বাজার সামলাতে হিমশিম অবস্থা
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 10-10-2024
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ছিল অত্যন্ত চড়া। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্রব্যমূল্য আরও বেড়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম কমাতে যতটা জোর দেওয়া দরকার ছিল, ততটা গুরুত্ব শুরু থেকে দেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। ইতিমধ্যে দাম অনেকটা বেড়ে গেছে। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে সরকার।

সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাস পর এখন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কিছু পণ্যের শুল্ক–কর কমানো হয়েছে। কিছু পণ্যের শুল্ক–কর কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাজারে অভিযান বাড়ানো হয়েছে। জেলায় জেলায় গঠন করা হয়েছে টাস্কফোর্স।

যদিও এর আগেই ভোজ্যতেল ও চিনি আমদানি কমে গেছে। এতে দাম বেড়েছে। ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম লাগামছাড়া। চাল ও আটার দাম বাড়তি। সবজির বাজারে যেন আগুন লেগেছে। সব মিলিয়ে কষ্টে আছে মানুষ।

 

গণ-অভ্যুত্থানের পর স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষের প্রত্যাশা ছিল, তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় কমবে। কিন্তু সেই প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয়নি, বরং নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে।

সেলিম রায়হান, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ গতকাল বুধবার ফেসবুকে লিখেছেন, ট্রাকে থাকা অবস্থায়ই কারওয়ান বাজারে চারবার ডিমের হাতবদল হয়। এখন পর্যন্ত এই সরকার কোনো ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙতে পারেনি। শুধু ‘সিন্ডিকেটের’ সাইনবোর্ড পরিবর্তন হয়েছে। তিনি প্রশ্ন করেন, সিন্ডিকেট ভেঙে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে এই অভ্যুত্থানের প্রাথমিক মাহাত্ম্য কী?

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ওই সরকারের সর্বশেষ আড়াই বছরে নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। সরকারও বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেল, পানি ও সারের দাম দফায় দফায় বাড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, সরকার পতনের আন্দোলনে নিম্ন আয়ের মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ ও শ্রমজীবী মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনায় বোঝা যায়, জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি তাঁদের অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে দ্রব্যমূল্য নিয়ে বলেন, জনগণের জীবনযাপন সহজ করতে দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ সরকার সচল করেছে।

আবার আমরা আমদানি বাড়াচ্ছি। সংকটের কারণে দাম বাড়ার সুযোগ থাকবে না।

মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল

 

নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে টাকার সরবরাহ কমিয়ে আনার নীতি গ্রহণ করে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ৫ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজ ও আলু আমদানিতে শুল্ক–কর কমানো হয়। পদক্ষেপ এর চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। ফলে বেড়ে যায় আরও কিছু পণ্যের দাম। এরপর গতকাল চিনির শুল্ক–কর কমানো হয়। এর আগে গত মঙ্গলবার সাড়ে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়।

সরকারের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ে সরকারের একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে সম্প্রতি ভোজ্যতেল ও ডিমের ওপরও শুল্ক–কর কমানোর সিদ্ধান্ত হয়। শিগগিরই এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। তবে পদক্ষেপগুলো সবই নেওয়া হয়েছে দাম বেড়ে যাওয়ার পর, আগে থেকে নয়।

অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করছে। একটু সময় লাগবে।

ভোজ্যতেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় পাম তেল। নিম্ন আয়ের মানুষ মূলত খোলা পাম তেল ব্যবহার করেন। খাদ্যশিল্পে পাম তেল ব্যবহার করা যায়। গত তিন মাসে ৩ লাখ ৩২ হাজার টন পাম তেল আমদানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ শতাংশ কম।

আমদানি কমেছে

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি ৯ শতাংশ কমেছে। আগের অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আমদানি হয়েছিল ৫ লাখ ৫৩ হাজার টন সয়াবিন ও পাম তেল। এ বছর তা ৫৩ হাজার টন কম।

ভোজ্যতেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় পাম তেল। নিম্ন আয়ের মানুষ মূলত খোলা পাম তেল ব্যবহার করেন। খাদ্যশিল্পে পাম তেল ব্যবহার করা যায়। গত তিন মাসে ৩ লাখ ৩২ হাজার টন পাম তেল আমদানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ শতাংশ কম।

দেশের কিছু কিছু মিল কর্তৃপক্ষ সয়াবিনের বীজ আমদানি করে তা থেকে তেল উৎপাদন করে। তিন মাসে সয়াবিনের বীজ আমদানি ২২ শতাংশ কমে ২ লাখ ৩৮ হাজার টনে নেমেছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) হিসাবে, খুচরা বাজারে খোলা পাম তেলের দাম এক মাসে প্রতি লিটারে ৯–১০ টাকা বেড়ে ১৪০-১৪৪ টাকা হয়েছে। খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ৩ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৫১-১৫৫ টাকা।

বিগত তিন মাসে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৩৯ হাজার টন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫১ শতাংশ কম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি কমার কারণ চোরাচালান। ভারত থেকে অবৈধ পথে চিনি আসে। এ কারণে তাঁরা আমদানি কমিয়েছেন। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর চোরাচালান কিছুটা কমেছে; কিন্তু আমদানি বাড়েনি। বিশ্ববাজারেও কিছুটা বাড়তি। এসব কারণে চিনির দাম বাড়ছে।

টিসিবির হিসাবে, বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১২৫ থেকে ১৩৫ টাকা, যা এক মাসে আগে ছিল ১২৫-১৩০ টাকা।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) হিসাবে, খুচরা বাজারে খোলা পাম তেলের দাম এক মাসে প্রতি লিটারে ৯–১০ টাকা বেড়ে ১৪০-১৪৪ টাকা হয়েছে। খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ৩ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৫১-১৫৫ টাকা।

দাম কমাতে সরকার গতকাল অপরিশোধিত ও পরিশোধিত চিনির ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। এনবিআর বলেছে, এতে আমদানি পর্যায়ে প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনির শুল্ক–কর ১১ দশমিক ১৮ টাকা এবং পরিশোধিত চিনির শুল্ক–কর ১৪ দশমিক ২৬ টাকা কমবে। উল্লেখ্য, এত দিন এক কেজি চিনিতে ৪৩ টাকা শুল্ক–কর দিতে হতো।

পেঁয়াজ আমদানিও কমেছে। গত তিন মাসে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল সাড়ে তিন লাখ টন। পণ্যটির শুল্ক–কর কমানোর পরও দাম বেড়েছে কেজিতে ৫–১০ টাকা। টিসিবির হিসাবে দাম এখন প্রতি কেজি ১০০-১২০ টাকা।

টিসিবির হিসাবে, বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১২৫ থেকে ১৩৫ টাকা, যা এক মাসে আগে ছিল ১২৫-১৩০ টাকা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শুল্ক কমানোর পাশাপাশি সরবরাহ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি দাম যাতে কমে, সে অনুযায়ী বাজারে নজরদারি দরকার।

আমদানি কমে যাওয়ার পেছনে কোনো কোনো শিল্পগোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়াকেও দায়ী করছেন আমদানিকারকেরা। তাঁরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে এস আলম ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট গ্রুপগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক থেকে সরকারি দরে ডলার কিনত। সাধারণ আমদানিকারকদের কিনতে হতো বাজারদরে, যা প্রতি ডলারে ৮-১০ টাকা বেশি। এতে বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। অন্য বড় গ্রুপগুলো আমদানি কমাতে বাধ্য হয়। বিএসএমের মতো ভোগ্যপণ্য আমদানিতে একসময় শীর্ষ পাঁচে থাকা গ্রুপ এখন বাজার থেকে ছিটকে পড়ে।

পেঁয়াজ আমদানিও কমেছে। গত তিন মাসে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল সাড়ে তিন লাখ টন। পণ্যটির শুল্ক–কর কমানোর পরও দাম বেড়েছে কেজিতে ৫–১০ টাকা। টিসিবির হিসাবে দাম এখন প্রতি কেজি ১০০-১২০ টাকা।

 

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দু-একটি শিল্পগোষ্ঠীর আমদানি কমেছে। এনবিআরের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এস আলম গ্রুপ পণ্য আমদানি করে দুই লাখ টন। চলতি বছর একই সময়ে গ্রুপটি আমদানি করেছে ৮৩ হাজার টনে। বসুন্ধরা গ্রুপের আমদানি ১ লাখ ১০ হাজার টন থেকে কমে হয়েছে ৫০ হাজার টন।

একসময়ের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও অসম প্রতিযোগিতায় পড়ে তাঁরা আমদানি কমাতে বাধ্য হয়েছেন। এখন সবার জন্য ডলারের দাম একই রকম থাকলে অনেকেই বাজারে সক্রিয় হবেন।

সরকার পরিবর্তনের পর এস আলম গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ ও বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালকদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই), সিটি গ্রুপ ও টি কে গ্রুপের মতো বড় শিল্প গ্রুপের ভোগ্যপণ্য আমদানি, পরিশোধন ও উৎপাদনের সক্ষমতা দেশি চাহিদার তুলনায় বেশি। তারা সক্রিয় থাকলে বাজারে সংকট হবে না।

মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবার আমরা আমদানি বাড়াচ্ছি। সংকটের কারণে দাম বাড়ার সুযোগ থাকবে না।’

মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার আরও ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য মুদ্রা ও রাজস্বনীতি এবং কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনার সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান

বিশ্ববাজারে দাম বাড়ছে

বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেল, চিনি, গম, মসুর ডালসহ কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে গমের দাম বেড়েছে প্রতি টনে ১৩ থেকে ১৯ ডলার। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মসুর ডাল আমদানিতে প্রতি টনে খরচ পড়ত ৬৩০-৬৪০ ডলার। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৬৮০-৬৯০ ডলার। অবশ্য গম ও মসুর ডালের আমদানি অনেকটাই বেড়েছে।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, আমদানি ব্যয় যতটা বেড়েছে, তার চেয়ে দাম বাড়ছে বেশি। যেমন পাম তেল আমদানিতে লিটারে খরচ বেড়েছে সাড়ে ছয় থেকে সাত টাকা। তবে চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে পাম তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ১৯ টাকা।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মসুর ডাল আমদানিতে প্রতি টনে খরচ পড়ত ৬৩০-৬৪০ ডলার। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৬৮০-৬৯০ ডলার। অবশ্য গম ও মসুর ডালের আমদানি অনেকটাই বেড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষের প্রত্যাশা ছিল, তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় কমবে। কিন্তু সেই প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয়নি, বরং নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে যতটা গুরুত্ব দেওয়ার দরকার ছিল, শুরুতে তা দেখা যায়নি। এখন কিছু পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার আরও ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য মুদ্রা ও রাজস্বনীতি এবং কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনার সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার।


 

শেয়ার করুন