চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ বেশিরভাগ জায়গায় বন্ধ ছিল। কিছু কর্মী নিয়ে শুধু হাতিরঝিল এলাকায় কাজ চলছিল। তবে অর্থসংকটে দুই মাস ধরে সেখানকার কাজও বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রকল্পের কাজ এখন পুরোপুরি বন্ধ দ্রুতগতির এ উড়ালসড়কের।
এ দিকে কবে নাগাদ কাজ আবার শুরু হবে, তা বলতে পারছে না বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, কাজ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে পারেনি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ ও পরিচালনা প্রতিষ্ঠান ‘ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (এফডিইই) কোম্পানি লিমিটেড’। উপরন্তু শেয়ার হস্তান্তর নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে নিজেদের মধ্যে সমস্যা জিইয়ে রেখেছে এফডিইইর অধীন অংশীদার ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে রাজধানীর যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখতে ব্যয়বহুল প্রকল্পটিকে দ্রুত শেষ করার ওপর জোর দিচ্ছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রকল্প পরিচালকের সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, ভূমি সমস্যার সমাধান করার পরও মগবাজার-মালিবাগ, খিলগাঁও ও হাতিরঝিল, পান্থকুঞ্জ ও কমলাপুর এলাকায় নির্মাণকাজের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। এ ধরনের বিলম্ব অগ্রহণযোগ্য। দ্রুত কোনো অগ্রগতি না হলে চুক্তির শর্ত অনুসারে বিবিএ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।
গত ২ এপ্রিল কাওলা, মগবাজার, কমলাপুরের টিটিপাড়া, কমলাপুর রেলস্টেশনের কাছে ওয়ার্ক স্টেশন বা স্টক ইয়ার্ড ঘুরে দেখেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। সে সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাওলা স্টক ইয়ার্ড ফেব্রুয়ারি এবং বাকি স্থানগুলোতে মার্চ মাস থেকে কাজ বন্ধ রয়েছে।
এর পর গত ২ জুলাই সরেজমিনে মগবাজার-মালিবাগ ও হাতিরঝিল ওয়ার্ক স্টেশন ঘুরে শুধু হাতিরঝিলে সীমিত জনবল নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়। সবশেষ ১৮ সেপ্টেম্বর হাতিরঝিলে গিয়ে দেখা যায় সেখানেও কাজ বন্ধ রয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) বড় এ প্রকল্পে বাংলাদেশ ছাড়াও থাইল্যান্ডের একটি ও চীনভিত্তিক দুটি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ এবং নির্মাণকাজের মাধ্যমে অংশীদার। প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো ইতালিয়ান থাই (ইতালথাই) ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি, চীনের শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ও সিনো হাইড্রো করপোরেশন।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য এফডিইই লিমিটেড নামের কোম্পানি গঠন করে ইতালথাই। এতে অংশীদার তিন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার যথাক্রমে ৫১, ৩৪ ও ১৫ শতাংশ। বিবিএ হচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ের নির্বাহক প্রতিষ্ঠান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শেয়ার স্থানান্তরে আদালতের যে স্থিতাবস্থা জারি ছিল, তা গত ১ সেপ্টেম্বর খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শেয়ার স্থানান্তরে আর কোনো বাধা নেই। তাই শেয়ার হস্তান্তর নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়টিকে অজুহাত করে কাজ বন্ধ রাখার কোনো সুযোগ নেই। প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তির মতে, এর আগে বিবিএর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একাধিকবার বিষয়টি নিয়ে আদালতের কার্যক্রম চলমান থাকাকে অজুহাত বানিয়ে কাজ শুরু করার বিষয়ে এফডিইইকে চাপ দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। এমনকি, আদালতে কোনো পক্ষ হিসেবেও লড়েনি বিবিএ।
হাতিরঝিলে গার্ডার তৈরির প্রস্তুতি চলছে। এ কারণে এখন কাজ বন্ধ রয়েছে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে ইতালথাইয়ের সালিস নোটিশের ওপর শুনানি হবে। সে সময় পর্যন্ত বিবিএ অপেক্ষা করছে।
এ এইচ এম সাখাওয়াত আখতার, প্রকল্প পরিচালক
১ সেপ্টেম্বর আদালতের রায়ের পর নির্ধারিত সময় আগামী বছরের (২০২৫ সাল) জুনের মধ্যে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করার তাগাদা দিয়ে এফডিইইকে ১২ সেপ্টেম্বর চিঠি পাঠিয়েছে বিবিএ।
প্রকল্পের পরিচালক এ এইচ এম সাখাওয়াত আখতারের সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, গত আট মাস ধরে ন্যূনতম জনবল নিয়ে সাইট পর্যায়ে কাজ চলতে দেখা গেছে। শেয়ারধারী ও ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকায় গত তিন মাস ধরে কোনো কার্যক্রমই এক রকম নেই। ভূমি সমস্যার সমাধান করার পরও মগবাজার–মালিবাগ, খিলগাঁও ও হাতিরঝিল, পান্থকুঞ্জ ও কমলাপুর এলাকায় নির্মাণকাজের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। এ ধরনের বিলম্ব অগ্রহণযোগ্য। দ্রুত কোনো অগ্রগতি না হলে চুক্তির শর্ত অনুসারে বিবিএ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।
চিঠিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে এফডিইইকে দ্রুত ও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বলা হয় এবং সময় আর বাড়ানো হবে না বলে জানানো হয়। সবশেষে চিঠিটিকে ‘অত্যন্ত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে বিবেচনা করতেও বলা হয়েছে।
কাওলা ইয়ার্ডে গত ২ এপ্রিল গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো কাজ হচ্ছে নাছবি: নাজনীন আখতার
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের জন্য এফডিইইর চুক্তি হয়েছিল চীনের দুটি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান চায়না এক্সিম ব্যাংক এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নার (আইসিবিসি) সঙ্গে। তবে সময়মতো সুদ পরিশোধ করতে পারেনি ইতালথাই। ঋণের শর্ত অনুসারে সুদ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়া প্রতিষ্ঠান তার শেয়ারের অংশ অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে পারবে। ওই সময় চীনা দুটি প্রতিষ্ঠান শেয়ার নিতে চাইলে ইতালথাই রাজি হয়নি। এ অবস্থায় গত ১৭ জানুয়ারি ব্যাংক দুটি ঋণের অর্থ ছাড় বন্ধ করে দেয়। তখন সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে সালিস নোটিশ পাঠায় ইতালথাই। একই সময়ে হাইকোর্টে শেয়ার হস্তান্তরের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির আবেদন করে। ১২ মে ইতালথাইয়ের শেয়ার স্থানান্তরের ওপর স্থিতাবস্থা তুলে দিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে আপিল হলে আপিল বিভাগ আবার শেয়ার হস্তান্তরের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। সবশেষ ১ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ স্থগিতাদেশ খারিজ করে দেন।
গত ৩ এপ্রিল প্রথম আলোর ই–মেইলের জবাবে এফডিইইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ভাসকন খান্নাভা জানিয়েছিলেন, স্বল্প সময়ের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করে তাঁরা ৩০ জুনের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করবেন।
পরে ১ জুলাই আরেকটি ই–মেইলের জবাবে এফডিইই শেয়ার নিয়ে দ্বন্দ্ব ও অর্থসংকটে বেশিরভাগ জায়গায় কাজ বন্ধ থাকার কথা স্বীকার করে এবং জানায় যে অর্থ জোগাড় করে আগস্টে নির্মাণকাজ আবার শুরু করতে পারবে। ওই ই–মেইলে আরও বলা হয়, ইতালথাইয়ের সঙ্গে চীনা ঋণদাতা ও অংশীদারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। কোনো আইনি ভিত্তি ছাড়াই তারা এফডিইইর শেয়ার স্থানান্তর চায়।
এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর আরেকটি ই–মেইল করা হলে কোনো জবাব দেননি এমডি। প্রথম আলোর ই–মেইলে চারটি প্রশ্ন করা হয়েছিল। এগুলো হলো—নির্মাণকাজ কখন শুরু হবে, কাজ শুরুর জন্য প্রতিষ্ঠান ঋণ পেয়েছে কি না, সুপ্রিম কোর্ট শেয়ার স্থানান্তরের ওপর স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়ায় অন্য দুই অংশীদারির কাছে শেয়ার স্থানান্তর করা হবে কি না এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে দেনা পরিশোধে এফডিইই কী করছে।
এফডিইইর দেনার হিসাব থেকে দেখা গেছে, রড, তার, সিমেন্টসহ নানা মালামাল কেনা, কর্মীদের বেতন–ভাতা পরিশোধ, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিল (এফডিইইর তিন অংশীদার প্রকল্পে ঠিকাদার হিসেবেও কাজ করে) ইত্যাদি বাবদ ১ হাজার কোটি টাকার বেশি দেনা রয়েছে।
প্রকল্পের পরিচালক এ এইচ এম সাখাওয়াত আখতার গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাতিরঝিলে গার্ডার তৈরির প্রস্ততি চলছে। এ কারণে এখন কাজ বন্ধ রয়েছে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে ইতালথাইয়ের সালিস নোটিশের ওপর শুনানি হবে। সে সময় পর্যন্ত বিবিএ অপেক্ষা করছে।’
তবে কি অক্টোবরে কাজ শুরু হবে, জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘সেটা এখন বলা যাচ্ছে না। আদালত শেয়ারের ওপর স্থিতাবস্থা রাখার আবেদন খারিজ করে দেওয়ার পর এফডিইইকে কাজ শুরুর বিষয়ে চিঠি দিয়েছে বিবিএ। বিবিএ আর সময় বাড়াবে না।’ এফডিইইর ঋণ না পাওয়া ও দেনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা তাদের বিষয়। ওটা বিবিএর দেখার বিষয় না।’
হাতিরঝিল এলাকায় সীমিত জনবল দিয়ে কাজ চলছিল। সে কাজও এখন বন্ধছবি: নাজনীন আখতার
প্রকল্পের চুক্তি অনুসারে, এক্সপ্রেসওয়ের মূল কাঠামো নির্মাণব্যয়ের ৭৩ শতাংশ জোগান দেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। আর ২৭ শতাংশ দেবে বাংলাদেশ সরকার, যা ভায়াবিলিটি গ্যাপ (ভিজিএফ) নামে পরিচিত। অর্থসংকটে কাজ আটকে থাকায় সরকার এখন ভিজিএফ দেবে কি না, জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘কাজ আরেকটু এগোলে ভিজিএফ দেওয়ার বিষয়টি ভাবা হবে।’
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের মূল নির্মাণকাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। আনুষ্ঠানিক নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত এবং পরে ২০ মার্চ কারওয়ান বাজার (এফডিসি) এক্সপ্রেসওয়ের অংশ যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।
কাওলা থেকে শুরু হয়ে কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী এলাকায় গিয়ে শেষ হবে এ প্রকল্প।