স্বামী–সন্তান হারিয়ে বিপর্যস্ত মজিদা খাতুন টাকার অভাবে ঢাকার বাসা ছেড়ে অসুস্থ মেয়ে সিনথিয়াকে (১৩) নিয়ে গ্রামের বাড়ি বগুড়ায় চলে গেছেন। চিকিৎসকেরা বলছেন, শিশুটির গলায় ফাঁস লাগানোর সময় পাওয়া মানসিক আঘাত ও মস্তিষ্কে অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে তার স্বাভাবিক স্মৃতিশক্তি আর কাজ করছে না। তার সঙ্গে কী ঘটেছিল, সেটা সেভাবে মনে করতে পারছে না শিশুটি। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের তালতলার বাসা থেকে তার বাবা-ভাইয়ের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল।
৭ এপ্রিল সকালে মজিদা খাতুন ঘুম থেকে উঠে ছাত্রদের পড়ান। পরে দুপুরে তাদের বাসায় গিয়ে পড়ানোর জন্য বের হন। বিকেলে বাসায় ফিরে দেখেন, খাটের ওপর পড়ে আছে উচ্চমাধ্যমিকে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়া একমাত্র ছেলে মোদাব্বির রহমানের (১৮) মরদেহ। ফ্যানের সঙ্গে প্যাঁচানো দড়িতে ঝুলছেন স্বামী মশিউর রহমান (৫৫)। আর সপ্তম শ্রেণিতে পড়া সিনথিয়া খাটে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে।
পরে মজিদা মেয়েকে উদ্ধার করে শেরেবাংলা নগরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়। ১৩ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ২০ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হলেও মেয়েটির গলায় ক্ষতের চিহ্ন এখনো শুকায়নি।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়েটির গলায় ফাঁস লাগানোর সময় তার ওপর তৈরি হওয়া মানসিক আঘাত ও মস্তিষ্কে অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে সে কিছু মনে করতে পারছে না। এটি নিউরোসাইক্রিয়াটিক ম্যানিফেস্টেশন।’
এদিকে স্বামী ও একমাত্র ছেলে হারিয়ে মজিদাও এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এখন তিনি গ্রামের বাড়ি বগুড়ার গাবতলীতে আছেন।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে যোগাযোগ করা হলে মজিদা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ সিনথিয়াকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ঢাকায় রেখে মেয়েকে চিকিৎসা করানোর এবং বাসাভাড়া দেওয়ার টাকা নেই। তাই বাসা ছেড়ে দিয়ে বগুড়ায় চলে এসেছি।’
ছেলে মোদাব্বির রহমান ও বাবা মশিউর রহমানছবি: সংগৃহীত
মজিদা বলেন, চিকিৎসকেরা তাঁকে জানিয়েছেন, নিয়মিত ওষুধ খেলে ধীরে ধীরে সিনথিয়া সুস্থ হয়ে উঠবে। বাবা ও ভাইয়ের বিষয়ে তাকে কিছু জানানো হয়নি। বাবা–ভাইয়ের কথা জানতে চাইলে তাকে অন্য কথা বলে ভুলিয়ে রাখা হচ্ছে। দুই সপ্তাহ পর তাকে হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
সিনথিয়া স্কুলে যেতে চায় বলে জানান মা মজিদা। বলেন, সুস্থ হয়ে ওঠার পর তাকে কোথায় পড়ানো হবে, তা পরে ঠিক করা হবে।
দিশাহারা ও বিপর্যস্ত মজিদা বলেন, এ কয় দিনে শারীরিক অবস্থা এত খারাপ হয়েছে যে তাঁর কথা বলতেও কষ্ট হয়। বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে। ছেলে আমার লেখাপড়ায় ভালো ছিল। স্বপ্ন ছিল, উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। কিন্তু ছেলে আমার খুন হয়ে গেল। আর্থিক অনটনের কারণে আমার স্বামীই হয়তো ছেলেকে খুন করে আত্মহত্যা করেছেন। মেয়েকেও খুন করতে চেয়েছিলেন।’
ক পাস করেন। এরপর মশিউর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয়। মশিউর বগুড়ার স্থানীয় একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা করেন। বিয়ের তিন মাস পর স্বামীর হাত ধরে ঢাকায় আসেন। বাসা নেন আগারগাঁওয়ের তালতলায়। পরে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন মশিউর। বেতনের টাকায় সংসার বেশ ভালোই চলছিল। বিয়ের পাঁচ বছর পর তাঁদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। এর পাঁচ বছর পর জন্ম কন্যাসন্তানের। একপর্যায়ে স্বামীর একার আয়ে সংসার চালাতে বেগ পেতে হলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পে চাকরি নেন মজিদা। তিন বছর চাকরি করার পর ওই প্রকল্প স্থগিত হয়ে যায়। এরপর সাত বছর আগারগাঁও এলাকায় একটি কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করেন।
মজিদা বলেন, ২০১৭ সালে ১৪ লাখ টাকায় মশিউর দক্ষিণখানে তিন কাঠা জমি কেনেন। তবে জমি নিবন্ধনের সময় জানতে পারেন, প্রতারিত হয়েছেন। অনেক চেষ্টা করেও আর জমির নিবন্ধন পাননি। এরপর করোনাকালে মশিউরের চাকরি চলে যায়। তখন একটি আবাসন কোম্পানিতে চাকরি করতেন মশিউর। করোনাকালে মজিদার শিক্ষকতার চাকরিও চলে যায়। পরে মশিউর শেয়ারবাজারে কিছু অর্থ বিনিয়োগ করেন। সেখানেও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে মজিদা তালতলায় শিক্ষার্থীদের পড়ানো শুরু করেন। এদিকে কোনো কাজ না থাকায় মশিউর বেশির ভাগ সময় বাসাতেই থাকতেন। সংসারের নানা কাজে মজিদাকে সহায়তা করতেন।
মা মজিদা খাতুনছবি: সংগৃহীত
আক্ষেপ করে মজিদা খাতুন বলেন, ‘তিন বছর ধরে স্বামীর কোনো আয় নেই। জমি কেনা বাবদ যে ১৪ লাখ টাকা রতন নামের এক লোককে দিয়েছিলেন, সেই টাকা প্রতি মাসে ৫–৭ হাজার টাকা করে ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। তবে তিন মাস ধরে কোনো টাকা ফেরত দিচ্ছিলেন না। এ নিয়ে স্বামী খুব চিন্তিত ছিলেন। আফসোস করে প্রায়ই বলতেন, আর বোধ হয় জমি কেনার টাকা ফেরত পাবেন না।’
পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে শবে কদরের রাতে স্বামী ছেলে মোদাব্বিরকে নিয়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েন বলে জানান মজিদা খাতুন। এরপর গভীর রাতে বাসায় ফেরেন। পরে একসঙ্গে সাহ্রি খেয়ে ঘুমান। ওঠার পর ছাত্ররা পড়তে আসে। সে সময় স্বামী বাসার নানা কাজ করেন। বেলা দেড়টার দিকে মজিদা ছাত্রদের পড়াতে বাসা থেকে বের হন। বিকেলে তালতলার একটি কোচিং সেন্টারে যান মেয়েকে আনতে। তবে মেয়েকে না পেয়ে বাসায় ফিরে আসেন। কলিং বেল চাপলেও ভেতর থেকে কারও সাড়া পাননি। তখন স্বামীর মুঠোফোনে কল দেন। কিন্তু কেউ ধরেনি। তখন মজিদা বাসার তত্ত্বাবধায়ককে ঘটনা জানান।
মজিদা বলেন, ‘সাড়াশব্দ না পেয়ে বাসার জানালা দিয়ে মেয়েকে ডাক দিই। কিন্তু সাড়া পাইনি। পরে মই দিয়ে ওপরে উঠে দেখি, মেয়ে আমার অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। দীর্ঘ সময় ডাকাডাকির পর একসময় মেয়ে কিছুটা জ্ঞান ফিরে পায়। তাকে দরজা খুলতে বললেও শরীরে কোনো শক্তি না থাকায় দরজা খুলতে পারেনি।’ এরপর বাড়ির তত্ত্বাবধায়ককে দিয়ে কাঠমিস্ত্রি ডেকে ঘরে ঢোকেন মজিদাসহ অন্যরা।