যুক্তরাষ্ট্রের ২ হাজার বছরের পুরোনো রহস্যময় নিদর্শন
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 10-04-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

মানুষের হাতে গড়া দুই হাজার বছরের পুরোনো এক নিদর্শন। তবে কারা এটি নির্মাণ করেছিল, তা আজও এক রহস্য। এ ব্যাপারে কোনো লিখিত নথি নেই। প্রাচীন এই নিদর্শনটি এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এটিকে আবারও জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। এর নাম দ্য অক্টাগন। এখানে মাটির ঢিবি রয়েছে, পুরো স্থানটি মাটির বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা।

উন্মুক্ত করার পর জায়গাটি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ব্র্যান্ডন উইথরো। সে অভিজ্ঞতা নিয়ে বিবিসিতে একটি নিবন্ধ লিখেছেন তিনি।

উইথরো লিখেছেন, একজন গাইডের সাহায্য নিয়ে তিনি এবং আরও বেশ কয়েকজন পর্যটক ওই স্থানটি পরিদর্শনে যান। তাঁরা যখন ঘাসে ছেয়ে থাকা একটি মাটির ঢিবির ওপর দিয়ে হাঁটছিলেন, তখন শরতে ঝরে পড়া পাতাগুলো তাঁদের পায়ের নিচে পড়ে শব্দ করছিল। এরপর তাঁরা একটি বৃত্তাকার জায়গার প্রবেশপথে পৌঁছান। মাটির দেয়ালের বেষ্টনী দিয়ে বৃত্তাকারটি তৈরি করা হয়েছে।

হোপওয়েল সেরেমোনিয়াল আর্থওয়ার্কসের অংশ এটি। হোপওয়েল সেরেমোনিয়াল আর্থওয়ার্কস হলো মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলীয় ওহাইওজুড়ে বিস্তৃত হাতে তৈরি টিলার একটি বিশাল নেটওয়ার্ক।

 

 

দ্য অক্টাগন তৈরি হয়েছে দুই হাজার বছর আগে। সম্ভবত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষেরা শত শত মাইল দূর থেকে মাটির প্রাচীর বেষ্টিত স্থান দ্য অক্টাগনে আসতেন। আচার-অনুষ্ঠান ও উপাসনার অংশ হিসেবে তাঁরা সেখানে নিয়মিত জমায়েত করতেন।

সাংবাদিক ব্র্যান্ডন উইথরোর গাইডের নাম ছিল ব্র্যাড লেপার। তিনি ওহাইও হিস্ট্রি কানেকশনস ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ প্রোগ্রামের (ওএইচসি) প্রত্নতাত্ত্বিক। বৃত্তাকার স্থানটিকে দেখিয়ে তিনি বলেন, ওই স্থানটিতে কোনো ধরনের শুদ্ধিকরণের জায়গা ছিল। উইথরো তখন ভেতরে তাকিয়ে দেখেন, সেখানে নিখুঁতভাবে সাজানো সবুজে ঘেরা একটি লন দেখা যাচ্ছে।

১৯১০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অক্টাগনকে গলফ কোর্স হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে এক শতাব্দীরও বেশি সময় পর ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রাচীন ও রহস্যময় এ স্থানটিকে আবারও জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

ওহাইওতে প্রাগৈতিহাসিক এসব মাটির কাজগুলো এখন হোপওয়েল কালচার হিসেবে পরিচিত। হোপওয়েল কালচার হলো নেটিভ আমেরিকান সমাজের একটি নেটওয়ার্ক, যা খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ১০০ বছর থেকে ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মন্টানা এবং মেক্সিকো উপসাগরের মতো দূরের জায়গাগুলো থেকে একত্র হয়েছিল। হোপওয়েল কালচার একাধিক বাণিজ্য রুট দিয়ে সংযুক্ত ছিল। ওহাইওতে তাদের হাতে তৈরি মাটির ঢিবি দিয়ে ঘেরা স্থানগুলোর আকৃতি বিভিন্ন রকমের। এর কোনোটি বৃত্তাকার, কোনোটি বর্গাকার আবার কোনোটি অষ্টভুজ আকৃতির। এগুলো অনেকটাই একটি অপরটির সঙ্গে যুক্ত। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সবে এখন এই প্রকৌশল বিস্ময় সম্পর্কে বুঝতে শুরু করেছেন।

 

আশ্চর্যজনকভাবে গাণিতিক ও জটিল জ্যোতির্বিদ্যাকে ব্যবহার করে নির্মিত নিদর্শনগুলো বিশ্বের বৃহত্তম জ্যামিতিক আকৃতির মাটির কাজের নিদর্শন। এগুলো দুর্গ বা প্রতিরক্ষামূলক কাঠামো হিসেবে নির্মিত হয়নি।

২০২৩ সালে হোপওয়েলের আটটি মাটির দেয়াল বেষ্টিত এলাকাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেসকো। এর মধ্যে আছে—ওহাইওর নিউআর্কে অবস্থিত দ্য অক্টাগন ও দ্য গ্রেট সার্কেল, ওহাইওর ফোর্ট অ্যানসিয়েন্ট। অপর পাঁচটি জায়গা হোপওয়েল কালচার ন্যাশনাল হিস্টোরিক্যাল পার্কের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো হলো—মাউন্ড সিটি, হোপটন আর্থওয়ার্কস, হাই ব্যাংক ওয়ার্কস, হোপওয়েল মাউন্ড গ্রুপ এবং সিপ আর্থওয়ার্কস।

লেপারের ভাষ্যমতে, দ্য অক্টাগন এবং দ্য গ্রেট সার্কেল একসময় সাড়ে চার বর্গমাইল বিস্তৃত একটি বৃহত্তর ও একক হোপওয়েল কমপ্লেক্স ছিল। এগুলো মাটির ঢিবির দেয়ালে ঘেরা কয়েকটি রাস্তা দিয়ে সংযুক্ত ছিল। গ্রেট সার্কেলে হোপওয়েল সেরেমোনিয়াল আর্থওয়ার্কের জাদুঘরটি অবস্থিত। গ্রেট সার্কেলের ব্যাস ১ হাজার ২০০ ফুট। এর দেয়াল ১৪ ফুট উঁচু।

দ্য অক্টাগন এবং দ্য গ্রেট সার্কেল একসময় সাড়ে চার বর্গমাইল বিস্তৃত একটি বৃহত্তর ও একক হোপওয়েল কমপ্লেক্স ছিল

দ্য অক্টাগন এবং দ্য গ্রেট সার্কেল একসময় সাড়ে চার বর্গমাইল বিস্তৃত একটি বৃহত্তর ও একক হোপওয়েল কমপ্লেক্স ছিলছবি: হোপওয়েল সেরেমোনিয়াল আর্থওয়ার্ক

গ্রেট সার্কেল একসময় একটি বর্গক্ষেত্র এবং একটি সমাধিক্ষেত্রের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। বর্গক্ষেত্রের কেবল একটি অংশ আজও দৃশ্যমান। আর দ্য অক্টাগন ৫০ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। এটি ২০ একর অবজারভেটরি সার্কেলের সঙ্গে সংযুক্ত। অবজারভেটরি সার্কেল হলো মাটি দিয়ে তৈরি বিশাল এক বৃত্ত, যা রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণসংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠানের জন্য নির্মিত হয়েছে।

লেপার আরও বলেন, ২০০০ বছর আগে আদিবাসী শ্রমিকেরা আধুনিক সরঞ্জাম ছাড়াই এই মাটির কাজগুলো করত। সূক্ষ্ম লাঠি দিয়ে মাটি খুঁড়ে বেতের ঝুড়িতে ভরে তা পিঠে করে বহন করত। ধারণা করা হয়, তারা সাত মিলিয়ন ঘনফুট মাটি সরিয়ে নিয়েছিল।

হোপওয়েল কালচারের জ্যামিতিক ও গাণিতিক জ্ঞান গবেষকদের অবাক করে দিয়েছে।

হোপওয়েল কালচারের বিষয়ে কোনো লিখিত নথি না থাকায় সেখানকার মাটির কাজগুলো এবং সেখান থেকে উদ্ধার হওয়া কিছু জিনিসপত্র তাদের সর্বশেষ সাংস্কৃতিক নমুনা হিসেবে কাজ করছে। কিছু কিছু স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ এখনো চলছে।

বছরের পর বছর ধরে দ্য অক্টাগনের নিয়ন্ত্রণে ছিল মাউন্ডবিল্ডার্স কান্ট্রি ক্লাব। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোচনার পর অবশেষে ২০২৪ সালে হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির কাছে অক্টাগনের দীর্ঘমেয়াদি ইজারা হস্তান্তরের জন্য ওএইচসি এবং ক্লাব একটি চুক্তিতে পৌঁছায়। এর মধ্য দিয়ে এই জানুয়ারি থেকে দর্শনার্থীদের জন্য প্রাচীন এ স্থানটি উন্মুক্ত করে দেওয়ার পথ সুগম হয়।

৫০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে হোপওয়েলকালচার ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে শুরু করার পর অন্য আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষেরা স্থানটির দেখভাল শুরু করেছিল। এই গোষ্ঠীগুলোর একটি হলো শাওনি। ১৮৩০-এর দশকে মিসিসিপি নদীর পশ্চিমে জোরপূর্বক উৎখাত হওয়ার আগে পর্যন্ত এ গোষ্ঠীর মানুষেরা ওহাইওকে নিজেদের আবাসস্থল বলে উল্লেখ করত।

ওকলাহোমার শাওনি আদিবাসী গোষ্ঠীর গ্লেনা ওয়ালেস বলেন, ‘আমরা হয়তো এগুলো নির্মাণ বা তৈরি করিনি, তবে আমি জানি আমার পূর্বসূরিরা সেখানে থাকতেন। আমার পূর্বসূরিরা এগুলোর সুরক্ষা দিতেন ও সম্মান করতেন।’

ওয়ালেস মনে করেন, ভবিষ্যতে হোপওয়েল আর্থওয়ার্কসের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং এর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তুলে ধরতে অন্য আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোরও এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

ওয়ালেস বলেন, ‘আমি শুধু চাই, মানুষ এটা সম্পর্কে জানুক। এটাকে দেখার সুযোগ পাক। আমি চাই মানুষ স্থানটি পরিদর্শনের সুযোগ পাক এবং এটিকে একটি সংস্কৃতিগত বিষয় হিসেবে উপলব্ধি করুক। এটি অমূল্য।’

 

 

 

শেয়ার করুন