ঘরে ঢুকেই দেখি মাজেদা খালার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে খালা তড়াক করে উঠে বসলেন।
‘হিমু, কোথায় ছিলি তুই? সকাল থেকে তোর খোঁজ করছি। সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে।’
‘কী ঘটনা?’
মাথা মুছতে মুছতে খালা আমাকে আড়ালে টেনে নিয়ে গেলেন। চাপা গলায় বললেন, ‘আমাকে তো ওরা উপদেষ্টা হতে বলছে।’
‘বল কী! কোন মন্ত্রণালয়?’
‘সেসব কিছু জানি না। সকালেই ফোন পেলাম। বলল, ডিসিশন মোটামুটি ফাইনাল। আজ, বা কাল রাতে ঘোষণা হবে। তার আগ পর্যন্ত কাউকে জানানো নিষেধ।’
‘সর্বনাশ। তোমার সঙ্গে তো আমার কোনো ছবিও নাই। ফেসবুকে পোস্ট দেব কী?’
‘রাখ তোর পোস্ট। আগে বল, উপদেষ্টার পোস্ট দিয়ে আমি কী করব!’
‘খালু সাহেবকে জানিয়েছ খবরটা?’
‘ওইটাই তো ঝামেলা। তার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে কথা বন্ধ। ভাবছিলাম লোকটাকে ছেড়েছুড়ে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব। এর মধ্যে এই ঘটনা।’
‘গুড। উপদেষ্টার শপথটা নিয়েই যেদিকে দুচোখ যায় যেয়ো। প্রোটোকলসহ গাড়ি থাকবে। জ্যামেও পড়তে হবে না। আমার তো যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকেই দেখি জ্যাম।’
‘হিমু! আমার সাথে রসিকতা করবি না। এখন রসিকতার সময় না।’
‘তা ঠিক। এখন রসিকতার সময় না। এখন ফেসবুক পোস্ট ডিলিট করার সময়।’
‘মানে?’
‘জানো না? বিয়ে আর উপদেষ্টা হওয়ার আগে পুরোনো ফেসবুক পোস্ট ডিলিট করতে হয়। নইলে তুমি কবে কী লিখেছ, কবে কার সঙ্গে ছবি দিয়েছ, সব পোস্টের পোস্টমর্টেম শুরু হবে।’
‘আমি তো ফেসবুকে তেমন কিছু লিখি না।’
‘না লিখলে তো আরও বিপদ।’
‘কেন?’
‘কেন চুপ ছিলে, সেই জন্যও তোমাকে ধরা হবে।’
‘আশ্চর্য! আজকাল ফেসবুক দেখেই সব কিছুর বিচার হচ্ছে নাকি?’
‘অবশ্যই। থার্মোমিটারে মাপা হয় জ্বর, ফেসবুকে মাপা হয় নারী এবং নর।’
‘তুই এত ফেসবুকভক্ত হইলি কবে থেকে? তোর তো মোবাইলই নাই। ফেসবুক চালাস কী করে?’
‘আমার নাই তো কী? ফেক ফকিরের আছে।’
‘ফেক ফকিরটা কে?’
‘আমার এক বন্ধু।’
‘হিমু, তুই যে কাদের সাথে চলিস। একটা লোকের নাম ফেক ফকির, সে আবার তোর বন্ধু!’
‘ফেক ফকিরের মতো প্রতিভাবান লোক আমি আমার জীবনে দেখি নাই। ফেসবুকে তার ২ হাজার ৯১২টা ফেক অ্যাকাউন্ট।’
‘বলিস কী! এত অ্যাকাউন্ট দিয়ে করে কী?’
‘যখন যেই কাজের অর্ডার পায়, সেটাই করে। এখন যেমন জায়গায় জায়গায় গিয়ে কমেন্ট করছে, “ইউসুফ সরকারকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে।” আপাতত এটাই তার কাজ।’
‘হিমু, তুই আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ। এক্ষুনি দূর হ। এমনিতেই মাথাটা গরম লাগছিল, তোর বকবক শুনে মাইগ্রেনের ব্যথাটাও শুরু হয়ে গেছে।’
‘যাচ্ছি। তবে খালা, যাওয়ার আগে একটা রিকোয়েস্ট করি?’
‘কী?’
‘উপদেষ্টা হওয়ার পর তুমি “হাঁটা দিবস” নামে একটা দিবস চালু করবে, প্লিজ? ধরো বছরে একটা দিনের জন্য দেশের সমস্ত যানবাহন বন্ধ রাখা হলো। সবাই হেঁটে হেঁটে যে যার গন্তব্যে গেল…’
‘তুই দূর হ।’
‘রাগ করছ কেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও কিন্তু হাঁটা নিয়ে একটা গান আছে—আমার সকল হাঁটা ধন্য করে ফুটবে ফুল ফুটবে…। ’
রবীন্দ্রনাথ ‘হাঁটা’ নয়, ‘কাঁটা’ লিখেছিলেন। খালা অবশ্য সেসব আলাপে গেলেন না। মনে হলো তিনি আমার মাথায় ছুড়ে মারার মতো একটা কিছু খুঁজতে শুরু করেছেন। অতএব দ্রুতই তার সামনে থেকে সরে এলাম।
রুপার সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। আমি যখন বসার ঘরের টেলিফোনটার দিকে এগোচ্ছি, তখন খালু সাহেবের সঙ্গে দেখা।
‘হিমু, তোমাকে যে একটা কাজ দিয়েছিলাম, কিছু করেছ?’ খালু সাহেবও কথা বললেন চাপা গলায়।
‘নিশ্চিন্ত থাকেন। আপনার কাজ হয়ে গেছে। দেখবেন আজ-কালের মধ্যেই খালার রাগ পানি হয়ে যাবে। আপনাকে এসে বলবে, “চলো, কোথাও থেকে একটু ঘুরে আসি।”’
‘তুমি কী করে জানলে? তোমার খালার তো দেখছি মাথা গরম। সকালে একটা ফোন এসেছিল, তারপর থেকে কী যে হলো…’
‘কাল সকালে আরেকটা ফোন আসবে। তারপর দেখবেন সব ঠিক।’ খালু সাহেবকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলাম না। চলে এলাম। ফোন করলাম রুপাকে।
‘তোমার খালা ঠিক আছেন তো?’ ফোন ধরেই রুপা বলল।
‘হুম। আপাতত মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে।’
‘বলো কী! হিমু, তুমি কেন আমাকে দিয়ে মিথ্যে কথা বলালে? আমি কি আরেকবার তাকে ফোন করে সত্যিটা বলে দেব?’
‘থাক না। ভদ্রমহিলা একটু এক্সাইটমেন্টের মধ্যে আছে। এই এক্সাইটমেন্ট কাল পর্যন্ত থাকুক।’
‘কিন্তু তাকে এই মিথ্যামিথ্যি আশ্বাসটা দিয়ে কী লাভ হলো?’
‘মিথ্যা হবে কেন? তুমি কাল সকালে তাকে আবার ফোন করবে। বলবে, আমরা একটা কমিটি গঠন করছি। জাতীয় হাঁটা কমিটি। এই কমিটিতে তাকে উপদেষ্টা করতে চাই।’
‘তবু। শুধু শুধুই মানুষটাকে টেনশনের মধ্যে ফেললে।’
‘শোন রুপা, ঝড়ের পরই কিন্তু ঝুম করে বৃষ্টি নামে। আজকে রাতে খালা কাঁধের ওপর বিশাল একটা বোঝা নিয়ে ঘুমাতে যাবে। সারা রাত ছটফট করবে। সকালে যখন জানবে, তাকে অত বড় দায়িত্ব নিতে হচ্ছে না, তখন মনটা হালকা হয়ে যাবে। এই হালকাভাব শেয়ার করার জন্য খালুকে তার পাশে লাগবে। তুমি নিশ্চিত থাকো, কাল বিকেলেই দুজন একসঙ্গে হাঁটতে বেরোবে। ব্যাকগ্রাউন্ডে তখন গান বাজবে—আমার সকল হাঁটা ধন্য করে ফুটবে ফুল ফুটবে…।’