মানুষের মৃত্যু সন্ত্রাসীদের গুলিতে, বলছে পুলিশ
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 01-08-2024
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

রাজধানীতে বিক্ষোভকালে নিহত অন্তত ৬৪ জনের ঘটনায় মামলা করেছে পুলিশ। এসব মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটেছে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসী বা দুষ্কৃতকারীদের ছোড়া এলোপাতাড়ি গুলিতে।

পুলিশ বাদী হয়ে করা ৩৪টি মামলার তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মামলাগুলোর এজাহারের শেষাংশে বর্ণনা প্রায় একই রকম। তাতে বলা হয়, বিএনপি ও জামায়াত এবং তাদের অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে সন্ত্রাসী অথবা দুষ্কৃতকারীরা আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য ও মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করে। নিহতের ঘটনা ঘটেছে কোটাবিরোধী আন্দোলনের আড়ালে থাকা সন্ত্রাসী বা দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে।

পুলিশের মামলার বাইরে তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। মামলার নথিতে বাদী হিসেবে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের নাম রয়েছে। এসব মামলায়ও ‘সন্ত্রাসীদের গুলিতে’ মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে।

এর মধ্যে দুটি মামলার নথিতে উল্লেখ করা বাদীর নম্বরে ফোন করা হলে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, মামলার বিষয়টি তাঁরা তেমন বোঝেন না। স্বজনদের মরদেহ নেওয়ার সময় তাঁদের বিভিন্ন কাগজে সই নেওয়া হয়।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও সংঘাতে গত ১৬ জুলাই থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ২১২ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সরকার এ পর্যন্ত ১৫০ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে।

এসব সংঘর্ষকালে কেবল ঘটনাস্থলে নয়; বাসার ভেতরে ও ছাদে থাকা কিছু মানুষও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। কদমতলীতে তিন বছরের শিশু আবদুল আহাদ নিহতের ঘটনায় ২৮ জুলাই থানায় মামলা করে পুলিশ। বাদী কদমতলী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কে এম জাহান-ই–আলম। মামলার এজাহারে পুলিশ বলেছে, আহাদ বাসার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। গত ১৯ জুলাই বেলা দেড়টার দিকে সে গুলিবিদ্ধ হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

যাত্রাবাড়ীতে ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে অনলাইন সংবাদমাধ্যম ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক মেহেদী হাসান মারা যান। তিনিসহ সাতজনের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় গত ২৭ জুলাই মামলা করেন যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক মো. হোসেন জায়েদ। এতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়।

আহাদ হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা সাত–আট হাজার দুষ্কৃতকারীকে। এজাহারে পুলিশ বলেছে, দুষ্কৃতকারীরা কদমতলী থানা আক্রমণ এবং বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ, লাঠিসোঁটা ও লোহার রড দিয়ে আঘাত, ককটেল ও পেট্রলবোমা নিক্ষেপ এবং গুলিবর্ষণ করে। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের (টিয়ার) শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও শটগান ব্যবহার করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর পুলিশ জানতে পারে, কোটাবিরোধী আন্দোলনের আড়ালে থাকা দুষ্কৃতকারীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে আবদুল আহাদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে।

মামলায় বলা হয়, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাদের আক্রমণ করা হয়েছে বিএনপি ও জামায়াত-শিবির এবং তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের নির্দেশে। আক্রমণকারীদের মধ্যেও তাঁরা ছিলেন। ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজনের থেকে পাওয়া তথ্য, ক্লোজড সার্কিট (সিসিটিভি) ক্যামেরার ফুটেজ এবং ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সংবাদকর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া ভিডিও চিত্র পর্যালোচনা করে পুলিশ এসব তথ্য জানতে পেরেছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।

এই মামলার বাদী এসআই কে এম জাহান-ই-আলম প্রথম আলোকে বলেন, কে বা কারা আহাদকে গুলি করেছিল, তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।

পুলিশ পরিদর্শক মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়াকে হত্যার ঘটনায় খিলগাঁও থানায় মামলা করেন তাঁর স্ত্রী মেরিনা আক্তার। এজাহারে বলা হয়েছে, দুর্বৃত্তরা তাঁর স্বামীকে বিভিন্ন বস্তু দিয়ে আঘাত করে মেরেছে।

২৮ মৃত্যুতে ১২ মামলা যাত্রাবাড়ীতে

ঢাকা ও বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৬, ১৭, ১৯, ২০ ও ২১ জুলাই। এরপর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কিছু মানুষ মারা যান। সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে ১৮, ১৯ ও ২০ জুলাই।

ঢাকায় দায়ের হওয়া যে ৩৭ মামলার তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে ৬৭ জনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ রয়েছে। এঁদের মধ্যে ৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে গুলিতে। ৫ জনের মৃত্যু মারধর ও আঘাতে। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে যাত্রাবাড়ী থানায়। এই থানার ১২টি মামলায় ২৮ জনের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে।

যাত্রাবাড়ীতে ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে অনলাইন সংবাদমাধ্যম ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক মেহেদী হাসান মারা যান। তিনিসহ সাতজনের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় গত ২৭ জুলাই মামলা করেন যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক মো. হোসেন জায়েদ। এতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়।

মামলাটিতে ঘটনার যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা অন্যান্য মামলার মতোই। এতে দুজনকে পিটিয়ে ও পাঁচজনকে গুলি করে হত্যার কথা বলা হয়েছে। বাদী এসআই মো. হোসেন জায়েদ প্রথম আলোকে বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের আড়ালে থাকা সন্ত্রাসীদের গুলিতে সাংবাদিক মেহেদীসহ অন্যরা নিহত হয়েছেন। সন্ত্রাসীদের হাতে পুলিশ সদস্যরাও আহত ও নিহত হয়েছেন। তবে কারা গুলি করেছে, সেটি তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে।

অবশ্য যাত্রাবাড়ী ও রায়েরবাগে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া অন্তত দুজনের স্বজনেরা দাবি করেন, ঘটনাস্থলে পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবি অনেক গুলি করেছে। পুলিশই মামলা করেছে। ফলে সঠিক তদন্ত ও ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে তাঁরা সন্দিহান।

সাংবাদিক মেহেদী হাসানের ভাই জাহিদ আশিক ১৯ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে প্রথম আলোকে বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ার মাছের আড়তের কাছে গুলি করে তাঁর ভাইয়ের বুক ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছে। তিনি ভাই হত্যার বিচার চান।

নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের দাবি ও মামলার এজাহারের ভাষ্যের বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, নিহতের প্রত্যেকটি ঘটনা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত হওয়া উচিত। নিরপেক্ষ তদন্ত না হলে, প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা না হলে স্বজনদের মনে চরম ক্ষোভের সঞ্চার হবে।

যাত্রাবাড়ী ছাড়াও মোহাম্মদপুর ও রামপুরা থানায় ২টি করে মামলা হয়। এতে ৫ জন করে ১০ জন নিহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া ভাটারায় ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ৩টি, কদমতলী থানায় ৩ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ৩টি, লালবাগ থানায় ৩ জনের মৃত্যুতে ২টি, বনানী থানায় ৩ জনের মৃত্যুতে ১টি, উত্তরা ও মিরপুর থানায় ২ জন করে মৃত্যুর ঘটনায় ২টি করে, ধানমন্ডি ও কাফরুলে ২ জন করে মৃত্যুর ঘটনায় ১টি করে এবং গুলশান, বাড্ডা ও হাতিরঝিলে ১ জন করে মৃত্যুর ঘটনায় ১টি করে মামলা হয়েছে।


 

শেয়ার করুন