অন্তর্বর্তী সরকারের সম্প্রতিক কিছু কাজকর্ম বা সিদ্ধান্ত দেখে অনেকের মনে হতে পারে, তারা একা একা চলতে চাইছে। রাজনৈতিক সরকারগুলো অনেক সময় বিভিন্ন স্বার্থের কারণে অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে না জানিয়ে বা আলাপ-আলোচনা না করে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। রাজনৈতিক সরকারগুলো মনে করে তাদের প্রতি জনসমর্থন আছে। ফলে যে সিদ্ধান্ত তারা গ্রহণ করবে, তার পক্ষে নিজ নিজ কর্মীদের মাঠে নামাতে পারবে এবং এই কর্মীদের জনগণ বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে।
কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যারা একটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে, তারা কেন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সব বিষয়ে আলাপ করবে না। এমন না যে রাজনৈতিক দলগুলোর সব সময় এই সরকারের বিরোধিতা করছে। রাজনৈতিক দলগুলো অনেক বিষয়েই একমত হবে সরকারের সঙ্গে, আবার কিছু বিষয়ে হবে না, এটাই স্বাভাবিক। যদি দ্বিমতও পোষণ করে তারপরও ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত সরকারের। এ বিষয় সরকারের গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য মানবিক করিডর সুবিধা দেওয়াসংক্রান্ত সরকারের এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করার দরকার ছিল।
কিছু দিন ধরে রাখাইনদের জন্য একটি মানবিক করিডর দেওয়ার বিষয়ে কথা হচ্ছিল। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এই করিডরের জন্য আগেই অনুরোধ করা হয়েছে। জাতিসংঘ মনে করছে এখনই রাখাইনে মানবিক সহায়তা না পাঠাতে পারলে সেখানে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। রাখাইনে মিয়ানমারের জান্তা শাসক ও আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান যুদ্ধে মানবিক বিপর্যয় থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষার জন্য এই সহায়তা পাঠানো জরুরি।
জাতিসংঘের এমন মতামতের পর আমাদের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও বিভিন্ন আলোচনায় করিডরের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। এসব আলাপ-আলোচনার মধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়টি প্রকাশ্যে এল।
রোববার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘এতটুকু আপনাদের বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ, এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ) হবে। কিন্তু আমাদের কিছু শর্তাবলি রয়েছে, সেই বিস্তারিততে যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’
এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, মানবিক বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে ভূরাজনৈতিক, সামরিক, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের বিষয়গুলো আমাদের গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। রাখাইন পরিস্থিতি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে চাইলে প্রথমেই আমাদের একটি প্রশ্ন করতে হবে। তা হচ্ছে, রাখাইনের ভবিষ্যৎ কোন দিতে যাচ্ছে এবং রাখাইনের যুদ্ধের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী হতে পারে। এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর কেউই এখন দিতে পারবে না। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ওপর নির্ভর করবে কে কি ধরনের কৌশল গ্রহণ ও প্রয়োগ করবে।
তাই বাংলাদেশের প্রথম কৌশল হবে, রাখাইনের যেকোনো ধরনের পরিণতি থেকে আমরা কী ধরনের সুবিধা আদায় করে নিতে পারব, তার হদিস করা। এরই সঙ্গে আমাদের ঝুঁকির বিষয়গুলোও বিবেচনা করতে হবে।
রাখাইন পরিস্থিতির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে বাংলাদেশে দলে দলে প্রবেশের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমার জান্তার হাত থেকে আরাকান আর্মি রাখাইনের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা দখলে নিলেও রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করা বন্ধ হয়নি। তাই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসাও বন্ধ হয়নি। ফলে বোঝাই যাচ্ছে মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীর পাশাপাশি আরাকান আর্মির মধ্যেও রোহিঙ্গাবিদ্বেষ রয়েছে। এ কারণে রাখাইনদের জন্য মানবিক করিডর দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথ খুঁজতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তৃতীয় পক্ষকে যুক্ত করতে পারে। এটা হবে বাংলাদেশের আলোচনা শুরু করার প্রথম শর্ত।
রোহিঙ্গা ইস্যু ছাড়াও এই মানবিক করিডর প্রদানের সঙ্গে আঞ্চলিক রাজনীতি, আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তা, আর্থিক ও সামরিক বিষয়াদি জড়িত। রাখাইনকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নানা ধরনের মেরুকরণের সূচনা হতে পারে। তাই বিষয়টি আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কৌশল সাজাতে হবে।
আগেই বলেছি রাখাইনের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী হতে পারে। এখানে দুটি সম্ভাবনাই আছে। এক, রাখাইন মিয়ানমার থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন দেশ বা বিশেষ ব্যবস্থায় পরিচালিত একটি ভূখণ্ডে পরিণত হতে পারে। অথবা মিয়ানমারের জান্তা সরকার রাখাইন পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিবে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে বা আলোচনার ভিত্তিতে।
রাখাইনে দুই ধরনের পরিণতির কথা বিবেচনা করেই আমাদের কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এই পরিকল্পনার সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থও জড়িত আছে এবং মনে রাখতে হবে মিয়ানমারে দীর্ঘ সময় জান্তা শাসকের উপস্থিতি, রাখাইন, চিন প্রদেশের যুদ্ধ, সবকিছু মিলিয়ে সেখানে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এর অবসান হতে পারে হুট করে। আবার দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ, আলাপ-আলোচনা, সমঝোতার মাধ্যমেও হতে পারে। মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাই সুনির্দিষ্ট মন্তব্য করা মুশকিল ও ঝুঁকিপূর্ণ একটি বিষয়।
প্রথম সম্ভাবনাকে ধরে যদি আলোচনা করি তবে আমাদের করিডর প্রদান এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। এ অবস্থায় রাখাইনে নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি বা নতুন ব্যবস্থার উদ্ভব ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে গ্রহণ করবে, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। প্রথমত রাখাইনে রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক পরিবর্তন ভারতের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকির কারণ হবে। ভারত মিয়ানমারে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারাবে। ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো বাংলাদেশকে এড়িয়ে সরাসরি বঙ্গোপসাগরের প্রবেশের সুযোগ হারাবে। তখন অনেক ঘুরে ইয়াঙ্গুন হয়ে সমুদ্রে প্রবেশ করতে হবে। এর পাশাপাশি কুকি-চিনদের যুদ্ধের প্রভাব ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। তাই ভারত চাইবে না মিয়ানমারে এমন কিছু হোক, যাতে তার রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা বিঘ্নিত হতে পারে।
মিয়ানমার নিয়ে চীনের অবস্থান খুবই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। কখন জান্তা সরকারকে সমর্থন দেয়, কখন কোনো বিদ্রোহীদের সহায়তা করে বলা মুশকিল। এর কারণ হচ্ছে চীনের কুমনিং থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরে প্রবেশের একটি রুট হচ্ছে রাখাইনের বন্দরগুলো। তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের একটি অংশ হচ্ছে মিয়ানমারের রাখাইনের বন্দর। তাই মিয়ানমার হাতছাড়া হয়ে গেলে রাখাইন নিয়ে চীনকে নতুন করে কূটনীতি শুরু করতে হবে। কুমনিং থেকে রাখাইন হয়ে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা চীনের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।