নিজের লোকদের শেষ কোনো বার্তা দেওয়ার সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এর আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে। দেশটির একটি বিমানঘাঁটি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় কেউ যাতে তাঁর অবস্থান শনাক্ত করতে না পারে, সে জন্য বিমানের ট্রান্সপন্ডার ইচ্ছাকৃতভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। দেশছাড়ার কাজটি এতটাই গোপনে করা হয়েছিল যে এ ব্যাপারে নিজের ভাইকেও কোনোকিছু জানানো হয়নি।
এক দশক আগে যখন গৃহযুদ্ধে প্রায় পরাজয়ের মুখে, তখন রুশ সামরিক শক্তির হস্তক্ষেপে শেষ রক্ষা হয় স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদ সরকারের। গৃহযুদ্ধে তিনি বিদ্রোহীদের সহিংসভাবে দমনের চেষ্টা করেন। তবে এবার বিদ্রোহীরাই উল্টো দেশছাড়া করেছেন তাঁকে। আর যোদ্ধারা সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ঢোকার সময় আসাদকে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া।
ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, প্রথমে দেশ ছাড়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না বাশার আল-আসাদের। পরে রাশিয়ার কর্তৃপক্ষের পরামর্শে তিনি দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। রুশ গোয়েন্দারা তাঁর মস্কোতে পালানোর সব বন্দোবস্ত করেছিলেন।
বাশারের জন্য সব সময়ই পালানোর জায়গা ছিল সীমিত। আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিচ্ছিন্ন সাবেক এ সিরীয় প্রেসিডেন্টের দুটি প্রধান মিত্রদেশ ছিল রাশিয়া ও ইরান। দুই দেশই ছিল আশ্রয় নেওয়ার জন্য তাঁর একমাত্র ভরসা।
পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, আশ্রয় নেওয়ার জন্য মস্কোকে বেছে নেওয়ার মাধ্যমে আসাদ মূলত তাঁর খরচে স্বভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জায়গাটিকে বেছে নিয়েছেন। পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে তিনি ভূরাজনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল দেশকে আশ্রয়স্থল হিসেবে বাছাই করেছেন।
টেক্সাসের ট্রিনিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডেভিড লেসের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নানা সময় বাশার আল-আসাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আসাদ ও তাঁর পরিবার আলাউতি সম্প্রদায়ের হলেও বস্তুত তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ। আর এ কারণে আশ্রয়স্থল হিসেবে ইরানের তুলনায় রাশিয়াই ছিল তাঁদের জন্য বেশি পছন্দসই জায়গা।’
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। তবে যাঁরা বাশার আল-আসাদের বিচার চান, তাঁদের কাছে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে রাশিয়ার ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।
লেস বলেন, ‘বিচারের জন্য দেশে ফিরিয়ে আনা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যেকোনো প্রচেষ্টা থেকে বাশার আল-আসাদ ও তাঁর পরিবারকে রাশিয়াই সবচেয়ে বেশি সুরক্ষা দিতে পারবে বলে মনে করেছেন ক্ষমতাচ্যুত এই স্বৈরশাসক।’
লেসের মতে, রাশিয়া সম্ভবত আসাদের স্ত্রী আসমার জন্য উন্নত চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করতে পারে। গত মে মাসে আসমা লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। আসমার জন্ম ব্রিটেনে ও সেখানেই বেড়ে ওঠা। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, ব্রিটিশ শিক্ষা ও পশ্চিমা শৈলী ব্যবহার করে ভিন্নমতের বিরুদ্ধে তাঁর স্বামীর নৃশংসতাকে ঢাকার চেষ্টা করেছেন তিনি।
আসাদের পরিবারের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ১৯৭০–এর দশক থেকে। তখন তাঁর বাবা হাফিজ আল-আসাদ সোভিয়েত বলয়ের অধীন সিরিয়ার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছিলেন।
২০১৫ সালে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বাশার আল-আসাদের পক্ষে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার পর দুই দেশের সম্পর্ক আরও জোরদার হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে সিরিয়ার অন্যান্য অভিজাতের সন্তানদের সঙ্গে আসাদের সন্তানেরা রাশিয়ার অধিভুক্ত ক্রিমিয়া অঞ্চলে গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পগুলোতে অবকাশ যাপন করতেন। আসাদের বড় ছেলে হাফিজকে রাশিয়ার নামকরা এমজিআইএমও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল। এরই মধ্যে আসাদের ঘনিষ্ঠ স্বজনেরা ধীরে ধীরে মস্কোর নামকরা স্কাইস্ক্র্যাপার ডিস্ট্রিক্টে কয়েক মিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পত্তি কিনে নেন।
কিন্তু মস্কোর ওপর সিরিয়ার ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা সত্ত্বেও আসাদ ও পুতিনের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল সব সময়ই শীতল। রুশ প্রেসিডেন্ট বিশ্বের কিছু নেতার সঙ্গে অকৃত্রিম সম্পর্ক গড়ে তুললেও আসাদকে রেখেছিলেন হাতের মুঠোয়। পুতিন ও আসাদ বছরের পর বছর ধরে একে অন্যের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করে চলছিলেন। আসাদ তাঁর দেশের সংস্কার কিংবা বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর ক্ষেত্রে ন্যূনতম ছাড় দিতেন না। এ কারণে প্রায়ই তাঁর ওপর হতাশ হয়ে পড়ত মস্কো।
আসাদের পতনের পর রাশিয়া ভিন্ন রূপ দেখাতে শুরু করে। নিজের পরাজয়ের জন্য আসাদ নিজেই দায়ী—এমন একটি বয়ানের ওপর জোর দিতে থাকে দেশটি। ক্রেমলিন বলেছে, আসাদকে তাঁর দেশ থেকে সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত ছিল পুতিনের একান্ত ব্যক্তিগত।
রাশিয়ার সাবেক এক কূটনীতিক বলেছেন, ২০১১ সালে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে দেশটির তৎকালীন নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে হত্যার ভিডিও রুশ কর্মকর্তাদের এবং স্বয়ং পুতিনের মনে দাগ কেটেছিল। তিনি বলেন, ‘এমনকি পুতিন আসাদকে অপছন্দ করলেও তিনি কখনোই তাঁকে বিদ্রোহীদের হাতে ছেড়ে দিতেন না।’
রাশিয়ার রাজধানীতে রাজনৈতিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক অবস্থানে থাকার পরও যত দিন পুতিন ক্ষমতায় আছেন, তত দিন আসাদ সুরক্ষার পাশাপাশি আয়েশি জীবন যাপন করতে চাইবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু মনে হচ্ছে, আসাদ ও তাঁর পরিবার মস্কোতে প্রকাশ্যে এবং বিলাসবহুলভাবে জীবন যাপন করতে পারবেন না; বরং রাশিয়ার নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের কঠোর নজরদারির মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো বাড়িতে সম্ভবত লুকিয়ে ও জনসাধারণের দৃষ্টির আড়ালে থাকবে।
মস্কোর ফুটবল দল স্পার্টাকের সাবেক ফুটবলার কুইন্সি প্রমস থেকে শুরু করে গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার নায়ক এডওয়ার্ড স্নোডেনসহ পলাতক ব্যক্তিদের জন্য স্বর্গে পরিণত হয়েছে রাশিয়া। কিন্তু আসাদের ভাগ্য হতে যাচ্ছে অনেকটাই ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের মতো। তিনি ২০১৪ সালে বিপ্লবের সময় ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে মস্কোর একটি অভিজাত শহরতলিতে কয়েক মিলিয়ন ডলারের ভবনে বসবাস করছেন।
রাশিয়ায় লম্বা সময় ধরে অবস্থান করার জন্য বাশার আল-আসাদ হয়তো বিভিন্ন দেশে তাঁর থাকা ব্যাংক হিসাব এবং জ্বালানি কোম্পানি শেল করপোরেশনে লুকিয়ে রাখা ২০০ বিলিয়ন ডলার থেকে কিছু অর্থ ওঠাতে সক্ষম হবেন।
রাশিয়া আপাতত আসাদের বিষয়ে চুপ থাকবে বলেই মনে হচ্ছে, যাতে বৈশ্বিক অঙ্গনে এমন কোনো কথা না ওঠে যে দেশটি এমন একজন নেতাকে আশ্রয় দিয়েছে; যিনি কিনা ভীষণ রকমের কর্তৃত্ববাদী ছিলেন ও ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এখনো দেশটির ভেতরে তোলা আসাদের কোনো ছবি প্রকাশ করেনি। আর এটি এ ইঙ্গিত দেয় যে মস্কো চায় না, বাশার আল-আসাদ খবরের শিরোনাম হন। কারণ, দেশটি সিরীয় বিদ্রোহীদের নতুন সরকারের সঙ্গেও সম্পর্ক তৈরি করতে চায়।
সিরিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডেভিড লেস বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, আসাদ সম্ভবত বাকি জীবন নিভৃতেই কাটিয়ে দেবেন। সিরিয়া বা অন্য কোথাও তাঁর কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা দেখছি না।’