তোলার দুই দিনের ব্যবধানে ‘আয়েশা আদিত্য’ নামে একটি নাটক ইউটিউব থেকে সরিয়ে নিয়েছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কাহিনি। নাটক সরানোর এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে নাটকটি নির্মাণ করেছেন তরুণ নির্মাতা সজীব খান। এতে আলাদা ধর্মাবলম্বী দুই তরুণ-তরুণীর প্রেমের করুণ পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে।
নাটকটি পবিত্র ঈদুল ফিতরে চ্যানেল নাইনে প্রচারিত হয়েছে। প্রায় দুই মাস পর গত বৃহস্পতিবার কাহিনির ইউটিউব চ্যানেলে নাটকটি তোলা হয়। অনেকেই নাটকটির প্রশংসা করেন।
তবে কেউ কেউ নাটকের বিষয়বস্তু নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। আপত্তিটা ক্রমেই হুমকিতে পরিণত হয়। অনেকটা হুমকির মুখেই শনিবার সন্ধ্যা সাতটায় নাটকটি ইউটিউব থেকে নামিয়ে ফেলেছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে নাটকটি নির্মাণ করেছেন তরুণ নির্মাতা সজীব খাননির্মাতার সৌজন্যে
নাটকে কী আছে
নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র আয়েশা ও আদিত্য। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে আয়েশার সঙ্গে আদিত্যর প্রেম হয়। নাটকের শুরুতেই দেখা যায়, নদীতে আদিত্যর মরদেহ পাওয়া গেছে। এরপর ফ্ল্যাশব্যাকে আয়েশা ও আদিত্যর প্রেমকাহিনি পর্দায় তুলে ধরা হয়েছে।
নির্মাণের পাশাপাশি নাটকের গল্পও লিখেছেন সজীব খান। আজ দুপুরে প্রথম আলোকে তিনি জানান, ২০০৮ সালে নেত্রকোনার একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নাটকটি বানিয়েছেন তিনি। ঘটনাটি এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলেন তিনি।
নাটকটি ইউটিউবে প্রকাশের পরপরই প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে শনিবার সকাল থেকে হঠাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপত্তি তুলতে থাকেন কেউ কেউ। আলাদা ধর্মের দুজনের প্রেমকে পর্দায় তুলে আনা নিয়েই মূল আপত্তি।
নাট্যবিশ্লেষকেরা বলছেন, নাটকটি চ্যানেল নাইনের প্রিভিউ কমিটি দেখার পর টেলিভিশনে প্রচার করেছে। ফলে নাটকের বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশ্ন থাকার কথা নয়।
বিষয়টি নিয়ে সজীব খান আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সত্য ঘটনা তুলে ধরেছি। কোনো ধর্মকে আমি ছোট করিনি। শুধু দুটি চরিত্রকে আলাদা ধর্মের দেখিয়েছি।’
নাট্যবিশ্লেষকেরা বলছেন, নাটকটি চ্যানেল নাইনের প্রিভিউ কমিটি দেখার পর টেলিভিশনে প্রচার করেছে। ফলে নাটকের বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশ্ন থাকার কথা নয়।
তবু নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে রোববার এক ফেসবুক পোস্টে দর্শকের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন নির্মাতা সজীব খান। নাটকে মূল দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন পার্থ শেখ ও সাবরিন আজাদ। পার্থ শেখও ক্ষমা চেয়েছেন।
নাটকে মূল দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন পার্থ শেখ ও সাবরিন আজাদনির্মাতার সৌজন্যে
নাটক প্রচারে বাধা ‘অন্যায়’
নাটক প্রচারে বাধা দেওয়ার ঘটনাকে ‘অন্যায়’ বলছেন ছোট পর্দার পরিচালকদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি শহীদুজ্জামান সেলিম।
এক প্রশ্নের জবাবে আজ দুপুরে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রেমে কখনোই জাত, ধর্ম, বর্ণের বর্ডারলাইন (সীমারেখা) নেই। নাটক নাটকই। বাস্তবের সঙ্গে কিছু মিল থাকে, অনেক সময় মিল থাকে না। কিন্তু বাস্তবে এ রকম ঘটনা ঘটে না, তা–ও নয়। চারপাশে প্রচুর উদাহরণ আছে। প্রচারের ক্ষেত্রে যে বাধা সৃষ্টি হয়েছে, সেটা অন্যায় হচ্ছে।’
আজকে একটি নাটককে কেন্দ্র করে এটা ঘটেছে, কাল চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে হবে। তাহলে বাংলাদেশের কালচারাল অ্যাকটিভিটিই বন্ধ হয়ে যাবে।
শহীদুজ্জামান সেলিম, সভাপতি, ডিরেক্টরস গিল্ড
নির্মাতা ও অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিমের ভাষ্য, ‘আজকে একটি নাটককে কেন্দ্র করে এটা ঘটেছে, কাল চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে হবে। তাহলে বাংলাদেশের কালচারাল অ্যাকটিভিটিই বন্ধ হয়ে যাবে।’
ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি বলেন, ‘নাটক ও সিনেমাকে নিজের মতো করে চলতে দিতে হবে। নীতিমালায় কোথাও লেখা নেই, ভিন্ন ধর্মের প্রেমকাহিনি নিয়ে নাটক করা যাবে না। সুতরাং বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে, নির্মাতা হিসেবে প্রত্যেকের কাজ করার অধিকার রয়েছে।’
হুমকি পাচ্ছেন নির্মাতা, শিল্পীরা
‘নাটকটিতে অভিনয় করায় ফেসবুকের ইনবক্সে অকথ্য ভাষায় আমাকে গালিগালাজ করা হচ্ছে, অনবরত হুমকি পাচ্ছি,’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন এক অভিনয়শিল্পী।
নাটকের প্রযোজক, নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীদের ছবিসংবলিত ফটো কার্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। নাটকটি সরিয়ে নেওয়ার পরও হুমকি বন্ধ হয়নি বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। কেউ কেউ নিরাপত্তহীনতায় ভুগছেন।
বিষয়টি নিয়ে কোনো অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অতিরিক্ত ডিআইজি জাহিদুল ইসলাম, সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি), সিআইডি
নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ভাটারা থানায় সাধারণ ডায়েরি করবেন বলে জানালেন নির্মাতা সজীব খান।
নাটকটির নির্মাতা ও শিল্পীদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সরকার ও প্রশাসনের প্রতি দাবি জানান ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি শহীদুজ্জামান সেলিম।
বিষয়টি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) অতিরিক্ত ডিআইজি জাহিদুল ইসলাম আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে কোনো অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
‘বাঙালি বিলাস’ নামে একটি সিনেমার ট্রেলারও সরিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছেনির্মাতার সৌজন্যে
আরও আছে
আলোচনা-সমালোচনার মুখে ‘বাঙালি বিলাস’ নামে একটি সিনেমার ট্রেলারও সরিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ছবিটি পরিচালনা করেছেন এবাদুর রহমান। ৭৮তম কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের বাণিজ্যিক শাখা মার্শে দ্যু ফিল্মে ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছে।
এর আগে বঙ্গ সিনেমাসের ফেসবুক পেজে ‘কাজলরেখা’ সিনেমার প্রণামের একটি দৃশ্য ব্লার (ঝাপসা) করে দেওয়া হয়েছিল। ২০২০ সালে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বিঞ্জ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল ‘সদরঘাটের টাইগার’। ইউটিউব থেকে ২০২১ সালে ‘ঘটনা সত্য’, গত বছর ‘রূপান্তর’ নামে দুটি নাটকও সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।