পশ্চিমবঙ্গে কেন বাংলাদেশ–বিরোধিতা বাড়ছে
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 30-01-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি ছাত্র-শিক্ষক সংগঠন বাংলাদেশে আগস্ট-পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপরে নির্যাতন এবং ভারতে এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে একটি আলোচনাচক্রের আয়োজন করে। আলোচনার আগে তারা একটি প্রশ্ন পাঠায়, যেখানে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ঘৃণা ও বিদ্বেষের যে আবহ তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে ভারতের বুদ্ধিজীবীরা কী ভাবছেন?

প্রশ্ন দেখে অনেকক্ষণ ভাবলাম। তারপরে ধীরে ধীরে আত্মস্থ করলাম, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতে যে বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে ভারত তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গেও কোনো নামকরা বুদ্ধিজীবী মুখ খোলেননি। আলোচনার সময়ে সে কথাই বললাম এবং এ–ও জানালাম যে সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গে তারকা শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম কবীর সুমন, যিনি আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ–বিরোধিতা ও ‘ইসলামোফোবিয়া’র বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে অবস্থান নিয়েছেন।

কেন এমনটা হলো? কেন মাত্র ছয় মাসের মধ্যে যে দেশকে ভারত দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, সম্ভবত গোটা বিশ্বে তার প্রথম ও প্রধান বন্ধু হিসেবে মনে করত, তার বিরুদ্ধে এই সাংঘাতিক প্রচার শুরু করল? প্রশ্নটিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

এর প্রথম ও প্রধান কারণ হলো, ভারতের সমাজে ‘গোলপোস্ট’ অর্থাৎ মৌলিক চরিত্রের পরিবর্তন হয়ে গেছে। খাতা-কলমে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও আসলে আর তা নয়। এর জন্য পুরোপুরি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা বিজেপিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। যেকোনো সংগঠনের মতোই তারাও চেয়েছে তাদের মতাদর্শের প্রচার। তাদের প্রচারের কারণেই হোক বা মানুষের স্বাভাবিক পরিবর্তন–স্পৃহার জন্যই হোক, ভারতের সমাজে একটা মৌলিক পরিবর্তন হয়ে গেছে। একসময় যে ভারতে প্রশ্ন করা হতো একজন ধর্মনিরপেক্ষ, না ধর্মনিরপেক্ষ নয়, আজকে সেখানে প্রশ্ন করা হয় যে একজন হিন্দুত্বে বিশ্বাসী, না অবিশ্বাসী। এটাই ‘গোলপোস্ট’ অর্থাৎ মৌলিক সামাজিক চরিত্রের পরিবর্তন।

ভারতে এখন একটাই ন্যারেটিভ এবং সেটা হিন্দুত্ববাদী। শুধু বিজেপি নয়, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস থেকে মূলস্রোতের রাজনৈতিক দল, যেমন সিপিআইএম (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মাক্সবাদী) বা হয়তো নকশালপন্থীরাও কোনো না কোনোভাবে হিন্দুত্বের দ্বারা প্রভাবিত। এটা ঠিক নির্বাচনে জেতা–হারার প্রশ্ন নয়, সমাজ পরিবর্তনের প্রশ্ন। এটা হিন্দুত্ববাদীরা ভারতে করতে পেরেছেন। এ কারণে, সিপিআইএমকেও শহরের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় ব্যানার লাগাতে হয়, ‘বাংলাদেশ সংখ্যালঘুদের ওপরে নির্যাতন বন্ধ করো’ লিখে।

তৃণমূল কংগ্রেস বা কংগ্রেসকেও ধারাবাহিকভাবে হিন্দুদের ওপরে নির্যাতন বন্ধের দাবিতে পথে নামতে হয়। প্রচারমাধ্যম যখন দেখে, সব দলই বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপরে নির্যাতন বন্ধের কথা বলছে—যেন বাংলাদেশে আর কোনো ইস্যু নেই—তখন তারাও সে কথাই বলে এবং সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তাদের ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে সেটাই লেখে।

কেউ কখনো বলে না—বিশেষত বুদ্ধিজীবীরা—যে আমাদের একটা দল গঠন করে বাংলাদেশে গিয়ে দেখা দরকার, অত্যাচার কি শুধু হিন্দুদের ওপরে হয়েছে, নাকি মুসলমানদের ওপরেও হয়েছে? বা কীভাবে একটা দল ১৬ বছর নির্বাচন না করে ক্ষমতায় থেকে চরম নৈরাজ্যের জন্ম দিল? এসব যে তাদের দেখা বা বোঝা দরকার, সে কথা পশ্চিমবঙ্গের কোনো আবেগতাড়িত বুদ্ধিজীবী এখনো বলেননি। অথচ গত ১৬ বছর ধরে তাঁদের—অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের সংগীতশিল্পী, চিত্র পরিচালক, অভিনেতা থেকে তাবৎ লেখক-কবির—বড় অংশের রোজগার এসেছে বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু এখন তাঁদের একজনও প্রকাশ্যে ব্যাখ্যা করেন না কেন পরিস্থিতি এ জায়গায় পৌঁছাল, দ্বন্দ্ব এমন চরম আকার নিল।

এর নানা কারণ থাকতে পারে। একটা কারণ হতে পারে যে এই বুদ্ধিজীবীরা কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের নানান দাক্ষিণ্য পান, ফলে বড় বিতর্কিত বিষয় নিয়ে মুখ খুলতে ভয় পান। দ্বিতীয়ত, ভারতে একটা ট্র্যাডিশন আছে যে কেউই চট করে পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করেন না। এমনকি মূলস্রোতের রাজনৈতিক দল, যারা কথায় কথায় কেন্দ্রীয় সরকারকে তুলাধোনা করে, তারাও পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে কেন্দ্রের নীতিই অনুসরণ করে, যেমন করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

তৃতীয়ত, ভারতে বরাবরই একটা বাংলাদেশ–বিরোধিতা ছিল। শুধু নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত অতীতে বাংলাদেশকে দেখেছে। এটা গত ১০ বছরে ‘ইসলামোফোবিয়া’ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে। কিন্তু সেটা চেপে রাখা হতো (মাঝেমধ্যে ছাড়া, যখন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশিদের ‘উইপোকা’ বলতেন), কারণ ঢাকায় ভারতের বন্ধু সরকার ছিল। প্রধান রাজনৈতিক দল বিজেপি কখনোই খোলাখুলি আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করত না। করার মতো ইস্যু থাকলেও করত না এবং এর জন্য বিজেপি বা ভারতকে দোষ দেওয়া যায় না।

কারণ, শেখ হাসিনার ভাষাতেই ভারত গত ১৬ বছরে বাংলাদেশের থেকে যা পেয়েছে, তা তাদের মনে রাখার কথা। দিল্লি ও বিজেপি সেটা মনে রেখেছিল, তারা হাসিনা বা বাংলাদেশবিরোধী প্রচারে জড়ায়নি। ভারতের কূটনীতিকদের বক্তব্য, যেকোনো দেশই নিজের স্বার্থ দেখবে, ভারতও দেখেছে। এ কারণেই ভারতে ‘ইসলামোফোবিয়া’ চরমে পৌঁছানোর পরেও একটি মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভারত মুখ খোলেনি।

ভারতে যে ‘ইসলামোফোবিয়া’ মুসলমানসমাজকে ভোগ করতে হয়, এখন বন্ধু সরকার চলে যাওয়ার পরে তার কিয়ংদংশ বাংলাদেশকে করতে হচ্ছে এবং হবে। কোনো রাজনৈতিক দলই সরাসরি এর বিরোধিতা করবে না, কারণ ভারতে রাজনীতির ‘গোলপোস্ট’ পরিবর্তন হয়ে গেছে—সবাই হিন্দু ভোট হারানোর ভয়ে ভীত।

এই ‘ইসলামোফোবিয়া’ বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে আগামী দিনে বাড়বে; কারণ, ২০২৬ সালের গোড়ায় এই রাজ্যে বিধানসভা ভোট আছে। বিজেপির কাছে পশ্চিমবঙ্গে এমন কোনো ইস্যু নেই, যা দিয়ে তারা তৃণমূলকে ঘায়েল করতে পারে। একমাত্র ইস্যু বাংলাদেশ ও সংখ্যালঘু নির্যাতন। এ নিয়ে তারা আরও বেশি করে কথা বলবে, তাতে কেন্দ্রীয় সরকার এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিপদে পড়লে রাজ্য বিজেপির কিছু করার নেই।

তবে উল্লেখযোগ্যভাবে ভারত সরকারের ঘোষিত নীতি হলো বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্কে একটা স্থিতাবস্থা বজায় রাখা। এর প্রধান কারণ চীন। গত ১৫ বছরে চীন দক্ষিণ এশিয়ায় বৃহৎ শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে যে সরকার পাকাপাকিভাবে আসবে, তার সঙ্গে চীন তার সম্পর্ক আরও উন্নত করতে চেষ্টা করবে, বেইজিং ইতিমধ্যে বিবৃতি দিয়ে সেটা জানিয়েছে। ফলে, দিল্লি বুঝে গেছে, অভিমান করে বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকলে ভারতের ছেড়ে দেওয়া জায়গা দখল করবে চীন; যেমন তারা করেছে আফগানিস্তানে, যুক্তরাষ্ট্র পাততাড়ি গোটানোর পরে।

ভারত বোঝে, এটা ২০০১-০৬ সাল নয়, যখন বিএনপি-জামায়াতের সরকারের সঙ্গে কংগ্রেস-বিজেপির সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছিল। এই ২০ বছরে চীনের উত্থানের পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে যে পরিমাণে ব্যবসা বেড়েছে, সেটাও প্রায় অবিশ্বাস্য। সেটাও মাথায় রেখে দুই দেশই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করবে। এ কারণে, বাংলাদেশে যে সরকারই আসুক, ভারতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক স্তরে তার সম্পর্ক অতীতের মতো খারাপ হবে না।

 

শেয়ার করুন