দুর্গাপূজায় দশমীর পরের দিন মেলায় একত্র হতেন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ। পরস্পরের খোঁজ নেওয়া, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগির পাশাপাশি সেখানে বিবাহযোগ্য ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হতো। নিজেদের মধ্যে ঠিকঠাক বোঝাপড়া হলে এগিয়ে আসতেন অভিভাবকেরা। সিঁদুর পরিয়ে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেওয়া হতো। পরে সামর্থ্য অনুযায়ী হতো বিয়ের আয়োজন।
যুগ যুগ ধরে ঐতিহ্যবাহী এই মেলার আয়োজন করা হয় দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে। স্থানীয় লোকজনের কাছে মেলাটি ‘বাসিয়াহাট মেলা’ নামে পরিচিত। দিনাজপুর ও আশপাশের জেলা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, জয়পুরহাট, নওগাঁ থেকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ মেলায় উপস্থিত হন। প্রতিবছরের মতো এবারও মেলার আয়োজন করা হয়। এবার দুর্গাপূজা শেষে ১৫ অক্টোবর গত মঙ্গলবার এই মেলা বসে। মেলায় নানা ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের উপচে পড়া ভিড় ছিল।
কয়েক বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে মেলাটিকে জীবনসঙ্গী খোঁজার মেলা কিংবা বউ মেলা হিসেবে উপস্থাপনা করায় মানুষের উপস্থিতি বেড়েছে কয়েক গুণ। তবে আয়োজকেরা বলছেন, মেলাটির ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে।
আয়োজকদের একজন শীতল মার্ডি (৬৫) বলেন, ‘আমরা সংখ্যায় কম। তার ওপর দূরদূরান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি। নিজ গোত্রের মধ্যে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেওয়ার রীতিও ছিল না। আর্থিক অসচ্ছলতা থাকায় ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়াও সম্ভব ছিল না। ফলে বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে আমরা পরিবারের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করতে এখানে আসতাম। সেখানে কারও বিবাহযোগ্য ছেলেমেয়ের মধ্যে বোঝাপড়া হলে সিঁদুর পরিয়ে বিয়ে দেওয়া হতো। এখন সেই বিয়ের রীতি আর নেই। তবু বংশপরম্পরায় ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে এই আয়োজন চলমান রেখেছি।’
জয়পুরহাট থেকে স্ত্রী-সন্তানসহ মেলায় এসেছেন সমর কিসকু (৩৮)। তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে এই মেলায় এসেছিলেন। বাপ-দাদারা মেলা করে গেছেন। এখানে এলে বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়। ভালোই লাগে। কিন্তু গত বছর থেকে শুনতেছি, এই মেলা নাকি জীবনসঙ্গী খোঁজার মেলা। ঘটনাটা আসলে এমন না। এবার এসে দেখি লোক আর লোক। আমাদের সম্প্রদায়ের চেয়ে বাঙালির সংখ্যাই বেশি। এরপরও ভালো লাগছে অনেকে এসেছেন, আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারছেন।’
মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন কয়েক হাজার মানুষ। মঙ্গলবার বিকেলে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠেছবি: প্রথম আলো
দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে আসা সোনালী হেমব্রম (৩০) বলেন, ‘গতবারও মেলায় এসেছি। তবে এবার খুব ভালো লাগছে। এবারের আয়োজনও ভালো ছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে সব ধর্মের মানুষই মেলা দেখতে এসেছেন। দূরের কোনো আত্মীয়স্বজনের কথা উঠলেই দাদি বলতেন, আর কয়েক মাস পরেই মেলা। সেখানে তো সবাই আসবে। এখন দাদি নেই। কিন্তু তাঁর সেই কথা খুব মনে পড়ে।’
নীলফামারী সদর থেকে মেলা দেখতে এসেছেন মামুনুর রশিদ ও মীর মাহমুদুল হাসান। তাঁরা বলেন, ফেসবুক থেকে মেলার সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। এসে দেখেন, যেভাবে জীবনসঙ্গী খোঁজার মেলা বা বউ মেলা হিসেবে প্রচার করা হয়েছে, ঘটনা ঠিক সে রকম নয়। এটা আদিবাসীদের একটা মিলনমেলা।
মেলার আয়োজকদের একজন বীরগঞ্জ উপজেলার নিজপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান বলেন, ‘মেলাটির ইতিহাস প্রায় দুই শ বছরের। প্রতিবছর মেলায় দূরদূরান্ত থেকে আদিবাসীরা আসেন। প্রায় ৩০ হাজারের অধিক মানুষের সমাগম হয়। আমরা তাদের আয়োজনকে সুন্দর করার জন্য যতটুকু সম্ভব পাশে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’