মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী কোনো সাক্ষী নেই বলে আদালতকে জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মোজাম্মেল হক। আলোচিত এ হত্যা মামলায় আসামি সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভির খালাসের রায়ে এ তথ্য উল্লেখ রয়েছে।
রায়ে আরও উল্লেখ রয়েছে, তদন্ত কর্মকর্তা যে সাক্ষীর (সানজিদুল হাসান ইমন) জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন, সেই সাক্ষী ইমন শুনানিতে আদালতে বলেছেন, তিন্নি হত্যার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। অভির সঙ্গে তাঁর কোনো কথা হয়নি, দেখাও হয়নি।
রায়ের তথ্য বলছে, কোনো সাক্ষী বলেননি, তিন্নি অভিকে বিয়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন বা বিয়ে না করলে মিডিয়ায় অবৈধ সম্পর্কের বিষয় প্রকাশ করে দেবেন। বরং যে তারিখে তিন্নির ঘটনা দেখানো হয়েছে, সেই তারিখে তাঁর বাসায় অভি ছিলেন বলে সাক্ষীদের বক্তব্যে প্রমাণিত হয়েছে।
রায়ে আদালত বলেছেন, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় আসামিকে শাস্তি দিতে হলে আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হয়। কেবল পলাতক হওয়ার কারণে কোনো আসামিকে দোষী বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই।
২০০২ সালের ১০ নভেম্বর সন্ধ্যার পর থেকে মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি নিখোঁজ হন। ওই রাতেই বুড়িগঙ্গা নদীর ওপরে অবস্থিত বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু-১-এর নিচে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। তবে তখন তাঁর পরিচয় প্রকাশ হয়নি। অজ্ঞাত পরিচয় নারী হিসেবে তাঁকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। এরপর ১৫ নভেম্বর ওই নারীর ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তিন্নির চাচা তাঁকে চিনতে পারেন। পরে কবর থেকে লাশ তুলে তিন্নির পরিচয় শনাক্ত ও ময়নাতদন্ত হয়।
এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ থানা-পুলিশ অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা করে। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
গত ১৪ জানুয়ারি এ মামলার রায়ে আসামি সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভিকে খালাস দেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মোছা. শাহীনুর আক্তার।
রায়ে আদালত বলেছেন, সাক্ষীদের বক্তব্যে প্রমাণিত হয়েছে, তিন্নির সঙ্গে আসামি গোলাম ফারুক অভির প্রেমের সম্পর্ক ছিল। অভি ও তিন্নি একই বাসায় থাকতেন। প্রেমের সম্পর্কের বিষয়ে রায়ে তিন্নির চাচা সৈয়দ রেজাউল করিমের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। সৈয়দ রেজাউল করিম আদালতকে বলেছিলেন, তিন্নি তাঁর ছোট ভাইয়ের মেয়ে। ১৯৯৯ সালের ২২ জুলাই তিন্নির সঙ্গে পিয়ালের (সাফাকাত হোসেন পিয়াল) সামাজিকভাবে বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিন্নি যে আয় করতেন, সেটি পিয়াল নিয়ে যেতেন। টাকাপয়সা না দিতে পারলে তিন্নিকে মারধরও করতেন। দুজনের মধ্যে পারিবারিক ঝামেলার এক পর্যায়ে তিন্নির শ্বশুর পিয়াল ও তিন্নিকে আলাদা ফ্ল্যাট নিয়ে বসবাস করতে বলেন। তখন থেকে তিন্নি ও পিয়াল আলাদা ফ্ল্যাট নিয়ে বসবাস করতে থাকেন। একসময় তিন্নি ব্যাংককে শুটিং করতে যান, তখন অভির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ব্যাংকক থেকে ক্যামেরা কিনে না আনায় পিয়ালের সঙ্গে তিন্নির ঝগড়া হয়। মারামারির ঘটনাও ঘটে। মারামারির বিষয়টা অভিকে জানান তিন্নি। তখন অভি পিয়ালকে ডেকে বলেন, ‘তুমি তিন্নিকে ছেড়ে দাও, আমি তিন্নিকে বিয়ে করব।’ এরপর অভি পিয়ালকে তাঁর বাসা থেকে বের করে দেন। তখন থেকে অভি ও তিন্নি এক বাসায় থাকতে শুরু করেন।
আদালত রায়ে বলেছেন, তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছেন, তিন্নির সঙ্গে অভির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে তা আরও গভীর সম্পর্কে রূপ নেয়। তিন্নি সামাজিক মর্যাদা পাওয়ার জন্য অভিকে চাপ দেন। তিন্নি সম্পর্কের বিষয়টি মিডিয়াতে প্রকাশ করার হুমকি দেন। তখন থেকে অভি তিন্নিকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য পর্যালোচনায় কোনো সাক্ষী বলেননি যে তিন্নি অভিকে বিয়ের জন৵ চাপ দেন বা বিয়ে না করলে মিডিয়ায় সম্পর্কের বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করে দেবেন। বরং তিন্নি তাঁর বাবার কাছে বলেছিলেন, অভির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে। তিন্নি ও অভির সম্পর্কের মধ্যে কোনো ফাটল বা সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল, সেটি সাক্ষীদের সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হয়নি।
রায়ে আদালত তিন্নির চাচার বক্তব্য তুলে ধরেন। রায়ে আদালত বলেছেন, তিন্নির চাচার বক্তব্য অনুযায়ী, ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর তিন্নি তাঁদের বাসায় যান। ১০ থেকে ১৫ মিনিট বাসায় অবস্থান করার পর আবার চলে যান। তিন্নি বাসা থেকে বের হওয়ার ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর বীনা (তিন্নির বাসার গৃহকর্মী) তিন্নিকে খুঁজতে আসেন। বীনা তখন বলেছিলেন, ‘অভি ভাই তিন্নি আপুকে খুঁজছেন।’
তিন্নির বাসার আরেক গৃহকর্মী শেফালী আক্তারের বক্তব্য রায়ে তুলে ধরেন আদালত। রায়ে বলা হয়, শেফালী আক্তার বলেন, ‘সেদিন তিন্নি আপুকে বাসায় না পেয়ে অভি ভাই সারা রাত তিন্নি আপুর বাসায় ছিলেন। পরের দিন সকালে অভি চলে যান। বলে যান, তিন্নির খোঁজ পেলে তাঁকে যেন জানায়।’
সাবেক সাংসদ গোলাম ফারুক অভিফাইল ছবি
রায়ে বলা হয়েছে, ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তিন্নি তাঁর ফুফুর বাসায় যান। এর আধা ঘণ্টা পর রাত ৮টা বা সাড়ে ৮টার দিকে অভি তিন্নির বাসায় আসেন। ওই সময় থেকে অভি তিন্নির বাসায় অবস্থান করেন। পরদিন সকাল পর্যন্ত ছিলেন, যা তিন্নির বাসার কাজের গৃহকর্মী শেফালী ও বীনার বক্তব্যে প্রমাণিত হয়।
তিন্নির চাচার বক্তব্য তুলে ধরে রায়ে আদালত বলেছেন, ‘তিন্নি অভির সঙ্গে পার্টিতে যাবেন বলেছিলেন। কিন্তু ওই রাতে তিন্নি তাঁর বাবার বাসা থেকে বের হয়ে অভির সঙ্গে পার্টিতে গিয়েছিলেন, এমন কেউ দেখেননি। বরং ওই দিন সন্ধ্যার পর অভি তিন্নির খোঁজে তিন্নির বাসায় অবস্থান করেছেন।’ তিন্নির বাসার দুই কাজের মেয়ের সাক্ষ্যের বরাতে আদালত রায়ে বলেছেন, ‘ঘটনার দিন রাতে তিন্নির সঙ্গে অভির দেখা হয়নি।’
আদালত রায়ে আরও বলেছেন, ‘আসামি অভির বিরুদ্ধে অভিযোগ, অভি তিন্নিকে মাথায় আঘাত করে হত্যা করে ১ নম্বর বুড়িগঙ্গা চীন–মৈত্রী সেতু থেকে ফেলে দিয়ে আসেন। কিন্তু মামলার ঘটনার যে তারিখ দেখানো হয়েছে, সেই তারিখে অভির অবস্থান তিন্নির বাসায় ছিল, যা সাক্ষীদের বক্তব্যে প্রমাণিত হয়।’
মডেল তিন্নি হত্যার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য নেই বলে আদালতকে জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মোজাম্মেল হক। তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যের বরাত দিয়ে রায়ে বলা হয়, ‘জেরার জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তিন্নিকে না পেয়ে তিন্নির বাসায় অভি সারা রাত বসে থাকেন। তিন্নি হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীও নেই বলে তিনি জানান। জেরার জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, সানজিদুল হাসান ইমনের জবানবন্দি নেওয়ার আগে তিনি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত কোনো সাক্ষ্য–প্রমাণ পাননি। তিনি জবানবন্দিতে বলেন, ইমনের জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে তিনি অভিযোগপত্র দেন।’
আদালত রায়ে সানজিদুল হাসান ইমনের বক্তব্য তুলে ধরেন। ইমন আদালতকে বলেন, ‘২০০৮ সালে আমি অন্য একটি মামলায় সিআইডিতে রিমান্ডে ছিলাম। তখন তাঁরা আমাকে বলেন যে আমাকে তিন্নি হত্যা মামলার সাক্ষী হতে হবে নতুবা আমাকে আসামি করা হবে। তখন বাধ্য হয়ে আমি একটি কাগজে স্বাক্ষর দিই। আমি আর কিছুই জানি না। কিছুদিন আগে জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জানলাম, আমাকে সাক্ষী করা হয়েছে। আমি পুলিশকে বলিনি যে অভি আমাকে বলেছিলেন, তিন্নিকে হত্যা করেছেন অভি।’
রায়ে আদালত বলেন, ‘জেরার জবাবে ইমন আদালতকে বলেন, তিনি অভিকে চেনেন না। তাঁর সঙ্গে অভির কখনো দেখা হয়নি। মামলাসংক্রান্ত বিষয়ে অভির সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। অর্থাৎ যে সাক্ষীর সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে তদন্ত কর্মকর্তা এ মামলায় অভিযোগপত্র দেন, সেই সাক্ষী হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে তিনি জানেন বা অভি তাঁকে বলেছেন, তা অস্বীকার করেছেন।’
এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে বলে ঢাকা জেলা ও দায়রা আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর ইকবাল হোসেন জানিয়েছেন।