কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বাকশিমূল ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের ওপর দিয়ে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ। বাকশিমূল গ্রাম থেকে কালিকাপুর হয়ে গাজিপুর বাজার সড়কটি গেছে রেলপথের ওপর দিয়েই। ফলে সড়কটি দিয়ে চলাচলে লোকজনকে কালিকাপুর রেলক্রসিং ব্যবহার করতে হয়। তবে রেলওয়ের হিসাবে এই লেভেল ক্রসিং অবৈধ।
লেভেল ক্রসিংটি চারদিকেই খোলামেলা। ট্রেন আসছে কি না, তা অনেক দূর থেকে দেখা যায়। এরপরও এই লেভেল ক্রসিংয়েই আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ট্রেনের ধাক্কায় একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় থাকা সাতজন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে অটোরিকশাচালকও আছেন। তাঁদের প্রত্যেকের বাড়িতে এখন শোকের মাতম চলছে।
রেলওয়ে পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, অটোচালকের অসাবধানতার কারণেই প্রাণ গেছে চালকসহ সাতজনের। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন নারী ও তিনজন পুরুষ। এঁদের মধ্যে একজন নারী ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। ঘটনাস্থলের প্রায় ৩০০ মিটারের মধ্যে নিহত ব্যক্তিদের লাশ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রেলপথে পড়ে ছিল। এ ঘটনায় অপর একজন গুরুতর আহত হয়েছেন।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে পাঁচজনই উপজেলার বাকশিমূল গ্রামের বাসিন্দা। তাঁরা হলেন তৈয়ব আলীর ছেলে অটোচালক সাজু মিয়া (৩৮), মৃত মুনসুর আলীর ছেলে আলী আহমেদ (৮০), মৃত আবদুল খালেকের স্ত্রী লুৎফা বেগম (৫৫), মনির হোসেনের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী শাহিনুর আক্তার ওরফে শানু (৩৫) ও আলী আশ্রাফের স্ত্রী সফরজান বেগম (৬৫)। নিহত অপর দুজন হলেন পাশের খোদাইধুলি গ্রামের মৃত আছমত আলীর ছেলে রফিস মিয়া (৬০) ও মৃত ফজলু মিয়ার স্ত্রী হোসনেয়ারা বেগম (৬৫)।
লাকসাম রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এমরান হোসেন বলেন, ওই এলাকায় রেলওয়ের কোনো বৈধ লেভেল ক্রসিং নেই। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেই লেভেল ক্রসিং অবৈধ। অটোরিকশাচালকের অসাবধানতার কারণে এতগুলো প্রাণ গেছে। এ ঘটনায় রেলওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, বাকশিমূল গ্রাম থেকে সাজু মিয়ার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে সবাই পাশের গাজিপুর বাজারে যাচ্ছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনটি সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কালিকাপুর এলাকায় রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় যাত্রীবাহী অটোরিকশাটি হঠাৎ রেলপথে উঠে যায়। এতে ট্রেনের ধাক্কায় অটোরিকশাটি দুমড়েমুচড়ে গেছে। ঘটনাস্থলেই নিহত হন পাঁচজন। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার সময় আরও দুজন মারা যান। এ ঘটনায় আহত অপর একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন কুমিল্লা রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক মোস্তফা কামাল। তিনি বলেন, ট্রেনের ধাক্কায় নিহত ব্যক্তিদের শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাঁরা ঘটনাস্থলে এসে শুধু হোসনে আরা বেগমের লাশ পেয়েছেন। ঘটনাস্থল বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় বাকিদের লাশ দুর্ঘটনার পরপরই স্বজনেরা নিয়ে গেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী আশিকুর রহমান বলেন, ‘আমি ঘটনাস্থলের পাশেই ছিলাম। ট্রেনটি হুইসেল দিয়েই আসছিল। এরপরও সাজু মিয়া অটোরিকশা নিয়ে রেললাইনে উঠে পড়েন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, ট্রেন আসার আগেই পার হতে পারবেন। কিন্তু এর আগেই তো সব শেষ হয়ে গেল। দুর্ঘটনার পর আশপাশের মানুষ চিৎকার দিয়ে ছুটে আসেন। ১০ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা ঘটনাস্থলে চলে আসেন। এরপর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া শরীরের অংশগুলো সবাই তুলে বাড়িতে নিয়ে গেছেন। ঘটনাস্থলের প্রায় ৩০০ মিটার এলাকাজুড়ে নিহত ব্যক্তিদের লাশ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রেলপথে পড়ে ছিল।’
স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইসমাইল বলেন, রেল ক্রসিংটি দিয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ চলাচল করেন। দীর্ঘদিন ধরে এখানে রেলগেট নির্মাণ ও গেটম্যান নিয়োগের দাবি জানানো হচ্ছে। এর আগেও এখানে একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
অটোরিকশাচালক হিসেবে নিহত সাজু মিয়া নতুন ছিলেন বলে জানিয়েছেন কালিকাপুর গ্রামের ব্যাটারিচালিত অপর অটোরিকশাচালক জামাল হোসেন। তিনি বলেন, সাজু আগে কাঠমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করেছেন। বছরখানেক আগে অটোরিকশা চালানো শুরু করেছেন। কীভাবে এমন ঘটনা ঘটল, তাঁরা বুঝতে পারছেন না। তাঁর অটোরিকশায় যাত্রী বেশি থাকার কারণে হয়তো দ্রুতগতিতে রেললাইন পার হতে পারেননি।
দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমরা ঘটনার পর থেকেই এ বিষয়ে খোঁজখবর রাখছি।’
চার সদস্যের তদন্ত কমিটি
এ ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) মো. কামরুজ্জামান। রেলওয়ে কুমিল্লার ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (পথ) লিয়াকত আলী মজুমদার বলেন, তদন্ত কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রেলওয়ে কুমিল্লার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী প্রকৌশলীকে। আর বাকি তিন সদস্য হলেন পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা, সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা এবং সিগন্যাল ও টেলিকমিউনিকেশন বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী। তাঁরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্তের কাজ শেষ করে দুর্ঘটনার পেছনের কারণ বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপককে জানাবেন। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।