নিত্যপণ্যের দাম কমাতে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। কমানো হয়েছিল শুল্ক–কর। কিন্তু এক মাসে আমদানি তেমন একটা বাড়েনি।
অবশ্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানির অনুমতি দেওয়া ও শুল্ক–কর কমানোর একটি সুফল হলো, বাজার স্থিতিশীল হয়েছে। দু–একটি পণ্যের দাম কিছুটা কমেছেও। কিন্তু ভোক্তারা বলছেন, বাজার এখনো চড়া। কিছু ক্ষেত্রে দাম বেড়েছেও।
সরকার শুল্ক–কর তুলে নিয়ে প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে।
কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র জানিয়েছে, আমদানি হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার টন চাল। এদিকে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এক মাসে ঢাকার বাজারে মোটা চালের সর্বনিম্ন
দাম প্রতি কেজি দুই টাকা কমেছে। অন্যদিকে মাঝারি ও সরু চালের দাম প্রতি কেজি তিন থেকে চার টাকা বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাল আমদানি কম হওয়ার কারণ, রপ্তানিকারক দেশে দাম বেশি এবং দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। দুই বছরে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। ফলে শুল্ক কমিয়েও চাল আমদানি লাভজনক হচ্ছে না।
চাল আমদানির অনুমতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানের একটি চট্টগ্রামের আফসানা ট্রেডিং। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ও চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম প্রথম আলোকে বলেন, আমদানিতে প্রতি কেজি ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৫৫ টাকার মতো। কিন্তু বাজারে মোটা চালের দাম ৫২ থেকে ৫৩ টাকা। আমদানি করলে বাজারে দাম পাওয়া যাবে কি না, সে চিন্তায় আগ্রহ কম দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমদানির সুযোগ করে দেওয়ায় চালের বাজার অস্থিতিশীল হচ্ছে না। তবে আমদানির অনুমতির সময়সীমা বাড়াতে হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন অর্ন্তবর্তী দাম কমাতে কিছু উদ্যোগ নেয়। এর একটি হলো শুল্ক–কর কমানো। গত মাসের মাঝামাঝি থেকে নিত্যপণ্যের শুল্ক–কর কমানো শুরু হয়। কমানো হয়েছে চাল, ডিম, সয়াবিন তেল, পাম তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আলু ও খেজুরের শুল্ক–কর। বছরে এসব পণ্য থেকে সাড়ে ৮-১০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পায় সরকার। বাজার–বিশ্লেষকেরা বলছেন, দাম কমাতে হলে সরবরাহ বাড়াতে হবে। শুধু শুল্ক–কর কমালে হবে না। সরবরাহ বাড়লেই দাম কমার আশা থাকে।
দেশে গত অক্টোবরে ডিমের দাম ডজনপ্রতি ১৭০-১৮০ টাকা হয়েছিল। গত ১৭ অক্টোবর ডিম আমদানিতে শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই শুল্কছাড়ের সুবিধা থাকবে। পাশাপাশি এখন পর্যন্ত ৫৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি পান ব্যবসায়ীরা। তবে এনবিআরের হিসাবে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত ডিম আমদানি হয়েছে মাত্র ১০ লাখ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২২ অক্টোবর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এক প্রজ্ঞাপনে ডিম আমদানিতে দেশেও পরীক্ষার শর্ত আরোপ করে, যা আগে ছিল না। এই শর্ত পূরণ করতে হলে বন্দরে ডিম আসার পর তার নমুনা নিয়ে ঢাকার সাভারে আসতে হয়। সেখানে পরীক্ষা করার পর সনদ জমা দিয়ে ডিম খালাস করতে হয়। এতে চার-পাঁচ দিন লেগে যায়। তত দিন বন্দরে ট্রাকভাড়া দিতে হয়। ডিম নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। এসব কারণে আমদানিতে আগ্রহ হারিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে বাজারে ডিমের দাম কিছুটা কমেছে। বাজারভেদে এখন ডিমের ডজন (১২টি) ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা। অবশ্য ২০২২ সালের মার্চে মূল্যবৃদ্ধি শুরুর আগে ডিমের ডজন সাধারণত ৯০ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে থাকত।
ডিম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের হাইড্রোল্যান্ড সলিউশনের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আমদানির অনুমতি দেওয়ায় ডিমের দাম কমেছে। বন্দরে ডিম পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হলে আমদানি বাড়বে। দেশের মানুষ আরও কম দামে ডিম পাবে।
সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে দুই দফায় শুল্ক–কর কমানো হয়েছে। প্রথম দফায় ১৭ অক্টোবর ও দ্বিতীয় দফায় ১৯ নভেম্বর শুল্ক–কর কমিয়ে তা নামানো হয়েছে শুধু ৫ শতাংশে। তাতে প্রতি কেজি অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলে শুল্ক–কর ১৭-১৮ থেকে কমে ৭ টাকায় নেমেছে। অর্থাৎ প্রতি কেজি শুল্ক–কর কমেছে ১০-১১ টাকা।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসে গত শনিবার পর্যন্ত ২৩ দিনে চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যাংক টার্মিনাল থেকে মোট ৬৫ হাজার টন সয়াবিন ও পাম তেল খালাস করেছেন ব্যবসায়ীরা। আরও ৪৫ হাজার টন তেল নিয়ে চারটি জাহাজ এসেছে। সাধারণত প্রতি মাসে ভোজ্যতেলের চাহিদা পৌনে দুই লাখ টন।
জানতে চাইলে ভোজ্যতেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তি। তবে শুল্ক–কর কমানোর কারণে এই বাড়তি দাম সমন্বয় হয়ে গেছে। যদি শুল্ক–কর না কমানো হতো তাহলে লিটারপ্রতি ১৩-১৪ টাকা দাম বাড়ত। এত দিন অনিশ্চয়তার কারণে আমদানি কম হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন শুল্ক–কর কমানোর কারণে সামনে সরবরাহ বাড়বে।
চিনি আমদানিতেও সরকার শুল্ক–কর কমিয়েছে। আগে প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে ৩৮-৪০ টাকা শুল্ক–কর দিতে হতো। এখন দিতে হচ্ছে প্রতি কেজি ২৩ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজি শুল্ক–কর কমেছে প্রায় ১৫-১৭ টাকা।
শুল্ক–কর কমানোর পর তিনটি প্রতিষ্ঠান চিনি আমদানি করেছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই), সিটি গ্রুপ ও আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি। গত মাসের ১৭ অক্টোবরের পর শনিবার পর্যন্ত চিনি আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৮১ হাজার টন। এর মধ্যে বাজারজাত হয়েছে ৫০ হাজার টন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চিনি আমদানি পরিস্থিতি সন্তোষজনক।
টিসিবির হিসাবে বাজারে এখনো খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১২৫ টাকা দরে। এক মাস আগে ছিল ১৩০ টাকা। অর্থাৎ শুল্কছাড়ের সুবিধা আংশিক পাচ্ছেন ভোক্তারা।
সরকার গত ৫ সেপ্টেম্বর আলু আমদানিতে শুল্ক–করে ছাড় দেয়। আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এই ছাড় রয়েছে। তবে শুল্কছাড়ের পর এখন পর্যন্ত আলু আমদানি হয়েছে ৪০ হাজার টন। মাসিক চাহিদা আট লাখ টনের বেশি। ফলে আমদানি করা সামান্য আলু বাজারে বড় প্রভাব ফেলছে না।
টিসিবির হিসাবে এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে প্রতি কেজি আলুর দাম ১০ টাকা বেড়েছে। এখন প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা দরে।
পেঁয়াজের চাহিদার অন্তত ৩০ শতাংশ পূরণ করা হয় আমদানি করে। বছরের শেষ দিকে আমদানি বাড়ে। কারণ, তখন দেশীয় পেঁয়াজের সরবরাহ কমে যায়। পেঁয়াজ আমদানি বাড়াতে গত সেপ্টেম্বরে ও নভেম্বরে শুল্ক–কর কমায় সরকার। এনবিআরের হিসাবে গত এক মাসে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৭৭ হাজার টনের কিছু বেশি। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৬১ হাজান টন।
বাজারে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমেছে। এক সপ্তাহ আগে দেশি ও আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ছিল প্রতি কেজি ৯০ থেকে ১৫০ টাকা। এখন তা ৮০ থেকে ১৩০ টাকা হয়েছে।
শুল্ক–কর কমানোর পদক্ষেপ তখনই কাজে দেয়, যখন সরবরাহ বাড়ে। কিন্তু আমদানিকারকেরা মুনাফা না হওয়ার আশঙ্কা থাকলে আমদানি করেন না। খন্দকার
গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি
আগামী মার্চে পবিত্র রমজান মাস শুরু হবে। রোজার পণ্য আমদানির জন্য ব্যবসায়ীরা দুই-তিন মাস আগে থেকে উদ্যোগ নেন। এ হিসাবে আগামী মাস থেকে নিত্যপণ্যের ঋণপত্র খোলার প্রক্রিয়া শুরু করবেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকও নিত্যপণ্য আমদানিতে ঋণপত্রের শর্ত শিথিল করেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখনই আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ না নিলে রোজায় সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকতে পারে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, শুল্ক–কর কমানোর পদক্ষেপ তখনই কাজে দেয়, যখন সরবরাহ বাড়ে। কিন্তু আমদানিকারকেরা মুনাফা না হওয়ার আশঙ্কা থাকলে আমদানি করেন না। তিনি বলেন, বাজারে আমদানিকারক যখন গুটিকয়েক হন, তখন আমদানি ও মূল্য তাঁদের মর্জির ওপর নির্ভর করে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, বাজারে সরবরাহকারী বৃদ্ধির জন্য আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার। ব্যবসায়ীদের নিবন্ধন প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার রক্ষায় সচেতনতা জরুরি। এসব কাজ সময়সাপেক্ষ। তবে শুরুটা এখন করা দরকার।