তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম গতকাল বুধবার আক্রান্ত হয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে তাঁর মাথার ওপর পানির বোতল নিক্ষেপ করা হয়। এরপর তিনি ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। এ আক্রমণ গ্রহণযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা জরুরি।
সম্প্রতি ফেসবুকে মাহফুজ আলমের এক পোস্টকে ঘিরে নানা রকম বাদানুবাদ চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে জীবননাশের হুমকিও দেওয়া হয়েছে। গতকালের ঘটনা প্রমাণ করছে, মাহফুজ আলম টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। অনেকের ধারণা পাবলিক পরিসরে তাঁর জীবনঝুঁকি বাড়ছে।
মাহফুজ আলমকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। তাঁকে ক্লেদের ভান্ডার বানানো হচ্ছে। মাহফুজ আলম গণ-অভ্যুত্থানের একজন অগ্রগামী চিন্তক। জুলাই–পরবর্তী সময়ে তিনিসহ আরও অনেকে ‘অন্তর্ভুক্তি’র কথা বলছেন। বিভিন্ন মত ও পথ মিলিয়ে অভিন্ন নিশানা নির্মাণ করতে চান। তাঁর এ চিন্তা ও প্রকাশ মূলত তাঁকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। অনেকে তাঁকে গ্রহণ করতে পারছেন না।
যদিও অন্তর্ভুক্তি বা সমন্বয়বাদী চিন্তা নতুন কিছু নয়। অনেক গুণীজন এ বিষয়ে কাজ করেছেন। ক্ষীতিমোহন সেনের ভারতে হিন্দু-মুসলমানদের যুক্ত সাধনা, ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিমের বাঙলার মুসলমানদের সামাজিক ইতিহাস বা মমতাজুর রহমান তরফদারের বাংলার ধর্ম ও ধর্মজীবন বইয়ে এ যূথবদ্ধ জীবনের সন্ধান ও সামাজিক জীবনের সখ্যের স্বাদ পাওয়া যায়।
এ ধারায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো অসীম রায়ের দ্য ইসলামিক সিনক্রেটিস্টিক ট্র্যাডিশন ইন বেঙ্গল। বাঙালির সমন্বয়বাদী চিন্তা বুঝতে এগুলো আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। সমন্বয় ছাড়া অন্তর্ভুক্তি সম্ভব নয়। বাঙালি রক্তে সংকর, চেতনায় যৌগিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে’ কবিতায় লিখেছেন—‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন/শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন’।
বাঙালির চিন্তার ইতিহাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মানুষ। একসময় এ অঞ্চলের মানুষ পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা ও যূথবদ্ধ জীবনের বাসিন্দা ছিলেন। এতে পেরেক ঠুকেছে ব্রিটিশ। ধর্মের নামে বিভক্তি মনুষ্যত্ববোধকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি বসবাসের যোগ্যতা হারিয়েছে। ঘৃণা, আর পারস্পরিক অশ্রদ্ধার চাষ চলেছে। হাজারও অদেখা দেয়াল নির্মিত হয়েছে। অচলায়তন ভিত শক্ত হয়েছে।
কাজের কথা হলো, সমন্বয়বাদী বা অন্তর্ভুক্তিমূলক চিন্তার বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ অনেকাংশে এগিয়ে আছে, যা কেবল রাজনৈতিকভাবে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ব্যাপার। এ জন্য দরকার দূঢ় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও অঙ্গীকার। এ অঙ্গীকারের অনুপস্থিতি ছিল দীর্ঘকাল। জুলাই গণ–অভ্যুত্থান এক আশাজাগানিয়া ব্যাপার। এ আন্দোলনে সর্বজনের অংশগ্রহণ ছিল। মূল বিষয় ছিল বৈষম্যহীন বাংলাদেশ। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম পরে সেখানে যুক্ত করেছেন ‘অন্তর্ভুক্তি’ পদবাচ্যটি।
সম্প্রতি তিনি বলছেন, সবার জন্য দেশ। তাঁর এ প্রস্তাবনায় রাষ্ট্র বোঝার আধুনিক মনোভঙ্গি পাওয়া যায়। রাষ্ট্র মানুষের এক বড় সৃষ্টি। রাষ্ট্র যে সবার, সেই স্পষ্টতাও খুব জরুরি; আরও জরুরি রাষ্ট্র একটি পার্থিব বা ইহজাতিক প্রতিষ্ঠান, তা বোঝা।
রাষ্ট্র এজমালি সম্পত্তি। এর ওপর কোনো দল, মত বা আদর্শের পোশাক পরানো অন্যায্য। এ জন্য মাহফুজ আলম বাইনারি ভাঙতে চেয়েছেন—বাম-ডান, ধর্মনিরপেক্ষতা-ধর্মপ্রবণতা, বাঙালি-বাংলাদেশি। একাত্তর ও চব্বিশের চেতনা ও আকাঙ্ক্ষার মিশেলে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির পাটাতন স্থির করতে চান।
এনসিপি যেন মেঘনা নদীর মোহনা, এখানে অনেকগুলো স্রোত, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি এসে মিশেছে। এনসিপির কাছ থেকে রাষ্ট্র বিনির্মাণে গণপরিষদ নির্বাচন, সংবিধান পুনর্লিখন, বিচার ও নির্বাচন—এই দাবিগুলো মোটাদাগে অগ্রগণ্য। জুলাই ঘোষণাপত্রের কথা অনেক দিন ধরে শোনা যাচ্ছে। সঙ্গে আছে সংস্কার এজেন্ডা। কিন্তু কেন জানি মানুষ কোনো কিছু নিয়ে স্পষ্ট হতে পারছে না, আস্থা পাচ্ছে না। সংশয় ও সন্দেহ যেন কাটছেই না।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ সমাজের পরতে পরতে গড়ে উঠেছে, আদর্শিক ও মতাদর্শিক বিভক্তি, যা ইট-সিমেন্টের মতোই শক্ত। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র বিনির্মাণে একদল বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রতিশ্রুতিশীল সঙ্গী পাওয়া সহজ কাজ নয়। ফলে মনে হতে পারে মাহফুজ আলমের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা, বোঝাপড়া ও রাজনৈতিক দর্শন তাঁকে নিঃসঙ্গতার দিকে নিয়ে যাবে, তিনি হয়তো সংকটে পড়বেন।
এর পেছনে রয়েছে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আদর্শকেন্দ্রিক অনড় ও অনমনীয় বিশ্বাস। তথাকথিত আদর্শভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের বোধ। এমন সমাজ কেবল বড় আদর্শ বা সংখ্যা দেখে নয়, ছোট আদর্শ ও সংখ্যা দেখেও ভয় পায়। ছোট সংখ্যা বড়দের মধ্যে নানা ধরনের অস্বস্তি তৈরি করে। বড়রা এভাবে ছোটদের দ্বারা তাড়িত হচ্ছে। এ বড়করণ প্রক্রিয়ার নাম প্রান্তিকীকরণ।
আরেকটি প্রবণতা হলো আলাদাকরণ। আওয়ামী, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি, ডান-বাম, সমতল-পাহাড়, হিন্দু-মুসলিম। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক সূচকগুলো বিবেচনায় নিয়ে এ সমাজে আলাদাকরণ প্রক্রিয়া তীব্রতর হয়েছে। এ আলাদাকরণ আজ বাস্তবতা। এই প্রান্তিকীকরণ ও আলাদাকরণের মূলে পেরেক ঠুকতে চান মাহফুজ আলম। তাঁর এ আকাঙ্ক্ষা খুব স্পষ্ট হয় মূলত ‘অন্তর্ভুক্তি’র ব্যাকরণে।
কিন্তু মাহফুজ আলমের এ সচেতন পছন্দ আবার সংশয় জাগায় আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধকরণে তাঁর অবস্থান দেখে। নিষিদ্ধকরণ কোনো ভালো পদক্ষেপ নয়। উন্নত আদর্শ দিয়ে মন্দ আদর্শকে পরাজিত করতে হবে। আওয়ামী লীগ কেবল নেতাসর্বস্ব রাজনৈতিক দল নয়, এর রয়েছে কয়েক কোটি সমর্থক। একজন কৃষক, একজন শ্রমিক, মুটে-মজুরের রাজনৈতিক পছন্দ নিষিদ্ধকরণের অধিকার কে রাখেন?
ডেনমার্কের রাস্কিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যানঞ্জেলা কে. বুনো তাঁর ডেমোক্রেটিক ডিলিমাস: হোয়াই ডেমোক্রেসিস ব্যান পলিটিক্যাল পার্টিজ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা একটি উদ্বেগজনক কাজ। এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠিত হওয়া এবং বহুত্ববাদ ও সহনশীল ধারণার সঙ্গে সংঘাত তৈরি করে। যাঁরা অপরাধ করেছেন, তাঁদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু নির্বিচারে বন্ধ নয়। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের ওপর জাতিসংঘ প্রণীত প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করার ব্যাপারে সুপারিশ করা হয়েছিল।
আপাত মনে হতে পারে, মাহফুজ আলমের সতীর্থ ও সহযোগীরা অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি বুকে ধারণ করেন। কিন্তু তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত টানা অত সহজ নয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক দর্শন ধারণ করছে, সেই প্রশ্ন উঠছে। যমুনার সামনে ও শাহবাগে সম্প্রতি সমাবেশে অংশগ্রহণকারীর ধরন ও স্লোগান সেই প্রশ্ন জোরালো করে তুলছে।