সাম্প্রতিক ইতিহাসে শ্রেণিযুদ্ধ এতটা নগ্ন ও প্রকাশ্য হতে দেখা যায়নি। সাধারণত শতকোটিপতিরা নিজেরা সরাসরি সামনে না এসে অনুগত লোকদের দিয়ে দরিদ্র শ্রেণির ওপর পীড়ন চালান। কিন্তু এখন তাঁদের চক্ষুলজ্জা বা সংকোচ দূর হয়ে গেছে। তাঁরা আর নিজেরা মুখোশের আড়ালে থাকছেন না। তাঁরা কোনোরকম রাখঢাক না করে খোলাখুলিই নিজেদের ক্ষমতা দেখাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক এখন সরকারের ব্যয় কমানোর নামে মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন। এক অর্থে তিনি তাঁদের বিরুদ্ধে ফেডারেল হামলার নেতৃত্ব দেবেন। তাঁর লক্ষ্য হলো জনপরিষেবা খাতে সরকারের ব্যয় কমানো এবং সম্পদ লুণ্ঠনকারী পুঁজিবাদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার জন্য যেসব সরকারি নিরাপত্তাব্যবস্থা আছে, সেগুলো বাতিল করা।
ইলন মাস্ক সরকারি ব্যয় কমানোর কাজে যাঁকে পাশে পাচ্ছেন, তিনি আরেকজন শতকোটিপতি। তাঁর নাম বিবেক রামাস্বামী। এই কাজ করার জন্য তাঁরা যাঁদের নিয়োগ দিচ্ছেন, তাঁরাও একেকজন অতিধনী ব্যক্তি। মজার ব্যাপার হলো, তাঁরা এই কাজের জন্য কোনো পারিশ্রমিক নেবেন না। শুধু ‘উদার হৃদয়’ থেকে রাষ্ট্রকে ‘ভালোবেসে’ তাঁরা এই কাজ করবেন।
৪০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদের মালিক মাস্ক বলেছেন, ‘আমাদের খরচ কমিয়ে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী চলতে হবে।’ খেয়াল করে দেখুন, এখানে ‘আমরা’ বলতে তিনি কিন্তু নিজেকে বোঝাচ্ছেন না, তিনি আসলে সাধারণ আমেরিকানদের কথা বোঝাচ্ছেন।
আসলে ধনিক শ্রেণির কর কমানোর মতলবেই ট্রাম্প ও মাস্ক ফেডারেল বাজেট কাটছাঁট করতে চান। এই ‘দুর্ভাগা’ শ্রেণির নাকি বিশেষ সহায়তার প্রয়োজন!
২০২০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ১২ জন শীর্ষস্থানীয় ধনী ব্যক্তির সম্পদ ‘মাত্র’ ১৯৩ শতাংশ বেড়েছে। সম্মিলিতভাবে এই ‘অসহায়’ ব্যক্তিরা এখন মোটে ২ ট্রিলিয়ন ডলারের মালিক।
যেসব দেশে এখনো সম্পূর্ণ স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাদের বোঝা উচিত, গণতন্ত্র আপনা-আপনি আসে না। জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ, প্রতিবাদ ও স্বাধীন গণমাধ্যমই গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু সরকারগুলো এখন প্রতিবাদ করাও নিষিদ্ধ করছে, আর নিরপেক্ষ গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
মাস্ক যে লক্ষ্য ঠিক করেছেন, তা বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার সময় বলেছিলেন, তিনি ফেডারেল ব্যয়ের ৬ দশমিক ৭৫ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে ২ ট্রিলিয়ন ডলার ছেঁটে ফেলবেন, যা কিনা পুরো ঐচ্ছিক বাজেটের (ঐচ্ছিক বাজেট হলো যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের সেই বাজেটের অংশ, যা কংগ্রেস প্রতিবছর নতুন করে অনুমোদন দেয় এবং পরিবর্তন করতে পারে। এই বাজেট থেকে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়) চেয়েও বেশি।
ইলন মাস্কের মূল উদ্দেশ্য পরিষ্কার, তা হলো একটি কঠোর ব্যয় সংকোচন। আর এটি করা হলে বেশির ভাগ আমেরিকান মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বেন।
যদি মাস্কের পরিকল্পনা সফল হয়, তাহলে তা মানুষের জীবন ও প্রকৃতির ওপর কী প্রভাব ফেলবে, তা বোঝার জন্য আর্জেন্টিনার দিকে তাকালেই হবে। সেখানে এক বছর ধরে একই ধরনের একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সেখানে প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেই আন্তর্জাতিক পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষায় শ্রেণিযুদ্ধ চালাচ্ছেন। ফলাফল? দারিদ্র্যের ভয়াবহ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যবিমা হারানো মানুষের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়া, সরকারি স্বাস্থ্য খাতে তহবিল–সংকট, বিদ্বেষমূলক অপরাধের ব্যাপক বিস্তার, বিজ্ঞান ও পরিবেশ সংরক্ষণের ওপর সংঘবদ্ধ হামলা এবং বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্য দেশের খনিজ সম্পদ, জমি ও শ্রম দখলের অবাধ সুযোগ।
মাস্ক ও রামাস্বামী যে ব্যাপক ব্যয় সংকোচন ও নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার পরিকল্পনা করছেন, তা বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকায় জনতুষ্টিবাদী ‘নিষ্ঠুর রাজনীতির’ অংশ। এই নীতিতে শাসকের কাছে জনতার দুর্ভোগ কোনো বিষয় নয়। সেখানে সরকারের সমর্থকেরা ততক্ষণ খুশি থাকবে, যতক্ষণ তাদের শত্রুরা—বিশেষ করে অভিবাসীরা—আরও বেশি কষ্ট পেতে থাকবে। মাস্ক নিজেও এই ঘৃণার রাজনীতির একজন নেতা। তিনি দেখিয়েছেন, ভোটাররা আসলে কেমন আছেন, তা তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং তাঁরা অন্য গোষ্ঠীর তুলনায় কতটা ভালো আছেন, সেটাই মুখ্য।
বিশ্বজুড়ে এখন যে শ্রেণিসংগ্রাম শুরু হয়েছে, তার মূল কারণ হলো দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর দুনিয়ায় যে সাম্যবাদী ও গণতান্ত্রিক ধারা তৈরি হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেছে। আমরা ১৯৪৫-১৯৭৫ কালপর্বকে স্বাভাবিক গণতন্ত্রের যুগ বলে ভাবি। কিন্তু একটি ব্যতিক্রম বাস্তবতার কারণে এই সময়কে আমাদের কাছে গণতন্ত্রের যুগ বলে মনে হয়েছে। যুদ্ধের কারণে শাসকশ্রেণির ক্ষমতা দুর্বল হয়েছিল বলেই তখন সে ধরনের রাজনৈতিক অবস্থা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখন দেশগুলো আবার সামন্তবাদী শাসনের দিকে ফিরে যাচ্ছে।
বিশ শতকে এমন শাসনব্যবস্থাকে ফ্যাসিবাদ বলা হতো। সেখানে ক্ষমতা ছিল ‘রাজা-সম্রাটদের’ হাতে। ট্রাম্প ও মাস্ক ঠিক ফ্যাসিবাদী কি না, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে; কিন্তু এ কথা সত্য, তাঁরা আসলে সেই পুরোনো স্বৈরাচারী ধারা ফিরিয়ে আনছেন।
ট্রাম্প ও মাস্কের মতো মানুষের শাসন বিশৃঙ্খল হবে জেনেও ধনকুবেররা তাঁদের শাসনকে পোক্ত করবেন। কেউ তেমন প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন না। গণমাধ্যম ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে তাদের ক্ষমতা মেনে নিয়েছে।
যেসব দেশে এখনো সম্পূর্ণ স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাদের বোঝা উচিত, গণতন্ত্র আপনা-আপনি আসে না। জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ, প্রতিবাদ ও স্বাধীন গণমাধ্যমই গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু সরকারগুলো এখন প্রতিবাদ করাও নিষিদ্ধ করছে, আর নিরপেক্ষ গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু তারপরও শেষ সত্য হলো, এই শ্রেণিসংগ্রামে নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ নেই। প্রত্যকেরই কোনো না কোনো পক্ষ নিতে হবে।
● জর্জ মোনবিয়ট দ্য গার্ডিয়ান–এর নিয়মিত কলাম লেখক