দুই ভাগে বিভক্ত। তখনকার সময়ে অন্দরমহল ছিল রাজপরিবারের লোকজনদের জন্য এবং বাহিরমহলে দরবার হল, নাচঘর, খোলা মঞ্চ, সৈন্যদের পাহারা দেওয়ার গম্বুজ, তাদের থাকার জায়গাসহ নানা আয়োজন ছিল। সবমিলিয়ে এখানে মোট কক্ষ আছে ২৪টি। ঘুরে দেখলাম প্রাসাদের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত। নিয়মানুযায়ী ৪০ মিনিটে দেখা শেষ করতে হবে, নয়তো বোটম্যানকে তার জন্য অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হবে। ভাড়াসহ সব রুলস টানিয়েই রাখা আছে নৌকাঘাটে।
যা হোক, বোটম্যানের সঙ্গে গল্প করতে করতেই ফিরতি পথে রওনা হলাম। মেলাঘর পৌঁছে আর দেরি না করে বাসে উঠলাম। গন্তব্য আগরতলা শহর। এ যাত্রায় এখানেই সমাপ্তি। আবার না হয় দেখা হবে অন্য কোথাও।