ভারতীয় নাগরিকেরা কীভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছেন, হারাচ্ছেন প্রাণ
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 18-01-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

চাকরি নিয়ে বিদেশে গিয়ে হেনস্তা হওয়ার নতুন ধরনের ঘটনা ভারতের কেন্দ্রীয় নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিড়ম্বনা বাড়াচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ায় চাকরিপ্রত্যাশী ভারতীয় নাগরিকদের হাল সরকারের নতুন চিন্তা। কারণ, বহু খোঁজ করা সত্ত্বেও সে দেশে যুদ্ধে যাওয়া ১৬ ভারতীয় নাগরিকের কোনো সন্ধান এখনো সরকার পায়নি। ইতিমধ্যে ১২ জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সম্প্রতি যুদ্ধে নিহত হয়েছেন বিনিল বাবু নামে কেরালার এক তরুণ।

ইসলামিক স্টেট (আইএস) গড়ার হাতছানিতে সাড়া দিয়ে এ দেশের বেশ কিছু মুসলমান তরুণ বছর কয়েক আগে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। কেউ কেউ নিহতও হয়েছিলেন। সেই ঘটনাগুলোর অধিকাংশই ছিল জেনেশুনে স্বেচ্ছায় যাওয়া। কিন্তু রাশিয়ায় গিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনার বেশির ভাগই ঘটেছে দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে। কেউ কেউ আবার বেড়াতে গিয়েও দালালদের ফাঁদে পা দিয়ে রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে সরকারের খবর। এ নিয়ে বন্ধুদেশ রাশিয়ার সঙ্গে ভারত সরকার নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে রাশিয়াকে চাপও দেওয়া হচ্ছে।

 

গতকাল শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে এ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। সেই সঙ্গে স্পষ্ট হয় ভারতের বিব্রতকর ও বিড়ম্বনার চিত্রও। কারণ, মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেন, রুশ বাহিনীতে যোগ দেওয়া ১৬ জনের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। বিনিল বাবুর নিহত হওয়ার খবরটি অত্যন্ত দুঃখজনক।

সরকারি বয়ানে স্বীকার করা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে মোট ১২৬ ভারতীয় নাগরিক রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার খবর মিলেছে। তাঁদের মধ্যে ৯৬ জন দেশে ফিরে এসেছেন। ১২ জন যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। যুদ্ধে রয়েছেন ১৮ জন, যাঁদের মধ্যে ২ জন এখনো জীবিত বলে সরকারের আশা। কিন্তু বাকি ১৬ জনের কোনো হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না।

গতকাল জয়সোয়াল ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়ে বলেছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ নিয়ে রুশ দূতাবাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে দ্রুত দেশে ফেরাতে রুশ সরকারকে তৎপর হওয়ার আরজি জানিয়েছে।

 

জম্মু-কাশ্মীরের এক তরুণের কাহিনি শুনিয়েছেন তাঁর বাবা। ২৭ বছর বয়সী ছেলেটির নাম জাহরুর শেখ। চণ্ডীগড় থেকে স্নাতক হওয়ার পর দেশেই এক সংস্থায় মাসে ৩০ হাজার রুপি বেতনে চাকরি করছিলেন। জাহরুরের বাবা আমিন শেখ ছেলের দুর্দশার কাহিনি শুনিয়ে গতকাল শ্রীনগরে গণমাধ্যমকে বলেন, ২০২৩ সালে কয়েকজন দালাল তাঁর ছেলেকে বেশি টাকার চাকরির লোভ দেখান। তিনি বলেন, তাঁদের সঙ্গে বিদেশে গেলে দেশে এক বছরের বেতন এক মাসেই পাওয়া যাবে। সেই প্রলোভনে পা দিয়ে রাশিয়ায় গিয়ে জাহরুর বুঝতে পারেন, চাকরিটা রুশ সেনাবাহিনীতে।

সর্বশেষ তিন মাস আগে ছেলের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে জানিয়ে আমিন শেখ বলেন, সেই থেকে জাহরুরের কোনো খোঁজ ভারত বা রাশিয়ার সরকার দিতে পারেনি।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ভারতসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের রুশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার কথা শোনা গেছে। নেপাল, ঘানা, ইয়েমেনসহ বেশ কিছু দেশের ‘ভাড়াটে’ সৈন্যের উপস্থিতির কথা শোনা গেছে। অধিকাংশকেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে ভালো চাকরির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে।

সরকারি সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয়দের অনেককে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হলেও তাঁদের সবাইকে লড়াই করতে পাঠানো হয়নি। যুদ্ধক্ষেত্রে ফ্রন্টলাইনে বাহিনীর জন্য রান্না, ফাই–ফরমাশ খাটা ও বিভিন্ন ধরনের কাজে অনেককে নিয়োগ করা হয়েছে।

পশ্চিমা দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আক্রমণের পর রাশিয়া থেকে প্রধানত বিদেশে পাড়ি দেন যুদ্ধবিরোধী সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও বিভিন্ন পেশার সমালোচকেরা। এক হাজার সাংবাদিক দেশত্যাগী হন। ওই বছরের জুলাইয়ে দেশ ছাড়েন প্রধানত মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তরা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি দেশত্যাগের ঘটনা ঘটেছে সেই বছরের সেপ্টেম্বরে, প্রেসিডেন্ট পুতিন যখন সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক করে দেন। ওই মাসেই অন্তত তিন লাখ রাশিয়ান দেশ ছেড়ে চলে যান।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী এক হিসাবে এখন পর্যন্ত সাত লাখ রুশ দেশ ছেড়েছেন। তাঁরা প্রধানত আশ্রয় নিয়েছেন কাজাখস্তান, সার্বিয়া, জর্জিয়া, ফিনল্যান্ড, তুরস্ক ও আরব আমিরাতে। সেনাবাহিনী ত্যাগ করা ঠেকাতে প্রেসিডেন্ট পুতিন ডিক্রি জারি করে জানান, যুদ্ধ চলাকালে কেউ বাহিনী ছেড়ে পালালে বা চাকরি ছেড়ে দিলে ১৫ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।

ধারণা করা হচ্ছে, ওই ডিক্রি জারির পর ২০২২ সালের শেষ দিকে চাকরির নাম করে প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশিদের রাশিয়ায় পাঠাতে দালাল চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে।

শেয়ার করুন