রাঙ্গামাটির ভয়াবহ পাহাড় ধসের মর্মান্তিক ঘটনার ছয় বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১৭ সালের ১৩ জুনের রাতে টানা তিনদিনের ভারী বৃষ্টি আর বজ্রপাতে রাঙ্গামাটিতে ঘটে যায় স্মরণ কালের পাহাড় ধসের ঘটনা। ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনায় ৫ জন সেনা সদস্যসহ নারী পুরুষ ও শিশুসহ ১২০ জনের প্রাণহানী ঘটে। এর মধ্যে শহরের মানিকছড়িতে একটি সেনা ক্যাম্পের নিচে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম প্রধান সড়কের উপর ধসে পড়া মাটি অপসারণ করতে গিয়ে পুনরায় পাহাড় ধসের মাটি চাপা পড়ে নিহত হন ঐ ক্যাম্পের দুই কর্মকর্তাসহ ৫ সেনা সদস্য।
রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মানিকছড়ি শালবাগান অংশে ১০০ মিটার রাস্তা সম্পূর্ণ ধসে গিয়ে দীর্ঘ ৯দিন সারা দেশের সাথে রাঙ্গামাটির সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। বছর ঘুরে দিনটি ফিরে এলে রাঙ্গামাটিবাসীর মনে দেখা দেয় আতঙ্কের সেই ভয়াল স্মৃতি। আর এই ঘটনার ছয় বছর পরও এবার বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ায় ভারীবৃষ্টির আগাম সতর্কতায় সে আশংকায় সকলকে ভাবাচ্ছে।
নিহত সেনা সদস্যরা হলেনÑমেজর মোহাম্মদ মাহফুজুল হক, ক্যাপ্টেন মো. তানভীর সালাম শান্ত, করপোরাল মোহাম্মদ আজিজুল হক, সৈনিক মো. শাহিন আলম, ও সৈনিক মো. আজিজুর রহমান।
জেলা প্রশাসনের হিসাবে রাঙ্গামাটি সদরে ৬৬ জন, জুরাছড়ি উপজেলায় ৬জন, বিলাইছড়ি উপজেলায় ২জন, কাপ্তাই উপজেলায় ১৮জন এবং কাউখালী উপজেলায় ২১ জন মিলে মোট ১১৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে শিশু-৩৩, মহিলা-৩২, পুরুষ ৪৮ জনের মরদেহ পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে অন্য যে কোন পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালের ১৩ জুনের পাহাড় ধসের ঘটনা সেরকম ছিলনা। রাঙ্গামাটি ব্যাপক প্রানহানীর সাথে ব্যাপক ভৌত অবকাঠামো ভীষনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাহাড়ে ঘরবাড়ী আছে এমন পাহাড়ও যেমন ভেঙ্গেছে, তেমনী ঘরবাড়ী ছিলনা এমন অসংখ্য পাহাড়ও ভেঙ্গে পড়ে। আবার ঝোপ জঙ্গল গাছপালাতে ভরপুর এমন পাহাড়ও ভেঙ্গে পড়ে। এক কথায় সব রকম পাহাড়েই মাটি ধস ধসে পড়ে। এটার ব্যাপ্তি, বিস্তৃতিও গভীরতা অনেক বেশী ছিল।
টানা তিনদিনের প্রবল বর্ষনে পাহাড় ধসে রাঙ্গামাটির এত লোকের প্রাণহানি, ঘরবাড়ি, সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুতের এতবড় ক্ষতি হবে সেদিন কেউ ভাবতে পারেনি। সেদিন মুহূর্তেই সব দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল পর্যটন শহর রাঙ্গামাটি।
১৩ জুন রাত থেকেই শুরু হয়েছিল প্রচন্ড গগনবিদারী আওয়াজে বজ্রপাতসহ ভারি বৃষ্টি। ভয়ে আতংকে সেই রাত কাটাতে হয়েছিলো রাঙ্গামাটির মানুষকে। ভোর হওয়ার পর রাঙ্গামাটি শহরের ভেদভেদী, মোনতলা, রাঙ্গাপানি, শিমুলতলি, মুসলিম পাড়া ও লোকনাথ মন্দির এলাকা, সদর উপজেলার মগবান ও সাপছড়ি ইউনিয়নসহ ৫টি উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির খবর আসতে থাকে। সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল ১৩ জুন রাঙ্গামাটিতে। আর কোন দুর্যোগে রাঙ্গামাটিতে এতো প্রাণহানী ঘটেনি।
পাহাড় ধসে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের শালবন এলাকায় ১০০ মিটার রাস্তা ধসে গিয়ে একেবারে বিলীন হয়ে যায়। দেশের অন্যান্য স্থানের সাথে রাঙ্গামাটি ৯দিন সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। বিভিন্ন আন্ত সড়কে ১৪৫টি স্থানে সড়কে ভাঙ্গন দেখা দেয়। পাহাড় ধ্বসের বিপর্যয়ে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক ছাড়াও রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক, রাঙ্গামাটি-বড়ইছড়ি ও রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিছিন্ন হয়ে যায়।
এছাড়া রাঙ্গামাটির বৈদ্যুতিক গ্রীড লাইনের পোল ও লাইনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে রাঙ্গামাটি শহরের ৩ দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে। সেনাবাহিনী ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীদের দ্রুত প্রচেষ্টায় তিন দিনের মাথায় বিদ্যুৎ ও দশ দিনের মধ্যে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রামে সড়ক যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করা সম্ভব হয়। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় কাপ্তাই-রাঙ্গামাটি নৌ পথে লঞ্চ দিয়ে পানি, জ্বালানী তেল ও পন্য পরিবহনসহ লোকজনের চলাচলের ব্যবস্থা গ্রহন করে প্রশাসন।
গৃহ হারা হয়ে রাঙ্গামাটির ১২টি আশ্রয় কেন্দ্রে ২ হাজারের বেশী মানুষ আশ্রয় নেয়। সেনাবাহিনী আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে পানি ও খাবার সরবরাহ করে।
২০১৭ সালে রাঙ্গামাটির ভয়াল পাহাড় ধ্বসের ঘটনার ছয় বছর পার হলেও এখনো অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। পাহড়ের মৃত্যুরকূপের নীচে মানুষের বসবাস কমেনি বরং আগের চেয়ে বেড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো আজও বাস করছেন পাহাড়ের গায়ে। প্রতি বছরের মতো বর্ষার শুরুতেই এবারো জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহরে ও উপজেল গুলোতে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষদের বৃষ্টির সময় নিরাপদে সড়ে যেতে ও আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য ব্যাপক প্রচারণা ও সচেতনতা চালিয়ে যাচ্ছেন। শহরের বেশকিছু স্থানে পাহাড়ের পাদদেশে আবারো অসংখ্য বাড়ি-ঘর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তারা চায় সরকারের পক্ষ থেকে স্থায়ী পূর্ণবাসন।
দিনটির কথা স্মরণ করে এ বছরও রাঙ্গামাটি জেলায় প্রাণহানি এড়াতে আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে বলে জানিয়েছে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানু রহমান। তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে রাঙ্গামাটি শহরের ৩৩টি স্থানকে ঝুকিপূর্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ২৯টির অধিক আশ্রয় কেন্দ্র। তবে ভারী বৃষ্টিপাত হলে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে বসবাসকারীদের আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যেতে চাইলে তারা অনিহা প্রকাশ করে। তখন আমাকে ফোর্স করতে হয় বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে দিতে হয়। তবে পাহাড়ের নিচে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের স্থায়ী পূর্ণবাসনের ব্যাপারে উর্ধতন মহলকে বলা হয়েছে। সরকারও চাচ্ছে যারা পাহাড়ের নিচে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে তাদের তালিকা করে স্থায়ী পূর্ণবাসন যাতে করা যায়।
২০১৭ সালের ১৩ জুনের পাহাড় ধস রাঙ্গামাটির ভূ-পৃষ্টতলকে (সারফেস) নাড়িয়ে দিয়ে অত্যন্ত নাজুক করেছে যা গত ছয় বছরেও কাটিয়ে উঠা যায়নি। যে কারণে রাঙ্গামাটির অনেক সরকারী বেসরকারী স্থাপনা, মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তা দোকানপাটসহ সবকিছু অনিরাপদ করে দেয়। রাঙ্গামাটিতে দৃশ্য ও অদৃশ্য অনেক বেশি ক্ষতি করে দিয়ে যায় সেই স্মরণ কালের পাহাড় ধসের এ ঘটনা।
পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ন অবস্থায় বসবাসকারীদের বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টিপাতের সময় অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হলে পাহাড় ধসের প্রাণহানি রোধ করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।