যদি টপ অর্ডার ও রকম ভেঙে না পড়ত, যদি আরও ৩০-৪০টা রান করা যেত, যদি শারীরিক ও মানসিকভাবে নিজেদের আরেকটু উজ্জীবিত রাখা যেত…।
এ রকম কিছু অপ্রাপ্তির আফসোস নিয়েই কাল রাতে দুবাই ছেড়েছে বাংলাদেশ দল। আজ আপনি যখন এই প্রতিবেদন পড়ছেন, তারা তখন নতুন দেশের নতুন শহরে নতুন দিনে প্রবেশ করে গেছে।
দুবাইয়ে বাংলাদেশের একটিই ম্যাচ ছিল। বাংলাদেশ আবার আলোঝলমলে এই শহরে খেলতে আসতে পারে কেবল ভারতকে নিয়ে ফাইনালে উঠতে পারলে। গ্রুপে নিজেদের বাকি দুটি ম্যাচই পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে। ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড, ২৭ ফেব্রুয়ারি স্বাগতিক পাকিস্তান।
দুবাইয়ে ভারতের কাছে ৬ উইকেটে হেরেছে বাংলাদেশরয়টার্স
এরপর যদি বাংলাদেশ শেষ চারে চলেও যায়, ৫ মার্চ লাহোরে হবে সেমিফাইনাল। তাতে জিতলে, ওদিকে ভারতও যদি ফাইনালে ওঠে, তাহলেই কেবল ৯ মার্চের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচের আগে আবার দুবাইয়ে আসার সুযোগ হবে বাংলাদেশের। নইলে লাহোরে ফাইনাল, অথবা তার আগেই দুবাই বিমানবন্দর ছুঁয়ে উড়ে চলে যেতে হবে দেশে।
হাসছেন? ভারতের কাছে হার দিয়ে টুর্নামেন্ট শুরুর পরদিন কি না বাংলাদেশেরই ফাইনালে ওঠার পথরেখা তুলে ধরা হচ্ছে! কিন্তু কী করা, বিশ্বাসটা যে এখনো দলের মধ্যেই আছে!
গ্রুপ ‘এ’-তে এখন পর্যন্ত হওয়া দুই ম্যাচে দুই জয়ী দলের নাম নিউজিল্যান্ড ও ভারত। বাংলাদেশ এবং গ্রুপের অন্য দলগুলোরও পরের ম্যাচগুলোর ফলাফল বাংলাদেশের দিকে এলে সম্ভাবনার দুয়ার খুলেও তো যেতে পারে।
ভারতের কাছে ৬ উইকেটে হারের পরও দলের আবহ থেকে সে রকম কিছুর বিশ্বাস হারিয়ে যায়নি। অঙ্কের হিসাবে তো বটেই, তাদের মনও বলছে, টুর্নামেন্টটা এখনো বাংলাদেশের জন্য ‘ওপেন।’ তা ছাড়া মাংসপেশিতে টান পড়া তাওহিদ হৃদয় সুস্থ হয়ে গেছেন। চোটের কারণে প্রথম ম্যাচে না খেলা মাহমুদউল্লাহর স্ক্যান রিপোর্টও ভালো। এখন শুধু সেরে ওঠার অপেক্ষা।
তাওহিদ হৃদয় ও জাকের আলীর মহাকাব্যিক জুটি পরশু বাংলাদেশের মান বাঁচিয়েছেএএফপি
তো সম্ভাবনার উন্মুক্ত দরজা দিয়ে ঢুকতে কী করতে হবে, পরশু ভারত ম্যাচের পর দুবাইয়ে সেই চর্চা হয়েছে। প্রথম দাবিটা টপ অর্ডারের কাছে। তোমরা ভালো শুরু করো, বড় ইনিংস খেলো, বড় জুটি গড়ো। দ্বিতীয় দাবি যারা ভালো শুরু পাবে, তাদের কাছে। খেলাটা মাঝপথে ছেড়ে এসো না। অন্যদের জন্য কাজ বাকি না রেখে নিজে শেষ করে আসো, শেষ দেখে আসো। সবাই সব দিন ভালো খেলবে না। তুমি যেদিন ভালো খেলবে, বুঝে নেবে আজ দায়িত্বটা তোমার।
কোচ ফিল সিমন্স কড়া মানুষ না হলেও দলের কাছে কী চান, সেই বার্তা পরিষ্কারভাবেই দিয়েছেন। সহকারী কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন আবার নরম করে কথা বলতে কমই পারেন, বাজে খেলে হারের দিনে যেটা ভালো গুণ হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনিও নিজের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ভারত ম্যাচের ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে বলেছেন, পাকিস্তানে এসব ভুলের বোঝা বয়ে নিয়ে যাওয়া চলবে না।
নিজের সেরা দিনে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার উদাহরণ হিসেবে আহত শরীর নিয়ে সেঞ্চুরি করা হৃদয়ের নাম আসছে। আবার কাজ শেষ করে না আসার উদাহরণ হিসেবে নীরবে উঠেছে জাকের আলীর নাম। আর ওপরের দিকের ব্যর্থ ব্যাটসম্যানদের সারি তো বেশ লম্বাই।
দুবাইয়ে শুরুতেই ভয়াবহ ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়েছিল বাংলাদেশরয়টার্স
ও হ্যাঁ, দলে আরেকটা আলোচনাও হয়েছে। শরীরী ভাষায় হাল ছেড়ে দেওয়ার লক্ষণ যেন ফুটে না ওঠে। এ ক্ষেত্রে ভারত ম্যাচ শেষে বলা হৃদয়ের কথাটা মনে রাখার মতো। তাঁর কাছে ২২৮ রানকেও লড়াইয়ের পুঁজি মনে হয়েছিল জানাতে গিয়ে হৃদয় বলেছেন, ‘আমরা ক্রিকেটার। যত রানই করি না কেন, সেটা নিয়েই জেতার চেষ্টা করতে হবে।’
খুবই ইতিবাচক মানসিকতার পরিচয় বলতে হয়। তবে সমস্যা হলো রাওয়ালপিন্ডির উইকেটে ‘যত রানই করি না কেন’ জাতীয় মনস্তাত্ত্বিক ফর্মুলা কোনো কাজে আসবে বলে মনে হয় না। ওখানে জয়ের জন্য বড় রানই শেষ কথা। পাকিস্তানের ভেন্যুগুলোর মধ্যে রাওয়ালপিন্ডি স্টেডিয়ামের উইকেটকে বলা হয় অন্যতম সেরা ব্যাটিং উইকেট।
গত বছর আগস্টে টেস্ট সিরিজ খেলতে গিয়ে বাংলাদেশও দেখে এসেছে সেই বাস্তবতা। টেস্ট দুটি বাংলাদেশ জিতেছেও, কিন্তু ওয়ানডে ক্রিকেটের হিসাব-নিকাশ ভিন্ন। এখানে একবার ভুল করে বসলে দ্বিতীয় ইনিংস নেই যে নতুন করে শুরু করবেন। আগে ব্যাট করলে চোখের সামনে ৩৫০ ভাসাতে হবে। পরে ব্যাট করলে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে সে রকম বা তার চেয়েও বড় কিছু কিছু তাড়া করার জন্য।
পিন্ডি স্টেডিয়ামে সর্বশেষ ওয়ানডে হয়েছে আজ থেকে প্রায় দুই বছর আগে, ২০২৩ সালে এপ্রিলে। মজার ব্যাপার হলো ওই সিরিজটাও খেলেছে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের অবশিষ্ট দুই প্রতিপক্ষ পাকিস্তান আর নিউজিল্যান্ড। দুই ম্যাচের প্রথমটিতে নিউজিল্যান্ড ২৮৮ রান করেও পারেনি হার এড়াতে। পরের ম্যাচে তারা করল আরও বেশি—৩৩৬ রান। তবু এই ম্যাচেও জয়ী দলের নাম পাকিস্তান।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফির গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের শেষ দুই ম্যাচ রাওয়ালপিন্ডি স্টেডিয়ামেপিসিবি
বুঝতেই পারছেন পিন্ডি স্টেডিয়াম কী নিয়ে অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশের জন্য। তবে গত বছরের টেস্ট সিরিজের সুখকর অভিজ্ঞতার কারণে পিন্ডির উইকেট অন্তত খেলা শুরুর আগে বাংলাদেশের জন্য অস্বস্তিকর কিছু নয়। বাংলাদেশের এখানে বড় রান করার সামর্থ্য প্রমাণিত। এখন শুধু ভিন্ন সংস্করণের ক্রিকেটেও তা করে দেখাতে হবে, যার জন্য সবার আগে প্রয়োজন সামর্থ্যের প্রয়োগ। যেটা দুবাইয়ের উইকেটে করে দেখানো যায়নি।
দুবাইয়ে রান করা একটু কঠিন ছিল বলেছেন হৃদয়, বিশেষ করে স্পিন বলের বিপরীতে। ভারতের ব্যাটিংয়ের সময়ও সে রকমই মনে হয়েছে। ২২৮ রান তাড়া করে জিততে তারাও খেলেছে ৪৭ ওভার পর্যন্ত। এ ধরনের উইকেট থেকে রান বের করতে ব্যাটিংয়ে যে উদ্ভাবনী সামর্থ্য থাকা দরকার, সেটা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে হয়তো আছে, কিন্তু প্রয়োজনের সময় তার ব্যবহার কমই দেখা যায়।
রাওয়ালপিন্ডিতেও সে রকম কিছু ঘটে গেলে বিপদ। দেখা গেল ইতিহাস বাংলাদেশের পক্ষে, উইকেটে রানবন্যার আলামত; কিন্তু ব্যাটসম্যানদের ব্যাটে বল লাগছে না! উইকেট বুঝে ওঠার আগেই নড়ে গেল টপ অর্ডার কিংবা থিতু হওয়া ব্যাটসম্যান হঠাৎ ভুল শটে গোল বাধালেন।
সমর্থকেরা এখনো বাংলাদেশের সেমিফাইনালে খেলার আশায় বুক বাঁধতে পারেনরয়টার্স
না, এত নেতিবাচক ভাবার দরকার নেই। চ্যাম্পিয়ন হতে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে এসে বাংলাদেশ দল তো এখনো বিশ্বাস করছেই যে, তাদের জন্য দরজা খোলা। সেই বিশ্বাসে আস্থা রেখেই বরং শুরু হোক নতুন শহরের নতুন দিন।