হামজায় ভর করে এশিয়া কাপের টিকিট পাবে কি বাংলাদেশ
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 27-03-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

‘ভিনি, ভিসি, ভিডি’। বাংলা অর্থ করলে—এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। প্রাচীন রোমান প্রবাদবাক্যটা হামজা চৌধুরীর ক্ষেত্রে ঠিক খাটল না। একদম শেষ মুহূর্তে এসে সবটা ভন্ডুল হয়ে গেছে। জয় না করতে পারলেও বাংলাদেশ হারেনি। আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, হামজার অসাধারণ পারফরম্যান্স হারতে দেয়নি বাংলাদেশকে। ভারতের জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামের ১৫ হাজার দর্শকের সামনে হামজার পারফরম্যান্স আশাহত করেনি কাউকে। বরং গত এক সপ্তাহ ধরে হামজাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখছিল বাংলাদেশ, তার থেকেও অনেক বেশি দিয়েছেন হামজা।

হামজাকে নিয়ে শুরু থেকেই বেশ আশাবাদী ছিল বাংলাদেশ। থাকবে নাই বা কেন? বিশ্বের সেরা লিগ থেকে আসা খেলোয়াড়, লেস্টার সিটির মতো দলে যাঁর বেড়ে ওঠা, অধিনায়কত্ব থেকে শুরু করে ফাইনাল জেতা; সব অভিজ্ঞতাই তাঁর পকেটে। সেখানে হামজাকে নিয়ে সন্দেহ করার কোনো অবকাশই ছিল না দেশের মানুষের। ভয়টা ছিল অন্যখানে। হামজা বেড়ে উঠেছেন বিশ্বের সেরা ফ্যাসিলিটিতে। তাঁর ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল পুরো বিশ্বের নামীদামি টেকনিশিয়ানরা। ফিজিও থেকে শুরু করে সতীর্থ; সবাই ছিলেন ওয়ার্ল্ড ক্লাস। সেখানে বাংলাদেশের মতো ভঙ্গুর ইনফাস্ট্রাচারের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া চাট্টিখানি কথা না। বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের সঙ্গে কতটা মানিয়ে নিতে পারেন, কীভাবে নিজের সেরাটা মাঠে দিতে পারেন, হামজাকে নিয়ে সব সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সেটাই।

 

হামজাকে নিয়ে শুরু থেকেই বেশ আশাবাদী ছিল বাংলাদেশ। থাকবে নাই বা কেন? বিশ্বের সেরা লিগ থেকে আসা খেলোয়াড়, লেস্টার সিটির মতো দলে যাঁর বেড়ে ওঠা, অধিনায়কত্ব থেকে শুরু করে ফাইনাল জেতা; সব অভিজ্ঞতাই তাঁর পকেটে।

দুর্দান্ত হামজার কাছে একপ্রকার বন্দি হয়ে ছিল ভারতের আক্রমণভাগ

দুর্দান্ত হামজার কাছে একপ্রকার বন্দি হয়ে ছিল ভারতের আক্রমণভাগছবি: এক্স

শুরুর সেকেন্ডেই যেন সব চিন্তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন হামজা। লম্বা বল বাড়ালেন সামনে। কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে না পৌঁছালেও গোলকিপারের ভুলে সে বল চলে গেল মুজিবুর রহমান জনির পায়ে। পায়ে তুলে দেওয়া সেই সুযোগ মিস না করলে হয়তো ১৫ সেকেন্ডের মাথায়ই এগিয়ে যেতে পারত বাংলাদেশ। এর পর থেকে পুরো ৯০ মিনিট হামজা নিজের জাত চিনিয়ে গেছেন। মাঠের বাকি ২১ জন খেলোয়াড় থেকে তাঁর লেভেলটা ঠিক কতটা ওপরে, তা বোঝা গেছে প্রতিটি মুহূর্তে। যেমন ক্ষিপ্র গতি, তেমনই পজিশনিং সেন্স। শুধু নিজের নয়, সতীর্থ খেলোয়াড়দের বুঝিয়ে দিয়েছেন কোথায় দাঁড়াতে হবে, কোথায় গেলে তাঁ বল বানিয়ে দিতে সুবিধা হবে। মাঠে হয়ে উঠেছিলেন আর্মব্যান্ডবিহীন এক অধিনায়ক। অবসর ভেঙে ভারতের জার্সি গায়ে চড়ানো সুনীল ছেত্রীকে একপ্রকার বন্দি করে রেখেছেন নিজের পকেটে। কর্নার থেকে সুনীলের দুর্দান্ত হেড থামিয়ে দিয়েছেন কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপ ছাড়াই। অথচ এক ইঞ্চি এদিক–সেদিক হলে হতে পারত গোল, নতুবা পেনাল্টি। অভিষেকে হামজা ছিলেন এতটাই নির্ভার। বাংলাদেশের জার্সিতে এমন হামজাকেই তো দরকার। এত ভালো পারফরম্যান্সের পরও একটা কিন্তু থেকে যায়।

সৌদি আরবে বাংলাদেশ দলের সঙ্গী ছিলেন ইতালিপ্রবাসী ফাহামিদুল ইসলাম (জার্সি নং ২৯)

সৌদি আরবে বাংলাদেশ দলের সঙ্গী ছিলেন ইতালিপ্রবাসী ফাহামিদুল ইসলাম (জার্সি নং ২৯)ছবি: এক্স

কিন্তুটা হামজাকে নিয়ে নয়। বরং তাঁর আশপাশের খেলোয়াড়দের নিয়ে। ভারত ম্যাচকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ দলে ডাক পেয়েছিলেন দুজন বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়। হামজা চৌধুরীর সঙ্গী ছিলেন ইতালিয়ান চতুর্থ ডিভিশনের খেলোয়াড় ফাহামিদুল ইসলাম। সৌদি আরবে ক্যাম্প, অতঃপর প্রস্তুতি ম্যাচ; দুটোতেই ভালো পারফরম্যান্সের পর কেন ভারত সফরে তাঁর নাম আসেনি, সে নিয়ে মুখ খোলেনি কোচ কিংবা দল কেউই। এ তো গেল ম্যাচের আগের কথা। ভারত ম্যাচের আগে সবচেয়ে বেশি উন্মাদনা ছিল দলের মাঝমাঠ নিয়ে। অধিনায়ক জামাল ভুঁইয়া, হামজা চৌধুরী আর কাজেম শাহর জুটি দেখার জন্য মুখিয়ে ছিল বাংলাদেশ। অথচ ম্যাচের চার ঘণ্টা আগে চোটের কারণে ছিটকে গেলেন কাজেম শাহ। একাদশ দিতেই দেখা গেল সেখানে নেই অধিনায়ক জামাল। মাঝমাঠের দুই তুরুপের তাসকে ম্যাচ শুরুর দুই ঘণ্টা আগে হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। ফলে তপু বর্মণকে অধিনায়ক করে মাঠে নামে টাইগাররা। সেই তপু বর্মণও চোট নিয়ে মাঠ ছাড়েন ১৫ মিনিটের মাথায়। এ ছাড়া ট্যাকটিকসের দোহাই দিয়ে মূল একাদশে ছিলেন না ইসা ফয়সাল ও আল আমিন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সেরা দলটা মাঠে খেলার সুযোগই পায়নি। এ তো গেল মাঠের বাইরের কথা।

 

ভারত ম্যাচের আগে সবচেয়ে বেশি উন্মাদনা ছিল দলের মাঝমাঠ নিয়ে। অধিনায়ক জামাল ভুঁইয়া, হামজা চৌধুরী আর কাজেম শাহর জুটি দেখার জন্য মুখিয়ে ছিল বাংলাদেশ। অথচ ম্যাচের চার ঘণ্টা আগে চোটের কারণে ছিটকে গেলেন কাজেম শাহ।

মাঠের ভেতরেও যে পারফরম্যান্স খুব একটা ভালো ছিল তা নয়। র‍্যাংকিংয়ে যোজন–যোজন সামনে থাকা দলের বিপক্ষে ড্র বরাবরই সুখবর; কিন্তু যে পরিমাণ সহজ সুযোগ হাতছাড়া করেছে বাংলাদেশ, এতে করে আফসোস হওয়ারই কথা। বিশেষ করে গোলকিপারকে ফাঁকা পেয়ে যেভাবে সুবর্ণ সুযোগ মিস করেছেন জনি ও হৃদয়, তা দেখে যে কেউ মাথার চুল ছিঁড়তে বাধ্য। বড় ম্যাচে সুযোগ বলেকয়ে আসে না। কালেভদ্রে আসা এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হয়। বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে সেখানেই। বিশেষ করে এত এত মিস করার পরও বাংলাদেশের কোচ হাভিয়ের কাবরেরা ভরসা রাখতে পারেননি আল আমিনের ওপর। এই মৌসুমে বিপিএলের সেরা স্ট্রাইকার বেঞ্চে বসে মাথা ঠুকরেছেন। বরং মাঠে নেমেছেন সোহেল রানা, চন্দন রয় ও ফয়সাল ফাহিমরা। যাঁরা পুরো মৌসুমে বলার মতো কোনো পারফর্মই করতে পারেননি।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোচ হাভিয়ের কাবরেরার অভিজ্ঞতা বেশ কম

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোচ হাভিয়ের কাবরেরার অভিজ্ঞতা বেশ কমছবি: এক্স

বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে ভয়টা এখানেই। যোগ্য খেলোয়াড়েরা যেমন সুযোগ পাচ্ছেন না, তেমনি যোগ্য খেলোয়াড়দের ব্যবহার করতে যে পরিমাণ রিসোর্স দরকার, সেটাই বাংলাদেশের হাতে নেই। বিশেষ করে স্প্যানিশ কোচ হাভিয়ের কাবরেরা, খেলোয়াড় হিসেবে নেই কোনো অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশে যোগ দেওয়ার আগে লা লিগার দেপোর্তিভো আলাভেস যুবদলের কোচ ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের দীর্ঘ সময় ধরে থাকা কোচও তিনি। কিন্তু হামজা চৌধুরী কিংবা নতুন আসা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়দের নিয়ে কতটা কাজ করতে পারবেন সে সংশয় থেকেই যায়। হামজার পথ ধরে সামিত সোম, সুলিভান ব্রাদার্স থেকে শুরু করে আরও বেশ কিছু নাম আগ্রহী হয়েছে বাংলাদেশের হয়ে নাম লেখানোর জন্য। তাঁদের আকৃষ্ট করতে বড় একটা ফলাফল বেশ জরুরি। কাবরেরা তা কতটা সামাল দিতে পারবেন, তার উত্তর দেবে সময়।

তবে বাংলাদেশের জন্য এই ড্র শাপেবর বটে। এশিয়া কাপ কোয়ালিফায়ারে বাংলাদেশ আছে ‘গ্রুপ সি’তে। ভারতের সঙ্গে এই গ্রুপে আরও আছে সিঙ্গাপুর ও হংকং। গ্রুপের শীর্ষে থাকলেই মিলবে ২০২৭ এশিয়ান কাপের টিকিট। গ্রুপের প্রথম দুই ম্যাচই হয়েছে ড্র। ফলে এখনো চার দলই আছে সমতায়। সিঙ্গাপুর ও হংকং র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে আছে ভারতের থেকে। কাগজে–কলমে গ্রুপের সবচেয়ে কঠিন ম্যাচ থেকে এক পয়েন্ট ছিনিয়ে এনেছে বাংলাদেশ। সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের বিপক্ষে এমন পারফর্ম করলে সহজেই তিন পয়েন্ট ছিনিয়ে আনা সম্ভব হবে টাইগারদের। ফলে এশিয়ার সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্টে যাওয়ার রাস্তাটা এখনো বেঁচে আছে বাংলাদেশের। দরকার শুধু সঠিক পরিকল্পনা আর সেই পরিকল্পনা মাঠে কাজে লাগানো।

শেয়ার করুন