রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার সবচেয়ে দুর্গম ইউনিয়ন ফারুয়া। জেলা শহর কিংবা বিলাইছড়ি উপজেলা সদর থেকে যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন নৌ–পথ। জেলা থেকে শহর ফারুয়ায় পৌঁছাতে সময় লাগে কমপক্ষে ৭–৮ ঘণ্টা, শুষ্ক মৌসুমে নৌপথে চলাচল সে তো এক দূরূহ ব্যাপার। গত বছরের ১৩ এপ্রিল রাতে বৈশাখী উৎসবের দিন বাড়িতে যাওয়ার পথে পাঁচ যুবকের সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় এক আদিবাসী কিশোরী। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, পরবর্তীতে ধর্ষণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালের ভয়ভীতি দেখিয়ে নানাভাবে ব্ল্যাকমেইলিং করে পাঁচ যুবক।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, মেডিকেল রিপোর্টসহ সংশ্লিষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অর্থাভাব ও হুমকিতে ভয়ে আইনের আশ্রয় নিতে পারেননি ওই কিশোরী। তবে নিরূপায় হয়ে শেষমেষ আসেন জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে। ঘটনার সাড়ে ৪ মাস পর ৩০ আগস্ট লিগ্যাল এইডের সহায়তায় রাঙামাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। সেই পাঁচ আসামির দুজন বর্তমানে কারাগারে আছেন; বাকি তিনজন রয়েছে পলাতক। জেলার কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নের কর্ণফুলী কলেজ গেইট এলাকার বাসিন্দা মঞ্জুমা খাতুন শিল্পী। কন্যা সন্তান নিয়ে থাকেন বাবার বাড়িতে। কিন্তু সাত বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র ভাই আমির হোসেন বোনদের পৈত্রিক সম্পত্তি দিতে নারাজ। সেই মঞ্জুমাও আশ্রিত হলেন জেলা লিগ্যাল এইডে। বর্তমানে তার এই অভিযোগ আমলে নিয়ে আমির হোসেনকে সশরীরে ডেকেছে লিগ্যাল এইড অফিস। মঞ্জুমার দাবি, ভুয়া দলিল দেখিয়ে পৈত্রিক সম্পত্তিতে তাদের বঞ্চিত করতে চান তার আপন ভাই।
রাঙামাটি সদর উপজেলার বাসিন্দা আমির আলী। জেলা শহরের রেডিও সেন্টার এলাকার বিপরীতে তার ৫০ শতক জমি রয়েছে। ২০২২ সালে পার্শ্ববর্তী আজগর আলীসহ চার প্রতিবেশী তার বিরুদ্ধে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে চারটি অভিযোগ করেন। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে সাতবার সরেজমিন ও ছয়বার বিরোধপূর্ণ ভূমির পরিমাপ করে লিগ্যাল এইড। এছাড়া প্রতিপক্ষের কাছ থেকে নানা হুমকিও পেয়েছেন তিনি। অবশেষে চলতি বছর লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে এই মামলার সুরাহা হয়। বর্তমানে প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে পরিবার নিয়ে স্বাচ্ছন্দে বসবাস করছেন আমির আলী।
সদর উপজেলার রাঙাপানি মৌজার মৃত আহাম্মদ কবীরের স্ত্রী ছালমা বেগম (৭৩)। তিন ছেলে পৈত্রিক ভিটা বিক্রি করে দিয়ে থাকছে অন্যত্র। বৃদ্ধা মায়ের খোঁজ নেয় না কেউই। অবশেষে তিনিও হলেন আদালতের দ্বারস্ত। পিতা–মাতার ভরণপোষণে আইনে মামলা করেছেন তিন ছেলের বিরুদ্ধে। গত বছরের ২৩ অক্টোবর রাঙামাটির জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে মামলাটি রেকর্ডভুক্ত হয়। আদালত মামলা আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে সমন জারি করেছেন। লিগ্যাল এইড অফিস প্যানেল আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে ছালমা বেগমের অধিকারের জন্য লড়ছেন।
কেবল বিলাইছড়ির কিশোরী, সদর উপজেলার ছালমা, আমির কিংবা কাপ্তাইয়ের মঞ্জুমা খাতুনই নয়; জেলার অসহায় ও দরিদ্র মানুষের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠেছে জেলা লিগ্যাল এইড অফিস। স্বল্প সময়ে বিচার পেয়ে সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন সেবাগ্রহীতারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীদের সেবা প্রদান করে থাকে। মূলত ২০১৫ সালে রাঙামাটিতে লিগ্যাল এইড অফিস চালু হলেও বিচারিক সংকটে আবেদন গ্রহণ ও মামলা নিষ্পত্তি হয়নি সেভাবে। ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো শেখ মোহাম্মদ বদিউল আলম নামের একজন বিচারক যোগদান করেন। এরপর ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর দ্বিতীয় বিচারক হিসাবে যোগদান করেন সিনিয়র সহকারী জজ মো. জুনাইদ।
জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাঙামাটি লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে ১ হাজার ২০৫টি আবেদন জমা পড়ে। তারমধ্যে ১ হাজার ৯৫টি আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। বিরোধ আপসের ফলে ১ কোটি ২২ লাখ ৪ হাজার ৯৪ টাকা টাকা আদায় হয়েছে। এছাড়া ৪২০টি দেওয়ানি, ফৌজদারি ও পারিবারিক মামলা মীমাংসা হয়েছে। মামলা মীমাংসার হার ৩৮.৩৭ শতাংশ। আইনি পরামর্শ পেয়েছেন ১ হাজার ১৭৫ জন এবং আদালতে বিচারাধীন ১০১টি আপসে মীমাংসার ফলে প্রত্যাহার হয়েছে। এছাড়া জেলার দশ উপজেলার মধ্যে ১০টি উপজেলা ও ২৮টি ইউনিয়নে লিগ্যাল কমিটি গঠন ও সক্রিয় করা হয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ১৬টি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া কারাবন্দিদের সঙ্গে বৈঠক অন্যতম। রাঙামাটি লিগ্যাল এইড অফিসের অন্যতম উদ্যোগ হলো বিরোধপূর্ণ জমিতে গিয়ে মীমাংসা বৈঠক। এটি সারাদেশের প্রথম ধাপে রাঙামাটিতেই শুরু হয়েছে। পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি জেলায়ও এই কার্যক্রম চলছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ অঞ্চল হওয়ায় এ কার্যক্রমের আওতায় ১৪৫টি অধিক বিরোধপূর্ণ জমিতে গিয়ে মীমাংসা বৈঠক করা হয়েছে।
লিগ্যাল এইডের প্যানেল আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালিমা ওয়াহিদা জেনী জানান, লিগ্যাল এইড রাঙামাটির দরিদ্র ও অসহায়বিচারপ্রার্থীদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। এই সার্ভিসের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ পারিবারিক বিরোধ, জমিজমার বিরোধ নিষ্পত্তিসহ নানান সুফল ভোগী হচ্ছেন। আমরা লিগ্যাল এইডের প্যানেল আইনজীবী হিসাবে এই সেবা দিয়ে যাচ্ছি। গত বছর থেকে রাঙামাটি লিগ্যাল এইড অফিসের কার্যক্রমে ব্যাপক সাফল্য এসেছে। এতে বিচারপ্রার্থী জনগণ যেমন উপকৃত হচ্ছেন, তেমনি কমছে মামলা জট। তবে আরও কয়েকজন জনবল পেলে লিগ্যাল এইড অফিসের কার্যক্রম আরও ত্বরান্বিত হবে। রাঙামাটিতে লিগ্যাল এইডের কার্যক্রম এভাবে চলমান থাকলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে দেশের প্রথম পজিশনে আসবে রাঙামাটি লিগ্যাল এইড অফিস।
জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, রাঙামাটিতে লিগ্যাল এইডের কার্যক্রম দৃষ্টান্তমূলক। জনসাধারণের আপসে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এর চেয়ে বিকল্প আর নেই। লিগ্যাল এইডের সেবা পেয়ে মানুষকে ছোটখাটো বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আদালতের দ্বারস্ত হতে হচ্ছে না। আমি বলব মামলা নিষ্পত্তি, আপসে মীমাংসার জন্য এটা সরকারের অনন্য উদ্যোগ। বিরোধপূর্ণ জমিতে সরেজমিন পরিদর্শনের মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা আরও সহজতর হচ্ছে।
রাঙামাটি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ মো. জুনাইদ বলেন, ২০১৫ সাল থেকে রাঙামাটি লিগ্যাল এইডের কার্যক্রম শুরু হয়। আর্থিক সংকটে কারও মামলা চালানোর সক্ষমতা না থাকলে সেক্ষেত্রে আমরা মানুষকে বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা দিয়ে থাকি।.