ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার আরকলমি গ্রামের মো. শাজাহান মিন্টিজ (৪০) মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। চুরির অভিযোগ তুলে গ্রামবাসী তাঁকে বেধড়ক পিটিয়েছে। তাঁর দুটি চোখ গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে, কেটে দেওয়া হয়েছে ডান হাতের দুই আঙুল। পরিবারের দাবি, জমিজমার বিরোধের জের ধরে শাহাজাহানকে চোর বানিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতকাল রোববার সকাল ১০টার দিকে গ্রামবাসী চুরির অভিযোগে শাজাহানকে আত্মীয়ের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। পরে পিটিয়ে ও কুপিয়ে মারা গেছে ভেবে পরিত্যক্ত পুকুরপাড়ে ফেলে রাখে। খবর পেয়ে গ্রাম পুলিশ শাজাহানকে উদ্ধার করে চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। সেখানে শাজাহানকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রথমে বরিশাল এবং পরে ঢাকায় পাঠানো হয়। শাজাহান বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এ বিষয়ে চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এরশাদুল হক ভুইয়া বলেন, গ্রামবাসী শাজাহান মিন্টিজকে পিটুনি দিয়ে দুই চোখ তুলে নিয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য প্রথমে চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো হয়েছিল। এখন তিনি ঢাকায় চিকিৎসাধীন। তাঁর বিরুদ্ধে দক্ষিণ আইচা থানায় কোনো মামলা না থাকলেও ভোলার অন্য থানায় একাধিক মামলা আছে। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, শাজাহানের হাত-পা ভেঙে দুটি চোখ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। দুটি আঙুল কেটে নেওয়া হয়েছে।
চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা শোভন কুমার বসাক প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, শাজাহান মিন্টিজের দুই চোখই উপড়ে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ দুটি আইবল তুলে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া ডান হাতের দুটি আঙুল কেটে ফেলা হয়েছে।
শাজাহানের গ্রামের কয়েকজনের দাবি, তাঁর পরিবারের সবাই চুরির সঙ্গে জড়িত। শাজাহান চোরচক্রের সরদার। তাঁর বাবাও চুরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, কয়েক বছর আগে জেলখানায় থাকা অবস্থায় মারা যান।
গ্রামের কয়েকজনের ভাষ্য, স্থানীয় প্রভাবশালী অধ্যক্ষ মাওলানা লোকমানের ছেলে মো. সাকিবের নেতৃত্বে লোকজন শাজাহানকে ধাওয়া দেয়। তাঁকে পিটিয়ে, কুপিয়ে, চোখ ক্ষতিগ্রস্ত করে।
তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে মো. সাকিব বলেন, শাজাহান মিন্টিজ পেশাদার চোর ও চোরচক্রের সরদার। গ্রামবাসী তাঁকে দেখতে পেয়ে ধাওয়া করে ধোলাই দিয়েছে। এর সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
গ্রামের লোকজনের ভাষ্য, সম্প্রতি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে একাধিক চুরির ঘটনায় গ্রামবাসী শাজাহানের প্রতি ক্ষুব্ধ। গতকাল সকালে শাজাহানকে চর আরকলমী গ্রামে দেখতে পেয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁকে ধাওয়া করেন। পরে জাহাঙ্গীর ফরাজির বাড়ি থেকে তাঁকে আটক করা হয়। ওই গ্রামের বারেক ফরাজীর বাড়ির পুকুরপাড়ে নিয়ে তাঁকে নির্যাতন করা হয়।
নজরুল নগর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের গ্রামপুলিশ মো. সোহরাব মৃধা বলেন, তিনি গ্রামবাসীর কাছে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান। দেখতে পান, শাজাহান পুকুরপাড়ে মরার মতো পড়ে আছে। তিনি ও তাঁর সঙ্গে থাকা ৩ নম্বর ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ (চৌকিদার) মোহাম্মদ ফিরোজ ও দফাদার মো. আনোয়ার হোসেন ভারপ্রাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
শাজাহানের অবস্থা ভালো নয় জানিয়ে তাঁর ছোট ভাই মো. শাহিন মুঠোফোনে বলেন, ‘রক্ত চলতেছে। পাঁচ ঘণ্টা ধরে অপারেশন থিয়েটারের টেবিলে থাকার পরে আজ দুপুর দেড়টার দিকে বাইর করছে। চোখ-মুখ সমস্ত শরীলে ব্যান্ডেজ। রক্ত সংগ্রহ করে দিতেছি। তার সারা বডি ড্যামেজ হয়ে গেছে। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কুপিয়ে জখম করছে। ডান হাতের দুইটা আঙুল কেটে নিয়েছে। হাড়গোড় ভেঙে ফেলেছে। চোখ দুটো ছুড়ি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নষ্ট করে বালু ভরে দিছে।’
জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে এ ঘটনা বলে দাবি করেন শাহিন। তিনি বলেন, তাদের ৬৪ শতাংশ জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে লোকমান মাওলানার ছেলে আসিফ, সজিব, নিয়াজ ও শরীফ মেম্বার এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছেন। তাঁর বাবাকেও জমির জন্য চোরের অপবাদ নিয়ে পিটিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর বাবা জেলে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন।