রেলস্টেশন মাস্টারের টেবিলে চারটি টেলিফোন। একটি দিয়ে গেটকিপারের সঙ্গে কথা বলেন। একটি দিয়ে কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। আরেকটি দিয়ে আগে পরের স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা হয়। চতুর্থ টেলিফোনটি ডিজিটাল, যা দিয়ে জানা যায় কোন ট্রেন কখন কোথায় অবস্থান করছে। তবে ওই টেবিলে টেলিফোনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি যন্ত্র আছে, মনিটর। এর দিকে সারাক্ষণ চোখ রাখতে হয়। ট্রেন স্টেশনে ঢোকার আগেই মনিটরে সিগন্যাল আসে। সেটা দেখে স্টেশনমাস্টারকে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিতে হয়; অন্যথায় ট্রেনটি স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে।
এসব দায়িত্ব স্টেশনমাস্টারকেই পালন করতে হয়। স্টেশনমাস্টার না থাকলে ওই রেলস্টেশনের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। ফলে জনবলসংকটে অনেক স্টেশনমাস্টারকে দীর্ঘ সময় এই কাজ করতে হচ্ছে।
রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই অঞ্চলে স্টেশনমাস্টারের পদ রয়েছে ৯৭৫টি। এর বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ৩৫২ জন; অর্থাৎ পদ খালি ৬২৩টি।
গত শনিবার নাটোরের আজিমনগর স্টেশনের দায়িত্বরত মাস্টার আলমগীর হোসেনের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে কথা হয়। তখন সময় প্রায় বেলা সোয়া ১১টা। তিনি জানান, গত শুক্রবার আজিমনগর স্টেশনে এসেছেন। শনিবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করেছেন। টানা ৪৮ ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের পর তিনি বিশ্রামে যাবেন।
আলমগীর হোসেনের (৩১) কর্মস্থল দর্শনা জংশন। গত ২৪ মার্চ তাঁকে রাজশাহীর আড়ানী স্টেশনে প্রেষণে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তিনি আজিমনগর স্টেশনে এসেছেন। তিনি জানান, লোকবল কম থাকার কারণে তাঁকে আড়ানীতে টানা ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। আজিমনগর স্টেশনে প্রেষণে আসা আরেক স্টেশনমাস্টারের নাম কামরুল হাসান। তিনি টানা ৭২ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করে শুক্রবার বিশ্রামে গেছেন।
আলমগীর হোসেন বললেন, এই স্টেশনে ৫০টির বেশি ট্রেন ২৪ ঘণ্টায় যাতায়াত করে। এর মধ্যে রাত ১২টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত ১২টি ট্রেন আপ–ডাউন করে। এই স্টেশনের স্টপেজ আছে ১৬টি ট্রেনের। নিয়ম অনুযায়ী, চারজন স্টেশনমাস্টার থাকার কথা। এখানে আছেন একজন। তা–ও অন্য স্টেশন থেকে ডেপুটেশনে বা রিলেভিংয়ে (releaving) নিয়ে এসে কাজ করানো হচ্ছে।
নিয়ম অনুযায়ী, আজিমনগর স্টেশনে চারজন মাস্টার, বুকিং সহকারী দুজন, পটার দুজন, পয়েন্টম্যান চারজন, সিগন্যাল খালাসি দুজন, ক্লিনার দুজন থাকার কথা। তবে প্রেষণে আসা দুজন মাস্টারসহ আছেন মোট ৯ জন।
আলমগীর হোসেনের বাড়ি চুয়াডাঙ্গা। তিনি ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সহকারী স্টেশনমাস্টার পদে যোগ দেন। তাঁর প্রথম কর্মস্থল দর্শনা জংশন। গত ২৪ মার্চ তাঁকে রাজশাহীর আড়ানী রেলস্টেশনে প্রেষণে পাঠানো হয়। এখনো আড়ানীতে কর্মরত আছেন। এর মধ্যে আজিমনগর স্টেশনের লোকবলসংকটের কারণে তিন দিনের জন্য আজিমনগর পাঠানো হয়েছে। এর আগেও একইভাবে তাঁকে আজিমনগর ও মাজগ্রাম স্টেশনে পাঠানো হয়েছিল। যখন যেখানে জনবলসংকট দেখা দেয়, তখন সেখানে তাঁকে পাঠানো হয়।
আলমগীর হোসেন বলেন, কর্মস্থলে টেবিল ছেড়ে দূরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ঘুম, খাওয়া—সব টেবিলে বসেই করতে হয়। স্টেশনে ঘুমের কোনো জায়গাও নেই; সুযোগও নেই। স্টেশনমাস্টার একবার ঘুমিয়ে গেলেই সব ট্রেন এসে দাঁড়িয়ে থাকবে।
কথায় কথায় আলমগীর হোসেন বলেন, স্টেশনমাস্টারের পদ ১৫ গ্রেডের। ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতক পাস। শুরুতে এই পদে ১৬ হাজার টাকার মতো পাওয়া যায়। বাড়ি ছেড়ে দূরে থাকতে হয়; বাইরে বাইরে খেতে হয়। এই পদে দায়িত্ব বেশি; সুযোগ-সুবিধা কম। সবচেয়ে বড় কথা বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায় না। এই চাকরিতে যোগ দিয়ে সবাই চেষ্টা করেন অন্য চাকরির।
মূল দায়িত্বের বাইরেও স্টেশনমাস্টারকে অনেক কাজ করতে হয়। আলমগীর হোসেন বলেন, স্টেশনের যত ধরনের ঝামেলা থাকে, সবকিছুর সমাধান করতে হয় স্টেশনমাস্টারকে। যাত্রীচাপ, যাত্রীর তথ্য, যাত্রীরা কোনো অভিযোগ করলে সেটাও দেখতে হয়।
নাটোরের আজিমনগর রেলস্টেশন
ঘড়িতে তখন বেলা ১১টা ১৩ মিনিট। আলমগীর হোসেন জানান, সকাল থেকে এ পর্যন্ত বাইরে যাওয়ার সুযোগ পাননি; টেবিলে বসেই এক কাপ চা ও বিস্কুট খেয়েছেন। কিছুক্ষণ পর নাশতা করতে যাবেন। টানা ৪৮ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করে তিনি বিশ্রামে যাবেন। এ ধরনের দায়িত্বের কারণে পরিবার সঙ্গে রাখা যায় না। আবার পরিবারের সঙ্গে সব সময় দেখা করাও যায় না। বাড়ির কাছাকাছি কর্মস্থল হলে পরিবারকে কিছুটা সময় দেওয়া যায়।
এক প্রশ্নের জবাবে আলমগীর হোসেন বলেন, তিনি শুনেছেন, ওভারটাইম পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি কখনো নিতে যাননি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাঁরা এভাবেই পালা করে চাকরি করেন।
এ ব্যাপারে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (সিওপিএস) আহসানুল্লাহ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, জনবলসংকটে স্টেশনমাস্টারকে টানা ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়। নিয়োগসংক্রান্ত আইনি জটিলতার কারণে নতুন স্টেশনমাস্টার নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু স্টেশনমাস্টার ছাড়া ট্রেনে চালানো যাবে না। ইতিমধ্যে ৭২টি স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে স্টেশনমাস্টারকে প্রেষণে এনে ট্রেন চালানো হচ্ছে।