বাজেট পেশের পরদিন বে-নজির এক কাণ্ড ঘটে গেল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকে নিয়ে। জাতীয় সংসদে বাজেট উত্থাপন করে পরদিন অর্থমন্ত্রী প্রথা মেনে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন বাজেট নিয়ে নানা প্রশ্নের জবাব দিতে। আগে একসময় অর্থমন্ত্রীরা তাঁর মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তাদের নিয়ে বাজেট-উত্তর এই বার্ষিক অনুষ্ঠানে হাজির হতেন। তবে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া মন্ত্রিসভার সহকর্মীসহ বেশ কিছু আমলাকে নিয়ে তাঁর বাজেট প্রস্তাব সমর্থন আর ব্যাখ্যা করার প্রথা চালু করেন। নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বাজেট পেশের পরদিন সংবাদ সম্মেলনে যাঁদের নিয়ে হাজির হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও।
কাণ্ডটি ঘটে যখন প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হয়। উপস্থিত সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার যদি কথা বলেন, তাহলে সাংবাদিকেরা তা বর্জন করবেন। বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা’ দিয়েছেন গভর্নর। এ জন্য সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাঁর বক্তব্য শোনা হবে না।
বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ১০ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপদেষ্টা। দেশের প্রায় সব টেলিভিশন অনুষ্ঠানটি সরাসরি দেখাচ্ছিল। এই লাইভ অনুষ্ঠানে একটি নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন সাংবাদিকেরা। তবে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকে কেন্দ্র করে বর্জনের ঘটনা কয়েক সপ্তাহ আগেই ঘটেছে। গত ৮ মে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফরের সময় মুদ্রানীতি কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়েছিল, সেটি বর্জন করেন সাংবাদিকেরা। সেদিন যে তিনটি বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সাংবাদিকেরা তা নিয়ে রিপোর্ট করেছিলেন। কিন্তু এক মাসের বেশি সময় ধরে সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না’, এর প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলনটি বর্জন করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে বিধিনিষেধ এখনো বহাল রয়েছে। কেবল পাস নিয়ে নির্দিষ্ট কর্মকর্তার কাছে যাওয়ার অনুমতি আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকেরা যান পেশাগত দায়িত্ব পালনে, কর্তৃপক্ষ যা জানাতে চায় তার বাইরেও খোঁজখবর করেন সেই সব সংবাদের, যেগুলোর ক্ষেত্রে জনস্বার্থ রয়েছে। সমস্যা হলো, কোনো কর্মকর্তা নিজের পরিচয় প্রকাশ করে সাংবাদিকদের সেই সব তথ্য দেবেন না, যা তাঁকে বিপদে ফেলতে পারে বা তিনি কর্তৃপক্ষের রোষানলের লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে সাংবাদিকেরা নিয়মিত খবরের সন্ধানে যান তাঁদের অভিযোগ, গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারে বিধিনিষেধ আরোপ করতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন।
বিশ্বের যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকই স্পর্শকাতর জায়গা। একটি দেশের আর্থিক কর্মকাণ্ডের সব নিয়ন্ত্রণ মূলত থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে। ফলে অবাধে যে কেউ যেকোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ঢুকতে পারেন, ব্যাপারটা এমন নয়। বাংলাদেশেও সচিবালয়ের মতো এলাকায় বিশেষ পাস নিয়ে সাংবাদিকেরা ঢুকে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেন। দেখা করতে পারেন তাঁদের ‘সোর্সের’ সঙ্গে, যাঁদের কাছ থেকে পেয়ে পান সেই সব খবর, যার জনগুরুত্ব রয়েছে এবং যা প্রকাশিত হওয়ার ফলে সরকারও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ। এই ব্যাংকের মুদ্রানীতি প্রণয়নের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা এই মুহূর্তে মুখে তালা দিয়ে রেখেছেন। এখন চলছে তাঁদের ‘ব্ল্যাকআউট পিরিয়ড’। ১১ ও ১২ জুন ফেডারেল ওপেন মার্কেট কমিটির বৈঠক হবে। নিয়ম হলো, এই বৈঠকের প্রথম দিনের আগের দ্বিতীয় শনিবার থেকে শুরু করে বৈঠকের শেষ দিনের পরদিনের মধ্যরাত পর্যন্ত কর্মকর্তারা এ নিয়ে কোনো কথা বলবেন না। মোটামুটি ১২ দিনের ব্যাপার। কিন্তু এই সময়ে কর্মীরা ফেডের বিভিন্ন পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে পারেন এবং এসব তথ্য প্রকাশ-সম্পর্কিত টেকনিক্যাল প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন। একই ধরনের ব্ল্যাক আউট পিরিয়ড পালন করা হয় আরও কিছু কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও। এর কারণ হলো, মুদ্রানীতি-সংক্রান্ত খবর আগেভাগেই বেরিয়ে গেলে তা টালমাটাল পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারছবি: প্রথম আলো
বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের, এমনকি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও সাধারণত কথা বলেন খুব কম। দেশের আর্থিক খাত নিয়ে তাঁদের ভাবনা কী, কোথাও কোনো সমস্যা আছে কি না, এটা তাদের মুখ থেকে শোনার ঘটনা বিরল। দেশের মানুষ যখন মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট, তখন বাকি বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা কেন করা হচ্ছে না, এমন বক্তব্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে শোনা যায়নি। কেন ‘নয়-ছয়’ সুদের হার দীর্ঘ সময় ধরে অনুসরণ করে মানুষকে কষ্ট দেওয়া হলো, সেটাও জানা যায়নি।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরও অনেক কারণে বাকি বিশ্ব থেকে ভিন্ন। বাজেট পেশের দিনই জানা গেল, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি ছাড়িয়েছে। মাত্র তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। লুকানো খেলাপি ঋণ আরও বেশি। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে যখন ক্ষমতা নেয়, তখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকার মতো। মাত্র ১৫ বছরের মাথায় খেলাপি ঋণের এই যে বাড়বাড়ন্ত, ঋণ খেলাপিদের নিত্যনতুন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পরিস্থিতি এই পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড় ভূমিকা রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঋণখেলাপিদের সখ্যের অভিযোগ অনেক পুরোনো। খেলাপিরা, বড় ব্যবসায়ীরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যখন-তখন ঢোকেন, তাঁরাই সুদহার ঠিক করেন, বিভিন্ন ব্যাংকের শীর্ষ পদে তাঁদের পছন্দসই লোকজন বসেন আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূলত রাবার স্ট্যাম্প হিসেবে তা অনুমোদন করেন—এসব অভিযোগও অনেক দিনের। বিশেষ কিছু ব্যাংকের চলতি হিসাবে টাকা না থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন টাকা ছাপিয়ে সেগুলোকে অর্থ সরবরাহ করে যাচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তর কখনো পাওয়া যায়নি। এসব নিয়ে কম লেখা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকার এবং এ থেকে সুবিধাভোগীরা নিশ্চয়ই খুশি হন।
জনস্বার্থেই এসব বিষয় প্রকাশ্যে আনা জরুরি। স্পর্শকাতর এই অজুহাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকর রিজার্ভ চুরি এক মাসের বেশি গোপন রাখা ছিল অন্যায় সিদ্ধান্ত। প্রকাশ পেলে আর্থিকভাবে কেবল একটি গোষ্ঠী বা পক্ষ সুবিধা পেতে পারে, এমন তথ্য নিশ্চয়ই গোপন রাখতে হবে। কিন্তু যেসব দুর্নীতি, অন্যায়, অনিয়ম, কেলেঙ্কারি ঘটছে, তা গোপন রাখার চেষ্টা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্পর্কে মানুষকে ভিন্ন বার্তাই দেবে। এই স্বচ্ছতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে গভর্নরকেই।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্স ম্যাগাজিনের র্যাঙ্কিংয়ে আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর হিসেবে ‘ডি’ পেয়েছিলেন। এটি বেশ খারাপ র্যাঙ্কিং। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারসহ সবার চাপ উপেক্ষা করে, আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করে নিজের এই র্যাঙ্কিং ভালো করতে গভর্নর কাজ করবেন, এটুকু প্রত্যাশা তাঁর কাছ থেকে করাই যেতে পারে।
ওয়ালিউর রহমান
প্রধান বাণিজ্য সম্পাদক, প্রথম আলো