‘বানিয়াসে আমার বন্ধুর বাগ্দত্তাকে গুলি করা হয়েছে। তারা [অস্ত্রধারীরা] কাউকে তাঁকে সহায়তা করতে দেয়নি। ফলে রক্তক্ষরণ হয়ে তিনি মারা যান। তাঁকে এখনো কবর দেওয়া যায়নি।’ সিরিয়ার লাতাকিয়া শহরের তারতুসের কাছাকাছি এলাকায় চলমান হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী।
অস্ত্রধারীরা ঘরে ঘরে ঢুকে মানুষ হত্যা করছে জানিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘বুস্তান আল-বাশা গ্রামে আমার চাচি থাকেন। তাঁর সব প্রতিবেশীকে হত্যা করা হয়েছে।’
নিজেদের সিরিয়ার বর্তমান শাসকগোষ্ঠী হায়াত আল-শামের (এইচটিএস) যোদ্ধা দাবি করা এসব অস্ত্রধারী ওই প্রত্যক্ষদর্শীর বাসায়ও তল্লাশি করেন। তাঁদের মহল্লা থেকে সাকল্যে ২০টি গাড়ি নিয়ে যান।
এই নারী প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, অস্ত্রধারীরা নিজেদের এইচটিএসের যোদ্ধা দাবি করলেও তা সত্যি নয়। তারা ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর’ সদস্য।
‘যে ব্যক্তিই পালাতে চেষ্টা করেছেন বা যাঁকে সন্দেহজনক মনে করছে, তাঁকেই তারা হত্যা করছে,’ বলেন তিনি।
বাশারপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে লাতাকিয়ায় যাচ্ছেন সরকারি বাহিনীর সদস্যরা। ৬ মার্চ ২০২৫ছবি: এএফপি
কিছু সাধারণ নাগরিক লাতাকিয়ায় অবস্থিত রাশিয়া পরিচালিত হমেইমিম বিমানঘাঁটিতে পালিয়ে আশ্রয় নিতে সক্ষম হন। কিন্তু বিমানঘাঁটিতে যাওয়ার পথে তল্লাশিচৌকিতে সশস্ত্র গোষ্ঠীর লোকজন অবস্থান করছিলেন। এই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘তল্লাশিচৌকিতে তাঁদের কাছে প্রথমেই জানতে চাওয়া হয়েছিল, তাঁরা আলাউইত সম্প্রদায়ের কি না।’
গত বৃহস্পতিবার সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় শহর লাতাকিয়া ও তারতুসে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগত যোদ্ধারা সমন্বিতভাবে হামলা শুরু করে। বর্তমান সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর গুপ্ত হামলা চালানো হয়।
সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো দ্রুত পাল্টা হামলা শুরু করে। সঙ্গে নতুন সরকারের প্রতি অনুগত বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদেরও এই অভিযানে যুক্ত করা হয়।
গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলের দিকে হাজার হাজার সরকারি বাহিনীর সদস্য পাঠানো হয়েছে। বাশারপন্থীদের দমনে তাঁরা হেলিকপ্টার গানশিপ, ড্রোন ও কামান ব্যবহার করছেন। একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, নিরাপত্তা বাহিনীর পাল্টা হামলা ‘প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ডে’ রূপ নিয়েছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের (এসওএইচআর) তথ্যমতে, শুক্রবার পর্যন্ত দুই দিনে সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে এক হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
এসওএইচআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাতাকিয়া ও তারতুসে তিন দিনে আলাউইত সম্প্রদায়ের অন্তত ৭৪৫ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। একই সঙ্গে সেখানে বাশারপন্থী ১৪৮ যোদ্ধাকেও হত্যা করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সিরিয়ার নতুন সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য রয়েছেন প্রায় ১২৫ জন।
সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা। রাজধানী দামেস্কে একটি আলোচনায়, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ছবি: রয়টার্স
বাশারপন্থী যোদ্ধারা আলাউইত সম্প্রদায়ের সদস্য। এটি শিয়া ধর্মাবলম্বীদের একটি শাখা। সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় অঞ্চলেই এই সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ মানুষ বাস করেন। বাশার আল-আসাদের পরিবারও এই সম্প্রদায়ের। কিন্তু এই সম্প্রদায়ের অধিকাংশের সঙ্গে বাশার পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর বাশার সরকারের পতনের পর থেকে এই সম্প্রদায়ের মানুষকে হামলার লক্ষ্য বানানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংঘাত এখনো পুরোপুরি থামেনি। রোববার সংঘাত চতুর্থ দিনে প্রবেশ করেছে। এদিন রাজধানী দামেস্কের মাজ্জাহ পাড়ায় একটি মসজিদে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান আহমেদ আল-শারা সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের জাতীয় ঐক্য ও দেশের শান্তি রক্ষা করতে হবে। আমরা মিলেমিশে বাস করতে পারি। সিরিয়ায় বর্তমানে যেসব ঘটনা ঘটছে, সেগুলো যেসব চ্যালেঞ্জ আসবে বলে আগে ধারণা করা, হয়েছিল তারই অংশ।’ সাধারণ মানুষকে যারা নিশানা করছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আল-শারা।