আলজেরিয়ায় ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফায় ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট (এফআইএস) বড় ধরনের বিজয় পায়। দ্বিতীয় ও শেষ দফার নির্বাচন ছিল ১৬ জানুয়ারি। কিন্তু এর আগেই দেশটির সেনাবাহিনী নিজেদের নিয়ন্ত্রিত সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে ঘোষণা দেয়, এই নির্বাচনপ্রক্রিয়া চালানো অসম্ভব।
সেনাবাহিনীর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে আলজেরিয়ায় একটি অর্থহীন যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল অভিজাততন্ত্রের স্বার্থ রক্ষা করে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতা দখল। আর এর শিকার হয়েছিলেন মোহাম্মদ বউদিয়াফ। ১৯৯২ সালের ২৯ জুলাই বক্তৃতা দেওয়ার সময় দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন এই প্রেসিডেন্ট।
এ ঘটনার বিস্তারিত জানা যায় মোহাম্মদ সামরাউইয়ের লেখা ‘ক্রনিকেল অব দ্য ইয়ার্স অব ব্লাড আলজেরিয়া’ বইয়ে। সামরাউই ছিলেন সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা শাখার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট চাদলি বেনজেদিদকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে সংঘটিত অভ্যুত্থানে তিনিও অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে দেশ ছেড়ে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন তিনি।
সামরাউই তাঁর বইয়ে লিখেছেন, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আলজেরিয়ার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সংঘটিত অনেক হত্যাকাণ্ডের তথ্য তাঁর হাতে এসেছে।
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনের সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন চাদলি বেনজেদিদ। পরের বছর ১১ জানুয়ারি তাঁকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। আর এই অভ্যুত্থানকে আইনি রূপ দিতে ১২ জানুয়ারি পদক্ষেপ নেয় সেনাবাহিনী। তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিষদ (এইচসিএস) ‘ঘোষণা’ দেয় এই নির্বাচনপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা অসম্ভব।
ওই ঘোষণার দুই দিন পর এইচসিএস সিদ্ধান্ত নেয় আগামী দুই বছর দেশটি পরিচালনা করবে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এইচসিই (হাউত কমিটে ডি ইটাত)। এর প্রধান হবেন বউদিয়াফ। তিনি ১৬ জানুয়ারি দেশে ফিরবেন। এই তারিখে তাঁর দেশে ফেরা কোনো কাকতালীয় বিষয় ছিল না। কারণ, সেদিন ছিল দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের তারিখ।
সেই বছরের ১০ জানুয়ারি জেনারেলদের নির্দেশে আলী হারুন নামে একজন বউদিয়াফের সঙ্গে দেখা করতে মরক্কো যান। বউদিয়াফকে দেশে ফিরিয়ে আনতে রাজি করানোই ছিল উদ্দেশ্য।
মোহাম্মদ বউদিয়াফের জন্ম ১৯১৯ সালের ২৩ জুন, আলজেরিয়ার মসিলা শহরে। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফরাসি সেনাদের হয়ে লড়াই করেছেন। কিন্তু ১৯৫০ সালে তিনি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টে (এফএলএন) আহমেদ বেন বেলার সঙ্গে যোগ দেন। ১৯৫৬ থেকে ’৬২ সাল পর্যন্ত ফরাসিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশকে স্বাধীন করেন তাঁরা।
এরপর নতুন অস্থায়ী সরকারের প্রেসিডেন্ট হন বেন বেলা আর বউদিয়াফ ছিলেন উপপ্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তিনি বেন বেলার স্বৈরশাসন মেনে নিতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে তিনি বেশ কয়েক মাস কারাবন্দী থাকার পর নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। ১৯৬৩ সালে তিনি মরক্কো চলে যান। সেখানে তিনি ইট-কারখানা গড়ে তুলেছিলেন। তবে তিনি দেশের বাইরে থেকেও এফএলএন দলের নেতাদের নানা দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার ছিলেন।
সেনাবাহিনী বউদিয়াফকে ‘সাজানো’ প্রধান হিসেবে দেখতে চাইলেও তাঁকে তারা ‘হাতের পুতুল’ বানাতে পারেনি। এ কারণেই ২৯ জুন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মেদ বউদিয়াফ আন্নাবাতে একটি সরকারি সফরে বক্তৃতা করার সময় তাঁর দেহরক্ষীর হাতে নিহত হন। এটি ছিল রাজধানীর বাইরে তাঁর প্রথম সরকারি সফর।
সামরাউই বইতে লিখেছেন, ‘হত্যাকারী ছিলেন ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের (ডিআরএস) স্পেশাল ইন্টারভেনশন গ্রুপের (সিআইএস) সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট লেম্বারেক বউমারাফি; যিনি আবদেলহাক নামে পরিচিত ছিলেন। আন্নাবাতে সেই অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা দলের সঙ্গে শেষ মুহূর্তে তিনি যোগ দিয়েছিলেন।
এর কিছুদিন আগে জিআইএফ-এর প্রধান মেজর বেলুইজা হামাউ স্বাক্ষরিত একটি ব্যক্তিগত মিশনের আদেশের কপি পেয়েছিলেন ডিআরএসের কাউন্টার-স্পাইনেজ ডিরেক্টরেটের (ডিসিই) প্রধান স্মাইন লামারি। এরই ধারাবাহিকতাতেই বউমারাফিকে সেই নিরাপত্তা দলে নেওয়া হয়।
বউদিয়াফ হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী জেনারেল তৌফিক, স্মাইন লামারি এবং লারবি বেলখেইর ছিলেন বলে দাবি করেন সামরাউই।
ভূমধ্যসাগরীয় বন্দরনগরী আন্নাবাতে প্রেসিডেন্ট বউদিয়াফের অনুষ্ঠানস্থলে হট্টগোল তৈরি করতে গ্রেনেড ছুড়ে মারেন বউমারাফি। এরপর তিনি পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে প্রেসিডেন্টকে গুলি করেন। সেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অস্ত্র ফেলে দেয়াল টপকে ৪০০ মিটার দূরে এক বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। সেখান থেকে নিজেই ফোন করে পুলিশের হাতে নিজেকে তুলে দেন।
আলজেরিয়ার বার্তা সার্ভিসেস এপিএস জানিয়েছিল, বক্তব্য দেওয়ার সময় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে প্রেসিডেন্টকে দুবার গুলি করা হয়। যিনি গুলি করেন তাঁর পরনে ছিল দাঙ্গা স্কোয়াড বাহিনীর পোশাক। তাদের ভাষ্য ছিল, বউদিয়াফের দেহরক্ষীরা হামলাকারীকে হত্যা করেছে। তবে ক্ষমতাসীন হাই স্টেট কমিটি পরে জানিয়েছে, হামলাকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঘটনার দিন আলজেরিয়ার টেলিভিশনের ফুটেজে দেখানো হয়, বউদিয়াফকে স্ট্রেচারে করে মিলনায়তন থেকে বের করে আনা হচ্ছে। তখনো তিনি বেঁচে ছিলেন। এরপর মিলনায়তনে দ্বিতীয়বার গুলির শব্দ পাওয়া যায়। বউদিয়াফের গায়ে যখন গুলিটি লাগে, তখন তিনি জীবনের উপলব্ধি নিয়ে কথা বলছিলেন। তখন তিনি বলছিলেন, ‘আমরা জানি, জীবন খুব ছোট। আমাদের সবাইকে মরতে হবে।’
ঘটনার তিন সপ্তাহ পর যুক্তরাজ্যের দৈনিক দ্য ইন্ডিপেনডেন্টের এক খবরে বলা হয়েছিল, বউদিয়াকে তিনটি গুলি করা হয়েছিল। এর মধ্যে দুটি তাঁর মাথায় ও একটি পিঠে লাগে। সেই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সেই বছরের জানুয়ারিতে পার্লামেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় ও শেষ ধাপেও ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্টের জয় ছিল নিশ্চিত। নির্বাচন বাতিল করে বউদিয়াফকে ক্ষমতায় আনার কারণে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে এই দলটির হাত ছিল বলে প্রথমে সন্দেহ করা হয়েছিল। বিশেষ করে এই দলের সমর্থক, যাঁরা দেশের বাইরে ছিলেন, তাঁরা এই হত্যাকাণ্ডে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।
এরপর বউদিয়াফের হত্যাকাণ্ডের কিছু ভিডিও টেপ দেখে নিশ্চিত হওয়া যায়, এখানে কর্তৃপক্ষের হাত আছে। কারণ, ভিডিও ফুটেজে কিছু কাটছাঁট করা হয়েছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ঘটনার সময় চারটি টেলিভিশনের ক্যামেরা দৃশ্য ধারণ করেছিল।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন আলজেরিয়ান টেলিভিশন সার্ভিসের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র ইন্ডিপেনডেন্টকে নিশ্চিত করেছে, ক্যামেরাগুলোতে হত্যার পুরো ঘটনাই ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু বউদিয়াফের গায়ে যখন গুলি লাগে কিছু দৃশ্য কেটে দেওয়া হয়েছে। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, তাঁর মাথায় গুলি লাগার পর মগজ ছিটকে বেরিয়ে আসে।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, বউমারেফকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এই ভিডিওতে বউমারেফ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কিছু কথা বলেন। কিন্তু সেসব কথা শুনলে তিনি জাতির কাছে নায়কে পরিণত হতে পারেন, এমন ভয়ে তা প্রচার করা হয়নি।
নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়, রাজধানী আলজিয়ার্সের শহরতলির আইন নাদজা সামরিক হাসপাতালের চিকিৎসকেরা এপিকে জানিয়েছিল, বউদিয়াফকে চিকিৎসার জন্য এখানে আনা হয়েছিল। তখনো তিনি বেঁচে ছিলেন। অথচ সরকারি বেতারে বেলা ১টায় ঘোষণা করেছিল, প্রেসিডেন্ট মারা গেছেন। কিন্তু তিনি এই ঘোষণার তিন ঘণ্টা পর মারা যান।
সামরাউই ওই ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা বিশ্লেষণ করে দেখেন, প্রেসিডেন্টের গার্ডে ৫৬ জন সদস্য ছিলেন। কিন্তু একজনও এই ঘটনায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। হঠাৎ বিশৃঙ্খল অবস্থায় সামনের দিকে থাকা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ভড়কে যেতে পারেন। কিন্তু পেছনের দিকে যাঁরা ছিলেন, ভবনের বাইরে যাঁরা ছিলেন, বহিরাগমন ফটকে যাঁরা ছিলেন—তাঁরা কেউ কোনো পদক্ষেপ নেননি। অথচ এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তাঁরা বেশ ভালোভাবেই প্রশিক্ষিত।