ফিলিস্তিনে অবৈধ ইহুদি বসতির ‘গডমাদার’, গাজায় বসতি নিয়ে কী তাঁর ভাবনা
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 28-05-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের নেত্রী ড্যানিয়েলা ওয়েইস সব সময়ই একজন জায়নবাদী। ৭৯ বছর বয়সী ড্যানিয়েলা নিজেই টেলিফোনে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইকে বলেন, ‘জায়নবাদ ছিল আমাদের পারিবারিক আলোচনার মূল বিষয়।’

ড্যানিয়েলা বসবাস করেন ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের উত্তরে অবস্থিত একটি অবৈধ ইহুদি বসতিতে।

ড্যানিয়েলা বলেন, ‘আমি গর্বিত যে ঈশ্বর আমাকে একজন ইহুদি হিসেবে পাঠিয়েছেন। আমাদের মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা, বাইবেলের প্রতি ভালোবাসা, ঈশ্বর আমাকে এই অপার আশা ও আত্মবিশ্বাস দিয়েছেন, যা অন্য কিছুর সঙ্গে বদলানো যায় না।’

এই উগ্র জায়নবাদী ড্যানিয়েলা ইহুদি বসতি আন্দোলনের এক পরিচিত মুখ। তিনি নিজেই বলেছেন, ৫০ বছর ধরে তিনি ‘ইসরায়েলের ভূমি গড়ে তোলার কাজে নিবেদিত’। তিনি দাবি করেন, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর অধিকৃত পশ্চিম তীরে গড়ে ওঠা ১৪১টি বসতি ও ২২৪টি অবৈধ চৌকি গঠনে তাঁর ভূমিকা রয়েছে।

 

 

গত মাসে ড্যানিয়েলা বিবিসির লুইস থেরাউক্সের তৈরি প্রামাণ্যচিত্র ‘দ্য সেটেলার’-এ এক আলোচনায় হাজির হন। প্রামাণ্যচিত্রে তাঁকে ‘উগ্রপন্থী বসতি নেত্রী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। চলতি সপ্তাহে যুক্তরাজ্য সরকার তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কারণ, তিনি ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা ও হামলায় উসকানি এবং তাতে অংশ নিয়েছেন’, যা যুক্তরাজ্যের গাজা যুদ্ধ নিয়ে কঠোর অবস্থানের অংশ।

আন্তর্জাতিক আইনে এসব বসতি অবৈধ। আর ১৯৯০-এর দশক থেকে সরকারের অনুমোদন ছাড়াই তৈরি হওয়া চৌকিগুলো ইসরায়েলি আইনেও অবৈধ।

২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ—এই তিন মাসে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় কার্যালয় (ওসিএইচএ) ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের ১ হাজার ৮০৪টি হামলা নথিভুক্ত করেছে। ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা নিজেরা অথবা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে হামলা চালিয়ে ১১ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।

ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর আক্রান্ত হয়েছে, গাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, পানির লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে, ফলের বাগান ধ্বংস করা হয়েছে এবং রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা গাজামুখী ত্রাণবাহী গাড়িতেও হামলা চালিয়েছে। ওসিএইচএ বলেছে, ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা ও চলাচলে বাধার কারণে ৮৪৪ জন ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

গত মাসে ড্যানিয়েলা বিবিসির লুইস থেরাউক্সের তৈরি প্রামাণ্যচিত্র ‘দ্য সেটেলার’-এ এক আলোচনায় হাজির হন। প্রামাণ্যচিত্রে তাঁকে ‘উগ্রপন্থী বসতি নেত্রী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। চলতি সপ্তাহে যুক্তরাজ্য সরকার তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কারণ, তিনি ‘ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা ও হামলায় উসকানি এবং তাতে অংশ নিয়েছেন’, যা যুক্তরাজ্যের গাজা যুদ্ধ নিয়ে কঠোর অবস্থানের অংশ।

তবে থেরাউক্স যখন তাঁকে বলেন, আন্তর্জাতিক আইনে বসতি স্থাপনকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তখন তিনি হেসে বলেন, ‘এটা হালকা ধরনের অপরাধ।’

একসময় ড্যানিয়েলাকে ‘নেসেট ক্যাফেটেরিয়ার রানি’ বলা হতো। কারণ, তিনি নিয়মিত ইসরায়েলি পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ রাখতেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এবং বিশেষ করে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে তিনি আবার আলোচনায় আসেন। এখন তিনি এমন একটি আন্দোলনের মূল নেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, যাঁদের বর্তমান নেতা ইতামার বেন–গভির ও বেজালেল স্মোট্রিচ। দুজনই ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী।

 

সমর্থকদের সঙ্গে ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন–গভির। ২৮ জানুয়ারি, ২০২৪, জেরুজালেম

সমর্থকদের সঙ্গে ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন–গভির। ২৮ জানুয়ারি, ২০২৪, জেরুজালেমছবি: রয়টার্স

থেরাউক্স ফিলিস্তিনিদের জীবনের প্রতি ড্যানিয়েলার উগ্র আচরণকে ‘মনোবিকারগ্রস্ত’ বলে বর্ণনা করেছেন। ড্যানিয়েলা বলেছেন, বসতি স্থাপনকারীদের কাছে সহিংসতা বলে কিছু নেই।

বিশেষজ্ঞরা ড্যানিয়েলার প্রভাব নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করলেও একটি বিষয়ে একমত যে তিনি এখনো শক্তি ও আকর্ষণশক্তি ধরে রেখেছেন, যা তাঁকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে সাহায্য করছে।

ড্যানিয়েলা বলেন, ‘আমি গান গাই না, অভিনয়ও করি না। তবে যখন আমি বক্তৃতা দিই, তখন সেটা অনেকটা স্ট্যান্ড-আপ কমেডির মতো হয়। এটাই আমার স্বভাব। আমি যখন কথা বলি, মানুষ শুনতে পছন্দ করে। কারণ, আমি তা জীবন্তভাবে উপস্থাপন করি।’

এই ইহুদি নেত্রী বলেন, ‘ঈশ্বর আমাকে যা দিয়েছেন, সবই আমি ব্যবহার করি জায়নবাদী স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে। আর আমি তা সম্পূর্ণ সচেতনভাবে করি।’

শান্তিকামী আন্দোলনের সংগঠন পিস নাউয়ের ‘সেটেলমেন্ট ওয়াচ’ প্রকল্পের পরিচালক হাগিত ওফরান মিডল ইস্ট আইকে বলেন, ড্যানিয়েলা দখলদারত্বকে ভালো জিনিস মনে করেন এবং তিনি তা নিয়ে গর্ব করেন।

হাগিত বলেন, ড্যানিয়েলা যা বিশ্বাস করেন, তা খুব স্পষ্ট ও সরাসরি বলেন। এ কারণেই তিনি বিখ্যাত। কারণ, তিনি তাঁর উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে বলেন।

থেরাউক্স ফিলিস্তিনিদের জীবনের প্রতি ড্যানিয়েলার উগ্র আচরণকে ‘মনোবিকারগ্রস্ত’ বলে বর্ণনা করেছেন। ড্যানিয়েলা বলেছেন, বসতি স্থাপনকারীদের কাছে সহিংসতা বলে কিছু নেই।

গাজা: এই জমির মালিক আমরা

পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে—ড্যানিয়েলা ও ইসরায়েলের সরকারে তাঁর মিত্ররা এ অবস্থাকে ‘সুবর্ণ সময়’ বলে মনে করেন। পাঁচ দশক ধরে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের ইহুদিদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করার পর এখন তাঁর চোখ গাজার দিকে।

ড্যানিয়েলা গর্ব করে বলেন, ‘এই পরিকল্পনা এত বিখ্যাত হয়ে গেছে যে মানুষ তেল আবিবে আমাকে থামিয়ে বলেন, “আমার জন্য গাজায় একটা জায়গা রাখবেন।” আমি বলি, “আমাদের ৯০০ পরিবারের তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলুন, আমরা একটা ভালো প্লট খুঁজে দেব।’

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ড্যানিয়েলার সংগঠন ‘নাখালা সেটেলমেন্ট মুভমেন্ট’ একটি সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে ১১ জন মন্ত্রীসহ হাজারো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অংশ নেন। সেই সম্মেলনের নাম ছিল—‘ইসরায়েলের বিজয়ের জন্য সম্মেলন, বসতি স্থাপন নিরাপত্তা নিয়ে আসে’। সেই সম্মেলনে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করার আহ্বান জানানো হয় এবং সম্ভাব্য বসতি এলাকার মানচিত্র দেখানো হয়।

২০২৪ সালের নভেম্বরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ড্যানিয়েলাকে গাজার উত্তরাঞ্চলে নিয়ে যায়। সেখানে তিনি সম্ভাব্য বসতি এলাকাগুলো পরিদর্শন করেন, যার মধ্যে ছিল পুরোনো বসতি ‘নেতজারিম’। ১৯৭২ সালে সেখানে প্রথম ইহুদি বসতি স্থাপন করা হয়েছিল। পরে ২০০৫ সালে গাজা থেকে সর্বশেষ বসতি স্থাপনকারীদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

ড্যানিয়েলা বলেন, পশ্চিম তীরের মতো গাজায়ও ইসরায়েলি সেনাদের অবস্থান দিয়ে বসতি স্থাপন শুরু হবে। তারপর সেনাবাহিনীর পাশে বসবাসকারী ‘ঘেরা কমিউনিটি’ হবে, তারপর গড়ে উঠবে শহর।

তবে ড্যানিয়েলার নিজের মিত্রদের মধ্যেও এই পরিকল্পনা নিয়ে বিরোধিতা রয়েছে।

এই উগ্রবাদী ইহুদি নারী বলেন, ‘আমার ভালো প্রতিবেশী বেজালেল স্মোট্রিচ পশ্চিম তীরের উন্নয়নের জন্য খুব ভালো কাজ করছেন। তবে গাজায় বসতি স্থাপন বিষয়ে আমি তাঁর ভূমিকা নিয়ে সন্তুষ্ট নই। আমি তাঁর কাছ থেকে আরও জোরালো ও স্পষ্ট অবস্থান আশা করি। আমি তাঁকে অনেকবার বলেছি, অন্তত গাজার উত্তরাংশে বসতি স্থাপনের বিষয়ে জোর দিন।’

নেতানিয়াহুর সমালোচনাও করেন ড্যানিয়েলা। অবশ্য তিনি বলেন, নেতানিয়াহুর সহকারীদের সঙ্গে সব সময় তাঁর যোগাযোগ করা সম্ভব। নেতানিয়াহু এতে ‘একটু ধীর’। তবে এই ইহুদি নারী বলেন, ‘আমি বুঝি তাঁর ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আছে, বামপন্থী চাপ আছে। কিন্তু এই ধারণা এখন বাতাসে উড়ছে মুক্তভাবে।’

১৯৫৬ সালের সুয়েজ খাল নিয়ে সংকটের সময় ইসরায়েলি বাহিনী (বাঁয়ে) এবং ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ট্যাংক নিয়ে ইসরায়েলি বাহিনী

১৯৫৬ সালের সুয়েজ খাল নিয়ে সংকটের সময় ইসরায়েলি বাহিনী (বাঁয়ে) এবং ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ট্যাংক নিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীছবি: এএফপি

গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস হামলায় ৫৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছেন। কিন্তু ২৩ লাখ মানুষের মধ্যে যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা কি সেখানে আর থাকবেন না?

ড্যানিয়েলা ইসরায়েলে হামাসের হামলার কথা উল্লেখ করে বলেন, তারা ৭ অক্টোবরের পর গাজার ওপর অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। তারা ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকা, পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলে যাবে। এতে কিছুটা সময় লাগবে, তবে তারা তাদের অধিকার হারিয়েছে। সেই হত্যাকাণ্ড তাদের ইতিহাস বদলে দিয়েছে।

এর আগেও উগ্রবাদী এই ইহুদি নারী বলেছিলেন, ‘গাজায় কোনো আরব থাকবে না। যদি আমরা তাদের খাবার না দিই, তাহলে তারা চলে যাবে।’

গত অক্টোবরে গাজার সীমানায় একটি উৎসবমুখর সম্মেলনে ড্যানিয়েলা বলেছিলেন, ফিলিস্তিনিরা গাজা থেকে ‘অদৃশ্য’ হয়ে যাবে। সেদিন বেন–গভিরও একই কথা বলেছিলেন, ‘এই জমির মালিক আমরা।’

পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন অনেক পুরোনো ব্যাপার হলেও ওফরান বলেন, ‘৭ অক্টোবরের আগে গাজায় বসতি স্থাপনের চিন্তা অকল্পনীয় ছিল।

 

শান্তিকামী আন্দোলনের সংগঠন পিস নাউয়ের ‘সেটেলমেন্ট ওয়াচ’ প্রকল্পের পরিচালক হাগিত ওফরান মিডল ইস্ট আইকে বলেন, ড্যানিয়েলা দখলদারিত্বকে ভালো জিনিস মনে করেন এবং তিনি তা নিয়ে গর্ব করেন।

‘জায়নবাদের ইতিহাস আমার ব্যক্তিগত ডায়েরির মতো’

ড্যানিয়েলা ওয়েইসের জন্ম ১৯৪৫ সালে, তৎকালীন ব্রিটিশশাসিত ফিলিস্তিনের তেল আবিবের কাছে বনে ব্রাক শহরে। তিনি বড় হন একটি খামারে, একটি রক্ষণশীল ধর্মীয় ইহুদি পরিবেশে। পড়াশোনা করেন ধর্মীয় বিদ্যালয়ে। তখন তিনি ধর্মভিত্তিক জায়নবাদী আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এই আন্দোলনের নেতারা নিজেদের মূলধারার ধর্মনিরপেক্ষ জায়নবাদ থেকে আলাদা মনে করতেন। কারণ, সে সময় ইসরায়েলের মূল সমাজ ও নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষ জায়নবাদের প্রাধান্য ছিল।

ড্যানিয়েলা বলেন, তাঁর প্রথম স্মৃতি ১৯৪৮ সালের মে মাসে যখন মিসরীয় বাহিনী তেল আবিব এলাকায় গোলাবর্ষণ করেছিল। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কয়েক দিন পর ওই ঘটনা ঘটেছিল।

এই নারী বলেন, ‘আমার মা–বাবা বিছানার নিচে কার্পেট বিছিয়ে আমাকে আর আমার ছোট বোনকে সেখানে শুয়ে থাকতে বলেছিলেন। এটা ছিল রোমাঞ্চকর, একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো। আমি কখনো ভয় পাইনি।’

ড্যানিয়েলার বাবার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁর মা এক বছর বয়সে পোল্যান্ড থেকে ফিলিস্তিনে এসেছিলেন। তিনি বলেন, তাঁর মা-বাবা ছিলেন ‘খুবই বুদ্ধিমান মানুষ’। তাঁরা প্রথমে জায়নবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী লেহির (স্টার্ন গ্যাং) সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তাঁরা ডানপন্থী লিকুদ পার্টিতে যোগ দেন।

ড্যানিয়েলারা তিন বোন। তিনি বলেন, ‘আমরা যেন স্পার্টায় বড় হয়েছি।’

এখনো ড্যানিয়েলা ও তাঁর বোনেরা এই কথা বলে হাসেন। তিনি বলেন, ‘জীবন ছিল খুব কঠিন। আমরা এই বিশ্বাসে বড় হয়েছি যে আমাদের ঈশ্বরকে সব সময় ধন্যবাদ জানাতে হবে যে আমরা একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্রে বাস করছি। এটা ছিল আমাদের পরিবারের চিরাচরিত পরিবেশ।’

ড্যানিয়েলা বলেন, তাঁদের পরিবারে বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা এবং ইসরায়েল সম্পর্কে সচেতন থাকা ছিল বাধ্যতামূলক। সংবাদ শোনার সময় সেটাই ছিল পবিত্র সময়। তখন কেউ কথা বলতেন না।

বিশেষ করে উত্তেজনাপূর্ণ সময় এলে এই আবেগ আরও তীব্র হয়ে উঠত। যেমন ১৯৫৬ সালের সুয়েজ খাল সংকটের সময়, যখন ইসরায়েল, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য মিলে মিসরের নিয়ন্ত্রণে থাকা গাজা ও সিনাই উপদ্বীপে আক্রমণ করেছিল—তখনকার কথা তাঁর পরিষ্কার মনে আছে। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতি মুহূর্তে আইডিএফের (ইসরায়েলি বাহিনী) অগ্রগতি অনুসরণ করতাম।’

ড্যানিয়েলা বলেন, ‘আমার জন্য জায়নবাদের ইতিহাস একটা ব্যক্তিগত ডায়েরির মতো। আমি এটি এত তীব্রভাবে স্মরণ করি, যেন আমার কাছে এটি সব সময় খোলা বই।’

এই ব্যক্তিগত ডায়েরির সঙ্গে ড্যানিয়েলার বাইবেলের প্রতি ভালোবাসাও আছে। তাঁর দাবি, ইহুদি জাতির মাতৃভূমির সীমানা বাইবেলে নির্ধারিত। এর সীমানা পূর্বে ফোরাত নদী থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে নীল নদ পর্যন্ত। অর্থাৎ তাঁর মতে, ফিলিস্তিনের বাইরেও সিরিয়া, ইরাক, জর্ডান, লেবানন ও মিসরের কিছু অংশ ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত।

অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের সংগঠন নাখালার প্রতিষ্ঠাতা ড্যানিয়েলা গাজায় বসতি স্থাপন নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছেন। অক্টোবর ২০২৪, ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চল

অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের সংগঠন নাখালার প্রতিষ্ঠাতা ড্যানিয়েলা গাজায় বসতি স্থাপন নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছেন। অক্টোবর ২০২৪, ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলছবি: রয়টার্স

রবিন হত্যাকাণ্ড: ‘আমাদের জন্য নতুন যুগের সূচনা’

যেহেতু ১৯৫৬ সালের সুয়েজ খাল সংকট তরুণ ড্যানিয়েলার মনে দাগ কাটে, ফলে ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ তাঁকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে। ওই যুদ্ধে ইসরায়েল আরব দেশগুলোর যৌথ বাহিনীকে পরাজিত করে গোলান মালভূমি, পশ্চিম তীর ও গাজা দখল করে।

এই যুদ্ধের পর জায়নবাদী ও রাবাই মোশে লেভিঙ্গার অধিকৃত এলাকায় ইহুদি বসতি গড়ে তোলেন। লেভিঙ্গার ১৯৮৮ সালে ছয় বছরের এক ফিলিস্তিনি শিশুকে মারধর করেন এবং একই বছর একজন ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করেন। এই অপরাধে তিনি জেল খাটেন। তবে পরে এই অপরাধীই ড্যানিয়েলার উপদেষ্টা হন।

লেভিঙ্গার আর ড্যানিয়েলা মিলে গড়ে তোলেন উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ‘গুশ এমুনিম’। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ড্যানিয়েলা। এ আন্দোলন মিশ্র ছিল—এক দিক ছিল ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিপূর্ণ (মেসিয়ানিক), অন্যদিকে ছিল রাজনৈতিক কৌশল ও বাস্তববাদ।

দুজনের এ সংগঠন বেশ সহিংসও ছিল।

১৯৮৭ সালের এপ্রিলে একজন ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী নিহত হলে এবং পরে ফিলিস্তিনিদের প্রথম ইন্তিফাদার আগে লেভিঙ্গার ও ড্যানিয়েলার নেতৃত্বে পশ্চিম তীরের কালকিলিয়ায় বসতি স্থাপনকারীরা হামলা চালিয়ে ফিলিস্তিনিদের বাড়ি, গাড়ি ও বাগান ধ্বংস করেন।

কয়েক দিন ধরে চলা ওই সহিংসতার পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পাঠানো হয়। এ ঘটনাকে হিব্রু ভাষায় ‘নাইট অব বোটলস’ বা ‘বোতলের রাত’ নামে ডাকা হয়। মানবাধিকার সংগঠন ইয়েশ দিন জানায়, ড্যানিয়েলা ‘জরিমানা ও স্থগিত দণ্ডে রক্ষা পান’, যা প্রমাণ করে ‘ইসরায়েলি আদালত সব সময় এ ধরনের দাঙ্গাবাজ বসতি স্থাপনকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল’।

ইসরায়েলি সাংবাদিক ও লেখক গেরশম গোরেনবার্গ বলেন, অনেক দিক থেকে ইসরায়েলের কট্টর জাতীয়তাবাদীরা ধর্মীয় বসতি আন্দোলনকে মূল ইস্যু বানিয়েছে।

ড্যানিয়েলা নিজে বসতি আন্দোলনের চরমপন্থী অংশে রয়েছেন। তিনি মূলধারার আন্দোলনের নেতৃত্বকে ‘অতি নমনীয়’ বলে সমালোচনা করেন।

ড্যানিয়েলা বলেন, পশ্চিম তীরের মতো গাজায়ও ইসরায়েলি সেনাদের অবস্থান দিয়ে বসতি স্থাপন শুরু হবে। তারপর সেনাবাহিনীর পাশে বসবাসকারী ‘ঘেরা কমিউনিটি’ হবে, তারপর গড়ে উঠবে শহর।

নিজেদের সংগঠন গুশ এমুনিমের মধ্যেও তাঁর কঠোর ভঙ্গি নিয়ে সমালোচনা আছে। এরপরও তিনি ১৯৯৬ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত কেদুমিম অবৈধ ইহুদি বসতি এলাকার মেয়র ছিলেন।

২০১০ সালে ড্যানিয়েলা গঠন করেন ‘নাখালা সেটেলমেন্ট মুভমেন্ট’। এ সংগঠনের মাধ্যমে তিনি আগের মতোই ইসরায়েলের ভূখণ্ড সম্প্রসারণের কাজ চালিয়ে যান।

ড্যানিয়েলা আজও আগের মতোই এই লক্ষ্য নিয়ে উজ্জীবিত। তাঁর চার মেয়ে ও একাধিক নাতি-নাতনি আছে। ২০০৬ সালে তাঁর মেয়েজামাই আভ্রাহাম গাভিশ এক ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীর হাতে নিহত হন। ওই হামলায় তাঁর জামাতার মা–বাবাও নিহত হন। তাঁর মেয়ে ও নাতনি টেবিলের নিচে লুকিয়ে বেঁচে যান।

মিডল ইস্ট আইয়ের সঙ্গে কথা বলার দিন ড্যানিয়েলা গাজা নিয়ে একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ’ লেখার জন্য ভোর ৫টা পর্যন্ত জেগে ছিলেন।

মিডল ইস্ট আইকে ড্যানিয়েলা বলেন, ‘আমি মাত্র দুই ঘণ্টা ঘুমিয়েছি। এর পর থেকেই রাজনীতির কাজে লেগে পড়েছি, জুমে মিটিং, আলোচনা। সকালেই তিন ঘণ্টা কেটে গেছে।’ তাঁর স্বামী আমনোন ওয়েইস একজন সফল ব্যবসায়ী। তিনি পোলিওতে আক্রান্ত এবং প্যারালিম্পিকে অংশ নেওয়া অ্যাথলেট।

ড্যানিয়েলার বাড়ি ‘আশ্চর্যজনকভাবে অভিজাত’ এবং তাঁরা স্পষ্টতই ধনী। তাঁর সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে অনুদান পেয়ে আসছে। ২০২৩ সালে প্রকাশ পায়, ৯৯ বছর বয়সী ধনী নারী লেয়া ড্যাঙ্কনার নাখালাকে প্রায় ২০ লাখ ডলার অনুদান দিয়েছেন।

আইজাক রবিনের সরকার ছাড়া ইসরায়েলের প্রায় প্রতিটি সরকারই ইহুদি বসতি আন্দোলনকে সমর্থন করেছে। ১৯৯৫ সালে এক উগ্র ডানপন্থী ইসরায়েলির হাতে খুন হন রবিন। ওই ঘাতক একজন ইহুদি বসতি স্থাপনকারী ছিলেন।

আইজাক রবিন একবার পশ্চিম তীরের ইহুদি বসতি আন্দোলনকে ‘ক্যানসার’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

ড্যানিয়েলা বলেন, রবিন খুন হওয়ার পর তিনি ভেবেছিলেন, ‘ইতিহাস বদলে গেছে, তাঁর (রবিন) ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে প্রত্যাহারের পরিকল্পনা থেমে গেছে, আর আমাদের জন্য নতুন যুগের সূচনা হয়েছে।’

বসতি আন্দোলন আন্তর্জাতিক পরিসরেও ইসরায়েলের জন্য ঝামেলা সৃষ্টি করেছে। ইসরায়েলি কূটনীতিক অ্যালন পিংকাস বলেন, ‘পশ্চিম তীর ছিল অধিকৃত। জেনেভা সনদ অনুযায়ী যুদ্ধ করে দখল করা জমিতে আপনি বসতি গড়তে পারেন না।’

ইসরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের কোখাভ হাশাহার বসতির কাছে সহযোগীদের নিয়ে ড্যানিয়েলা। নভেম্বর ২০২২

ইসরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের কোখাভ হাশাহার বসতির কাছে সহযোগীদের নিয়ে ড্যানিয়েলা। নভেম্বর ২০২২ছবি: রয়টার্স

এই কূটনীতিক বলেন, ‘বসতিগুলো ইসরায়েলি আইনে অবৈধ ছিল, সেগুলো আমি কীভাবে সমর্থন করব? সেগুলোকে আধুনিক রাজনীতির ভাষায় নয়, বাইবেলের ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু সেটা যুক্তিসংগত নয়।’

মিডল ইস্ট আইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পরদিন ড্যানিয়েলা তাঁর পরিকল্পিত বসতি প্রকল্পের জন্য জায়গা দেখতে আবার গাজায় যান।

পিস নাউয়ের হাগিত ওফরান বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, ড্যানিয়েলা সত্যিই গাজায় ঢুকতে প্রস্তুত। এ সরকারের আমলে তাঁর যোগাযোগ ও সমর্থন অনেক বেশি। তাঁর মতো উগ্রবাদী ইহুদির চিন্তায় যুদ্ধ মানে সুযোগ। যুদ্ধের পরই মুক্তি আসে। এটাই তাঁর বিশ্বাস।’

গোরেনবার্গ বলেন, ড্যানিয়েলা মূলধারার মানুষের মতামতের প্রতিনিধিত্ব করেন না। আর স্মোট্রিচ একটি ছোট, কিন্তু অতিমাত্রায় প্রভাবশালী বসতি সমর্থক গোষ্ঠীর নেতা।

তবে গোরেনবার্গ এটাও স্বীকার করেন, আজকের দিনে পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় চরমপন্থী, বিশেষ করে ডানপন্থী আন্দোলনকে অবহেলা করা ঠিক হবে না।

ড্যানিয়েলার কাছে গাজায় বসতি স্থাপন যেন পূর্বনির্ধারিত একটি বিষয়। এটি ‘জায়ন ফিরে আসার’ অংশ, যার মাধ্যমে ইহুদি জাতির সেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার অবসান ঘটবে, যা আজ থেকে ২ হাজার ৫০০ বছর আগে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ব্যাবিলনীয়দের হাতে নির্বাসনের পর শুরু হয়েছিল।

এই উগ্রবাদী ইহুদি নারী বলেন, ‘এটা ঘটবেই। হতে পারে এক বছরে, হতে পারে তিন বছরে, কিন্তু এটা ঘটবে। এটা শুরু হয়ে গেছে।’


 

শেয়ার করুন