বাসি বা আধাসেদ্ধ খাবার থেকে সাবধান, হতে পারে পক্ষাঘাতের মতো মারাত্মক সংক্রমণ
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 06-02-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

গত মাসে ভারতের পুনেতে একজন স্কুল শিক্ষিকা তাঁর ছয় বছর বয়সী ছেলেকে পড়াচ্ছিলেন। এমন সময় মা দেখলেন, তাঁর ছেলে ঠিকভাবে পেন্সিল ধরতে পারছে না। ভেবেছিলেন, ছেলে পড়াশোনার ওপর বিরক্ত। রেগে আছে, তাই ঠিকমতো পেন্সিল ধরতে পারছে না।

এর কয়েক দিনের মধ্যেই অবস্থা আরও খারাপ হলো। তখন আর শুধু আঙুল নয়, ছেলেটা হাত-পা নাড়াতেও পারছিল না। বাধ্য হয়ে ছেলেটিকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি করতে হলো। অবস্থা আরও খারাপ হলে ছেলেটি গিলতে, কথা বলতে, এমনকি শ্বাস নিতে পারছিল না। ফলে তাকে ভেন্টিলেটরে রাখা হলো। এখন ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। ছেলেটি সুস্থ হয়ে উঠছে।

পরে জানা গেল, গিয়ান-ব্যারে সিন্ড্রোম (GBS)-এর প্রথম লক্ষণ। এটি একটি বিরল রোগ, যেখানে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা স্নায়ু কোষে আক্রমণ করে। ফলে পেশি দুর্বল হয় আর পক্ষাঘাত দেখা দেয়। ওই স্কুল শিক্ষিকা পরে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন, তিনি কখনও ভাবতে পারেননি যে তাঁর ছেলের পেন্সিল ধরতে না পারার সমস্যাটি জিবিএস-এর কারণে হচ্ছিল।

এই ছেলেটি প্রায় ১৬০ জন রোগীর মধ্যে একজন, যারা জানুয়ারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ভারতের পুনেতে জিবিএস-এ আক্রান্ত হয়েছে। এই সংক্রমণে পুনেতে ৫টি সম্ভাব্য মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সরকারী তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৪৮ জন রোগী আইসিইউ-তে আছেন। ২১ জন আছেন ভেন্টিলেটরে এবং ৩৮ জন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।

অধ্যাপক উইলিসন বলেছেন ‘পুনেতে সম্ভবত এই বিশেষ ধরনের ক্যাম্পিলোব্যাক্টর স্ট্রেন ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে সংক্রমণের হার বেড়েছে এবং জিবিএস কেসও বেড়ে গেছে।’ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি ১০০টি ক্যাম্পিলোব্যাক্টর স্ট্রেনের মধ্যে মাত্র ১টি জিবিএস আক্রান্ত করার ঝুঁকি বহন করে।

জিবিএস সাধারণত হাত ও পায়ে অবশ ভাব বা ঝিঁঝিঁ ধরা অনুভূতি দিয়ে শুরু হয়। এরপর পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে পেশির সংযোগ বা জয়েন্ট নড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। সাধারণত এটি দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে জিবিএস গুরুতর আকার ধারণ করে এবং ধীরে ধীরে হাত ও পায়ে শক্তি কমতে থাকে। জিবিএস-এ মৃত্যুর হার ৩ থেকে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। মৃত্যুহার নির্ভর করে এই রোগের তীব্রতা এবং স্বাস্থ্যসেবার মানের ওপর।

পুনেতে এই প্রাদুর্ভাবের পেছনে ক্যাম্পিলোব্যাক্টর জেজুনি (Campylobacter jejuni) নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। এটি খাদ্যবাহিত সংক্রমণের অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বব্যাপী জিবিএস আক্রমণের সবচেয়ে বড় কারণ এই ব্যাকটেরিয়া।

১৯৯০-এর দশকে চীনের গ্রামীণ এলাকায় এই ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে জিবিএস-এর সম্পর্ক আবিষ্কৃত হয়। সেখানে দেখা যায়, বৃষ্টির মৌসুমে শিশুরা হাঁস-মুরগির বিষ্ঠায় দূষিত পানিতে খেলার কারণে সংক্রমিত হতো। যার ফলে জিবিএস ছড়িয়ে পড়ত।

ভারতে জিবিএস সংক্রমণ পুরোপুরি বিরল ঘটনা নয়। ব্যাঙ্গালোরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস-এর গবেষক মনোজিত দেবনাথ এবং মধু নাগাপ্পা ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পাঁচ বছর ধরে ১৫০ জন জিবিএস রোগীর ওপর গবেষণা করেন।

তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৯ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে আগেও সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে ক্যাম্পিলোব্যাক্টর ব্যাকটেরিয়ারের পাওয়া গেছে। ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সহ-সংক্রমণ পাওয়া গেছে। সহ-সংক্রমণ হলো ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের মধ্যে একটি জটিল পারস্পরিক সম্পর্ক।

সম্প্রতি এই ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কিত প্রাদুর্ভাব বিশ্বজুড়েই দেখা যাচ্ছে। ২০২৩ সালের প্রথম সাত মাসে পেরুতে ২০০টির বেশি সম্ভাব্য জিবিএস কেস শনাক্ত করা হয় এবং অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়। এই পরিস্থিতিতে পেরুর সরকার জাতীয় স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা আরও কঠোর করে। গবেষণায় দেখা গেছে, জিবিএস আক্রান্তদের দুই-তৃতীয়াংশ ক্যাম্পিলোব্যাক্টর দিয়ে সংক্রমিত ছিল।

যেসব দেশে স্বাস্থ্যবিধি ভালো, সেখানে ক্যাম্পিলোব্যাক্টরের কারণে জিবিএস-এর সংখ্যা কম। বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ এসব দেশে জিবিএস-এর প্রধান কারণ। জিবিএস-এর আরও কিছু কারণ রয়েছে। ২০১৫ সালে ব্রাজিলে জিকা ভাইরাস আক্রান্ত বেশ কয়েকজনের মধ্যে জিবিএস শনাক্ত হয়। এছাড়া কিছু ভ্যাকসিনও বিরল ক্ষেত্রে জিবিএস সৃষ্টি করতে পারে। ২০২১ সালে যুক্তরাজ্যে কোভিড ভ্যাকসিনের সঙ্গে কয়েকশো জিবিএস কেসের সংযোগ পাওয়া গিয়েছিল।

আধাসিদ্ধ বা ভালোভাবে রান্না না করা মুরগির মাংস থেকে ছড়াতে পারে জিবিএস

আধাসিদ্ধ বা ভালোভাবে রান্না না করা মুরগির মাংস থেকে ছড়াতে পারে জিবিএসপ্রতীকী ছবি

গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ হিউ উইলিসন বলেছেন, ‘ক্যাম্পিলোব্যাক্টর একটি সাধারণ ব্যাকটেরিয়া, যা সব সময় আমাদের পরিবেশে বিদ্যমান থাকে এবং প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ সংক্রমণ ঘটায়’। তবে, বিজ্ঞানীদের মতে, জিবিএস খুব সহজে হয় না। একটি বিশেষ ধরনের ক্যাম্পিলোব্যাক্টর ব্যাকটেরিয়ার বাইরের স্তরে সুগার কোট বা বিশেষ ধরণের সুগারের প্রলেপ থাকে। কিছু বিরল ক্ষেত্রে এই প্রলেপ মানুষের স্নায়ুকোষের আবরণের মতো হয়। যখন রোগীর রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ব্যাকটেরিয়াটিকে আক্রমণ করে, তখন রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুল করে স্নায়ুকেও আক্রমণ করতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে বলে মলিকিউলার মিমিক্রি। এর ফলেই জিবিএস তৈরি হয়। সব ব্যাকটেরিয়ায় এই আবরণ থাকে না। কেবল নির্দিষ্ট কিছু ক্যাম্পিলোব্যাক্টর স্ট্রেন বা ধরণে এই স্নায়ুর মতো আবরণ থাকে।

বিশ্বের বিরলতম রক্তের গ্রুপ কোনটি

 

অধ্যাপক উইলিসন বলেছেন ‘পুনেতে সম্ভবত এই বিশেষ ধরনের ক্যাম্পিলোব্যাক্টর স্ট্রেন ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে সংক্রমণের হার বেড়েছে এবং জিবিএস কেসও বেড়ে গেছে।’ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি ১০০টি ক্যাম্পিলোব্যাক্টর স্ট্রেনের মধ্যে মাত্র ১টি জিবিএস আক্রান্ত করার ঝুঁকি বহন করে। ওই একটি আবার সংক্রমন করতে পারে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১ জনকে। ফলে সার্বিকভাবে মোট ১০ হাজারে ১ জন জিবিএসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

এই অবস্থাকে অধ্যাপক উইলিসন ‘ইমিউনোলজিক্যাল রাশিয়ান রুলেট’ বলেছেন। এটি এক ধরনের ‘তীব্র স্নায়বিক সুনামি’ সৃষ্টি করে, যা শরীরের পেরিফেরাল নার্ভাস সিস্টেমে আঘাত হানে। যখন শরীরের রোগপ্রতিরোধী প্রতিক্রিয়া কমে আসে, তখন এই আক্রমণ ধীরে ধীরে কমে যায়। তবে শরীরের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সময়, চিকিৎসা ও যত্নের প্রয়োজন হয়। সমস্যা হলো, জিবিএস এর কোনো চিকিৎসা বা নিরাময় নেই।

জিবিএস-এ আক্রান্ত হলে প্রথমে শরীর ক্যাম্পিলোব্যাক্টরের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। পরে স্নায়ুতন্ত্র সংক্রমিত হয়। চিকিৎসকেরা ‘প্লাজমা এক্সচেঞ্জ’ নামে একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যা রক্ত থেকে ক্ষতিকর অ্যান্টিবডিগুলো ফিল্টার করে বের করে দেয়। এছাড়াও ইন্ট্রাভেনাস ইমিউনোগ্লোবুলিন নামক থেরাপিউটিক অ্যান্টিবডি প্রয়োগ করা হয়। এটি আক্রান্ত হয়নি এমন রক্ত থেকে তৈরি করা হয়। এটি রোগের তীব্রতা কমাতে সাহায্য করে।

রক্তের গ্রুপের কি পরিবর্তন হতে পারে?

আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো জিবিএস নির্ণয়ের জন্য কোনো নির্দিষ্ট পরীক্ষা নেই। চিকিৎসকদের মতে, এটি মূলত ক্লিনিক্যাল লক্ষণের ওপর নির্ভর করে শনাক্ত করা হয়। জিবিএস সাধারণত পক্ষাঘাত সৃষ্টি করে। পোলিও, ভাইরাস বা অন্যান্য বিরল স্নায়ুরোগের কারণেও  পক্ষাঘাত হতে পারে।

অধ্যাপক উইলিসন বলেছেন, ‘জিবিএস নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন লক্ষণের মিশ্রণ পর্যবেক্ষণ করা হয়। ফলে ভুল নির্ণয়, দেরিতে শনাক্ত করা বা সম্পূর্ণ ভুল চিকিৎসার সম্ভাবনা থেকেই যায়’।

ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থা একটি বড় সমস্যা তৈরি করছে। বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলের চিকিৎসকেরা জিবিএস সঠিকভাবে শনাক্ত করতে হিমশিম খান। এ কারণেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দল পুনেতে কাজ করছে। যেখানে তাঁরা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে মিলে আক্রান্তদের চিহ্নিত, পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ করছেন। পাশাপাশি, সংক্রমণের প্রবণতা বিশ্লেষণ করে কার্যকর চিকিৎসার কৌশল নির্ধারণের চেষ্টা চালাচ্ছেন।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাঁরা ৬০ হাজারের বেশি বাড়ি পর্যবেক্ষণ করেছে। ১৬০টি পানির নমুনা পরীক্ষার জন্য সংগ্রহ করেছে। জনগণকে ফোটানো পানি পান করতে বলা হয়েছে। তাজা ও পরিষ্কার খাবার খেতে বলা হয়েছে। বাসি বা আধাসেদ্ধ মাংস (মুরগি বা খাসি) না খেতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশ্বের বেশিরভাগ জিবিএস সংক্রমণ আধাসিদ্ধ বা ভালোভাবে রান্না না করা মুরগির মাংস থেকে হয়। তবে এটি পানির মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। ঠিক যেমন কলেরা বা সালমোনেলার সংক্রমণ ঘটে। দূষিত পানি দিয়ে রাস্তার খাবার ধোয়া বা প্রস্তুত করলে ব্যাকটেরিয়া সহজেই ছড়াতে পারে।

পুনেতে নিশ্চিতভাবে একটি বিশেষ ক্যাম্পিলোব্যাক্টর স্ট্রেন ছড়িয়ে পড়েছে। যার বিশেষ মলিকুলার বৈশিষ্ট্য আছে। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে বহু মানুষ সংক্রমণের শিকার হচ্ছে। তবে এখনো সঠিকভাবে জানা যায়নি, এটি অনেক বেশি পরিমাণে পানির দূষণের কারণে হয়েছে, নাকি অনেক মানুষ সংক্রমিত মুরগির মাংস খেয়েছেন।

 

শেয়ার করুন