ওলেহ কোলেসনিকভ একজন ইউক্রেনের নাগরিক। তিনি এমন একটি পরিবারের সদস্য, যার সঙ্গে গুপ্তচরবৃত্তি মিশে আছে একেবারে অবিচ্ছেদ্যভাবে।
কোলেসনিকভ বলেন, স্নায়ুযুদ্ধের সময় তাঁর বাবা ছিলেন কিউবায় নিযুক্ত একজন সোভিয়েত গোয়েন্দা এজেন্ট। গোয়েন্দাগিরি করতেন অনুবাদকের ছদ্মবেশে। কোলেসনিকভের চাচাতো ভাইও কাজ করতেন রুশ নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে।
বাবা ও চাচাতো ভাইয়ের এ ভূমিকা কোলেসনিকভকেও যুদ্ধকালীন গুপ্তচরের একজন মোক্ষম প্রার্থী হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।
কোলেসনিকভ রয়টার্সকে বলছিলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে ওঠা জাপোরিঝঝিয়া তাঁর নিজের শহর। সেখানকার বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা ও ইউক্রেনের সেনাদের গতিবিধি সম্পর্কে রুশ বাহিনীকে গোপনে তথ্য সরবরাহ করতে রাজি হন তিনি। ইউক্রেনীয় বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র কোথায় মোতায়েন করা হচ্ছে, পাঠাতেন সে বিষয়েও তথ্য।
নিজেকে ‘রুশ বিশ্ব’ ধারণার একজন সমর্থক হিসেবে পরিচয় দেন কোলেসনিকভ। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন-সমর্থিত এ মতবাদে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে মস্কোর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন থাকার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। মস্কোর কিছু কট্টরপন্থী রাজনীতিবিদ এ যুক্তিকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে রুশ ভাষাভাষীদের অধিকার রক্ষায় সামরিক হস্তক্ষেপের বৈধতা হিসেবে দাঁড় করিয়ে থাকেন।
‘আমি অর্থের জন্য এ কাজ (রাশিয়ার পক্ষে গোয়েন্দাগিরি) করিনি’, বলেন কোলেসনিকভ। তবে তাঁর অনুশোচনা আছে। তিনি বলেন, রাশিয়ার ছোড়া কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ভুলবশত বেসামরিক স্থাপনায় আঘাত হানে। এতে সাধারণ লোকজন নিহত হন। তাঁর ধারণা ছিল, এ যুদ্ধ দ্রুতই শেষ হবে। অথচ তা না হয়ে তিন বছর হতে চলল। দীর্ঘ এ যুদ্ধ তাঁর দেশকে এরই মধ্যে ধ্বংসস্তূপ বানিয়ে ছেড়েছে।
‘আমি অর্থের জন্য এ কাজ (রাশিয়ার পক্ষে গোয়েন্দাগিরি) করিনি’, বলেন কোলেসনিকভ। তবে তাঁর অনুশোচনা আছে। বলেন, ‘রাশিয়ার ছোড়া কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ভুলবশত বেসামরিক স্থাপনায় আঘাত হানে। এতে সাধারণ লোকজন নিহত হন।’ তাঁর ধারণা ছিল, এ যুদ্ধ দ্রুতই শেষ হবে। অথচ তা না হয়ে তিন বছর হতে চলল। দীর্ঘ এ যুদ্ধ তাঁর দেশ ইউক্রেনকে এরই মধ্যে ধ্বংসস্তূপ বানিয়ে ছেড়েছে।
৫২ বছর বয়সী কোলেসনিকভ সোভিয়েত ইউক্রেনে বড় হয়েছেন। সরকারি সাবেক এই ভূমি ব্যবস্থাপক বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, তাঁরা (রুশ সেনারা) দ্রুতগতিতে এগোবেন। কিন্তু সব সময় পরিকল্পনামাফিক কাজ হয়নি। তাঁরা হয়তো পরিকল্পনা করেছেন একটা, বাস্তবে ঘটেছে অন্যটা।’
রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে কোলেসনিকভ গ্রেপ্তার হলে তাঁর স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে যান। সঙ্গে নিয়ে যান তাঁদের ১১ বছরের সন্তানকে।
কোলেসনিকভের সঙ্গে গত এপ্রিলে জাপোরিঝঝিয়ার এক পুলিশ কেন্দ্রে কথা হয় রয়টার্সের। সেখানে সিকিউরিটি সার্ভিস অব ইউক্রেনের (এসবিইউ) একজন কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।
এসবিইউর তথ্য অনুসারে, রাশিয়া বছর তিন আগে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করার পর কিয়েভের কর্তৃপক্ষ ৩ হাজার ২০০–এর বেশি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেছে। মামলার আসামিদের মধ্যে আছেন মস্কোকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তথ্য দিয়ে সহায়তাকারী ও রাশিয়ার পক্ষে অপপ্রচার ছড়ানো ব্যক্তিরাও।
রাশিয়ার পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত ইউক্রেনের তিন তথ্যদাতা ও এসবিইউর দুজন কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নিয়েছে রয়টার্স। ইউক্রেনের কারও কারও মধ্যে রাষ্ট্রীয় আনুগত্য নিয়ে বিভক্তির কথা বলেছেন তাঁরা। ইউক্রেনের বর্তমান বয়স্ক প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে সোভিয়েত ইউক্রেনের অংশ হিসেবে, ১৯৯১ সালে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে।
এসবিইউর প্রধান ভ্যাসিল মালিউক বলেন, এ যুদ্ধে জয় পেতে রাশিয়ার এজেন্টদের নির্মূল করা দরকার। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেনের কাউন্টার-এসপিআনাজ (গোয়েন্দাগিরি প্রতিরোধ) কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘ক্রেমলিন কয়েক দশক ধরে “সন্তর্পণে ইউক্রেনে ঢুকছে” ও নিজেদের পক্ষে লোক নিয়োগ করছে। আমাদের পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গি তাঁদের পরিকল্পনা নস্যাতে কাজে আসছে।’
এ প্রতিবেদনের ব্যাপারে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের (এফএসবি) প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়। তবে তারা কোনো সাড়া দেয়নি।
আমি ভেবেছিলাম, তাঁরা (রুশ সেনারা) দ্রুতগতিতে এগোবেন। কিন্তু সব সময় পরিকল্পনামাফিক কাজ হয়নি। তাঁরা হয়তো পরিকল্পনা করেছেন একটা, বাস্তবে ঘটেছে অন্যটা।
ওলেহ কোলেসনিকভ, ইউক্রেনের নাগরিক
এদিকে গুপ্তচরবৃত্তিতে ইউক্রেনও বসে নেই। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হওয়া ইউক্রনযুদ্ধে রাশিয়াকে মোকাবিলায় ইউক্রনীয় গুপ্তচরেরাও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন। গত সপ্তাহেই রাশিয়ার রাজধানী মস্কোয় একটি বাড়ির বাইরে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় এসবিইউ। এ ঘটনায় রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় জেনারেল এবং রুশ পরমাণু, জৈব ও রাসায়নিক সুরক্ষা সেনাদলের প্রধান ইগর কিরিলভ নিহত হন।
এসবিইউর তালিকায় প্রথম শ্রেণির বিশ্বাসঘাতকদের একজন ছিলেন কোলেসনিকভ। গত সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত হন তিনি। রায়ে বলা হয়, ইউক্রেনের কয়েক ডজন স্থাপনা, বিশেষ করে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে তিনি রুশ বাহিনীকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। তবে কতটি স্থাপনায় রুশ বাহিনী সফলভাবে হামলা চালিয়েছে সে তথ্য রায়ে উল্লেখ করা হয়নি।
কোলেসনিকভের আইনজীবী বলেন, তাঁর মক্কেল রুশ বাহিনীকে তাদের হামলার লক্ষ্যস্থল চিহ্নিত করতে সহায়তা করেননি; বরং হামলার পর এ–সংক্রান্ত মূল্যায়ণকাজে সাহায্য করেছিলেন।
কোলেসনিকভ রয়টার্সকে বলেন, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে রুশ কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি জাপোরিঝঝিয়া শহরের সানরাইজ হোটেলে স্থানীয় কর্মকর্তাদের এক বৈঠক আয়োজনের ব্যাপারে তথ্য দিয়েছিলেন।
রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে কোলেসনিকভ গ্রেপ্তার হলে তাঁর স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে যান। সঙ্গে নিয়ে যান তাঁদের ১১ বছরের সন্তানকে। কোলেসনিকভের সঙ্গে গত এপ্রিলে জাপোরিঝঝিয়ার এক পুলিশ কেন্দ্রে কথা হয় রয়টার্সের। তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।
রায়ে বলা হয়, কোলেসনিকভের এ তথ্য দেওয়ার পরদিন ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হোটেল ভবনটিতে আঘাত হানে। যদিও কোনো কারণে সেদিন ভবনটিতে বৈঠক হয়নি। তবে এ হামলায় একজন বেসামরিক লোক নিহত ও পাঁচজন আহত হন।
এ ঘটনার পর গত বছরের মার্চে রাশিয়ার চালানো এক হামলার স্থানে কোলেসনিকভের গাড়ি শনাক্ত করা হয়। সেখানকার একটি টেলিভিশন টাওয়ার লক্ষ্য করা চালানো এ হামলা অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ক্ষেপণাস্ত্র গিয়ে পড়ে কাছের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে। এ সময় বেসামরিক কয়েক ব্যক্তি নিহত হন। পরে এসবিইউ এজেন্টরা তাঁর ওপর ঘনিষ্ঠ নজর রাখতে শুরু করেন। কোলেসনিকভ রয়টার্সকে বলেন, হামলার ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়ণে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি।
এসবিইউ জানায়, রাশিয়ার হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেকগুলো স্থাপনায় কোলেসনিকভের ফোন সক্রিয় থাকার বিষয়টি শনাক্ত হয়। এরপর তাঁর গাড়িতে বসানো হয় আড়ি পাতার যন্ত্র। এর মধ্য দিয়ে তাঁকে ধরার অভিযানে সাফল্য আসে। গত বছরের ৫ মে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে।
কোলেসনিকভ তাঁর মামলার বিচার চলাকালে আদালতকে বলেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সরকারের বিরোধী ছিলেন তিনি। ছিলেন না ইউক্রেন রাষ্ট্রের বিরোধী। কোলেসনিকভ আরও বলেছিলেন, তিনি তাঁর চাচাতো ভাইয়ের অনুরোধে তাঁকে তথ্য সরবরাহ করতেন। সেই সময় জানতেন না, তিনি রাশিয়ার এফএসবির একজন সদস্য ছিলেন।