দুর্দান্ত বোলিং করে টেস্টে ১৩তম বারের মতো ৫ উইকেট নিলেন। টেস্ট ক্রিকেটে নিজের ২০০তম উইকেটও পেলেন এই ইনিংসে। এরপর কী দুর্দান্ত ব্যাটিংটাও করলেন!
ভুল শুধরে দিতে চাচ্ছেন? তাইজুল ইসলাম তো আজ ব্যাটিং করেছেন বোলিংয়ের আগে! ৩১ বলে ১৬ রান—এমন দুর্দান্ত কিছুও নয়। তাহলে কীর্তিময় বোলিংয়ের সঙ্গে ব্যাটিংয়ের গুণগান আসে কোত্থেকে!
এই ব্যাটিং তাইজুল আসলে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের উইকেটে করেননি, করেছেন মিরপুর টেস্টের প্রথম দিন শেষে সংবাদ সম্মেলনকক্ষে। প্রশ্নগুলো যদিওবা তাঁকে কেউ প্রতিপক্ষ হিসেবে করেননি, তবু তাইজুলের মনে হতেই পারে, প্রশ্নের আড়ালে তাঁর দিকে ধেয়ে আসছিল অদৃশ্য সব গতিময় বল। কাজেই চালাও ব্যাট!
আমাদের দেশে অনেক কিছুই মুখে মুখে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, খারাপ খেলে ট্রল হতে হতেই অনেকে তারকা হয়ে গেছে। আবার অনেকে ভালো খেলেও তারকা হতে পারেনি। আমি এটা মেনে নিয়েছি (হাসি)।
সংবাদ সম্মেলনে তাইজুল ইসলাম
যেহেতু তিনিও একজন বাঁহাতি স্পিনার, বরাবরই তাইজুলের সংবাদ সম্মেলনে করা প্রশ্নগুলোতে ভর করে থাকে দলে তাঁর অগ্রজ বাঁহাতি স্পিনার সাকিব আল হাসান প্রসঙ্গ। আজও প্রায় প্রতিটি প্রশ্নে তাইজুলের নামের সঙ্গে উচ্চারিত হলো সাকিবের নাম। সাকিবের প্রতি কোনো অশ্রদ্ধা থেকে নয়, তবে সব উপলক্ষেই তাঁর পাদপ্রদীপের আলোয় সাকিবকে টেনে আনায় বিরক্ত তো হতেই পারেন তাইজুল। কিন্তু বিরক্তিটা প্রকাশ না করে প্রতিটি প্রশ্নে তাইজুল এমন প্রাণবন্ত কাটা কাটা উত্তর দিলেন যে একেকবার তাঁর কথা শুনে সবাই হেসেই খুন!
উইকেট নেওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা তাইজুলশামসুল হক
সাকিবের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রসঙ্গে যেমন একটু ঘুর পথে গিয়ে তাইজুল বললেন, ‘সাকিব ভাই ছাড়া যে আমি খেলি নাই, তা তো না! উনি থাকা পর্যন্তও অনেক ম্যাচে আমি সাকিব ভাই ছাড়া খেলেছি। আমরা যখন নিউজিল্যান্ডে টেস্ট জিতেছি, সাকিব ভাই ছিল না। যখন নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে আমাদের এখানে টেস্ট জিতেছি, তখন সাকিব ভাই ছিল না। অনেক উদাহরণ আছে। আসলে আপনি তো একটা খেলোয়াড়কে ৫০ বছর খেলাতে পারবেন না। একজন আসবে, একজন যাবে।’
তাইজুলের হয়ে কথাটা পরিসংখ্যানও বলে। সাকিবের অভিষেকের পর সাকিব খেলেননি, এমন টেস্টে বাংলাদেশের বোলারদের ইনিংসে ৫ উইকেট আছে ১২টি। এর মধ্যে তাইজুলেরই ৯টি, এক টেস্টে ১০ উইকেট আছে ২বার। অন্য তিনটি ৫ উইকেট মিরাজ, নাঈম ও ইবাদতের। সাকিবকে (৫৪ টেস্ট) পেছনে ফেলে টেস্টে বাংলাদেশের হয়ে দ্রুততম ২০০ উইকেটও এখন তাইজুলের (৪৮ টেস্ট)।
কিন্তু তাইজুল তো তবু ছায়াতেই পড়ে থাকেন! এত অর্জনের পরও তারকাদ্যুতিটা ছড়ায়নি সেভাবে। এখানেও অবশ্য তাইজুলের নিজস্ব একটা ভাবনা আছে, যেটা এ নিয়ে তার মনে কোনো আক্ষেপকেই প্রশ্রয় দেয় না। কথাটা শুনুন তাঁর মুখেই, ‘আমাদের দেশে অনেক কিছুই মুখে মুখে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, খারাপ খেলে ট্রল হতে হতেই অনেকে তারকা হয়ে গেছে। আবার অনেকে ভালো খেলেও তারকা হতে পারেনি। আমি এটা মেনে নিয়েছি (হাসি)।’
দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিংকে আজ ভুগিয়েছেন তাইজুলশামসুল হক
আসলে যে যা–ই ভাবুন, তাইজুলের ভালো খেলতে পারার আনন্দ কোনো কিছুতে একবিন্দু কমে না। কারণ, খেলেন তো তিনি নিজে! তাইজুলের সহজ-সরল ভাষায় কথাটা এ রকম, ‘সাকিব ভাই থাকলেও আমি সাকিব ভাইয়ের কারণে উইকেট পাই, সাকিব ভাই না থাকলেও সাকিব ভাইয়ের কারণে উইকেট পাই। বিষয়টা এ রকম। কিন্তু খেলি তো আমি!’
সাকিবের ছায়াতলে পড়ে থাকা সময়েও তাই এই ভেবে তাইজুলের কখনো আফসোস হয়নি যে, ‘আমার আলোটা তো কেউ দেখল না!’ নিজেকে বঞ্চিত ভাবেন কি না, এমন প্রশ্নে হেসে উঠে পাল্টা বলেন, ‘প্রশ্নটা কেমন জানি হয়ে গেল…।’ তারপর ব্যাখ্যা, ‘বঞ্চিতের এখানে কিছু নেই। বিশ্বের অনেক বড় বড় খেলোয়াড়ের উদাহরণ আছে। যখন মুরালিধরন ছিল, ওই সময় কিন্তু রঙ্গনা হেরাথ খেলতে পারেনি। হেরাথ যখন খেলতে পেরেছে, তখন অনেক উইকেট পেয়েছে এবং লম্বা সময় খেলেছে। আমিও দেখি সামনে ভালো কিছু হয় নাকি।’
মূল পার্থক্য, আমি অনেক লম্বা সময় ধরে বল করতে পারি। আমি ১৫-২০ ওভার টানা বোলিং করতে পারব।
সাকিবের সঙ্গে নিজের পার্থক্য নিয়ে তাইজুল ইসলাম
আজকের ৫ উইকেটসহ টেস্টে ২০০ উইকেট পেয়ে তাইজুল যেমন তৃপ্ত, তৃপ্ত এখন পর্যন্ত নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার নিয়েও। ১০ বছরের ক্যারিয়ারে যে পরিমাণ ম্যাচ খেলা উচিত ছিল, সে পরিমাণ খেলতে পারেননি মেনেও বলেছেন, ‘ক্যারিয়ার যে খুব খারাপ আছে, তা বলব না। আলহামদুলিল্লাহ, ক্যারিয়ার খুব ভালো আছে।’ নিজ দলেই সাকিব, মুশফিক, তামিম, মাহমুদউল্লাহর মতো বড় বড় খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলেছেন। তাঁদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছেন। এসবও অর্জনের খাতায় লিখে রেখেছেন তাইজুল।
সংবাদ সম্মেলনটা যেহেতু সাকিবময়ই হয়ে উঠেছিল, শেষটাও করা যাক সাকিবকে রেখেই। একজন বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে সাকিবের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য কী? তাইজুল উত্তরটা দিলেন একটা জায়গায় নিজেকে এগিয়ে রেখেই, ‘মূল পার্থক্য, আমি অনেক লম্বা সময় ধরে বল করতে পারি। আমি ১৫-২০ ওভার টানা বোলিং করতে পারব।’
প্রথম দিনের খেলা শেষে মাঠ ছাড়ার সময় সামনে থাকলেন তাইজুলশামসুল
৩৫০-৪০০ উইকেট নিয়ে টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ করার ইচ্ছা তাইজুলের। এর মধ্যে ২০০ উইকেট তো হয়ে গেছেই। আরও বছর পাঁচেক খেললে নিশ্চয়ই লক্ষ্যটা পূরণ হয়ে যাবে। এমন আশাবাদে তাইজুল নিজেই বাস্তবতা মনে করিয়ে দেন, ‘আগে দেখতে হবে ৫ বছরে আমাদের কয়টা টেস্ট আছে। এটা আগে হিসাব করব, তারপর বুঝতে পারব। টেস্ট যদি থাকে ১০টা, তাহলে তো কঠিন (হাসি)।’
বোলার তাইজুলকে সাকিব আসলে কখনোই আড়ালে রাখতে পারেননি। তিনি আড়াল হতেন সাকিবের তারকাদ্যুতির কারণে। এখন আর সেটি নেই বলেই কি সংবাদ সম্মেলনে এমন জ্বলে উঠলেন তাইজুল!