স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেছেন, এখনো বেশির ভাগ সন্তান প্রসব হচ্ছে বাড়িতে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, সরকারি হাসপাতালে প্রসব কম হয়। সরকারি হাসপাতালে বেলা ১টা–২টার পর চিকিৎসক থাকেন না। কথাটা অপ্রিয় হলেও সত্য। তবে এটি শুধু সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রেই নয়, প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা বা সদর, জেলা হাসপাতালেও এই দৃশ্য দেখা যায়।
আজ বুধবার ‘গ্রামীণ নারীদের মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও দাইমাদের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে উবিনীগ ও নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা।
স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নানামুখী সংকট রয়েছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘মাতৃস্বাস্থ্যের দিক বিবেচনা করলে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা খুবই শোচনীয়। দেশে মাতৃস্বাস্থ্যের যে কর্মকাণ্ড দরকার ছিল, তার ধারেকাছেও স্বাস্থ্যব্যবস্থা নেই। স্বাস্থ্যবিধি বিবেচনা করলে যে গুণগতমান রক্ষা করা প্রয়োজন, তা হাসপাতালগুলোতে নেই। যেখানে ৫০ জন মায়ের শয্যা রয়েছে, সেখানে ১০০ মাকে রাখা হয়েছে। এক শয্যায় তিনজন শিশুকে রাখা হয়েছে। সব জায়গায় করুণ চিত্র। চিকিৎসক–সংকট প্রচণ্ড। সরকারি হাসপাতালে যত চিকিৎসক দরকার, তত নেই। বিভিন্ন কারণে তাঁরা দেশের বাইরে অবস্থান করেন। পড়াশোনা, প্রাইভেট প্র্যাকটিস—এসব নানা কারণে তাঁরা চলে যান।
উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, ‘সরকারের কাছে এমন কোনো মেকানিজম (কৌশল) নেই, জাদুবলে পরিবর্তন করতে পারব। সমস্যার কথা জানি। সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার আমার কাছে নেই। কারণ, আমি চাইলেই ডাক্তার নিয়োগ দিতে পারব না। আমার ইচ্ছা, যদি পারি, কিছু সুপারিশ রেখে যাব। যাতে পরবর্তী সরকার তা গ্রহণ করে।’
প্রসবকালীন জটিলতা ও বিপদ সম্পর্কে দাইমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ওপর জোর দেন তিনি। মায়ের অবস্থা জটিল বুঝতে পারলে দাইমারা যেন প্রসবের চেষ্টা না করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন, সেই পরামর্শ দেন তিনি।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী দাইমারা বলেন, বিভিন্ন সময়ে তাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়ে গর্ভকালীন ঝুঁকিগুলোর বিষয়ে জানতে পেরেছেন। সেসব ক্ষেত্রে তাঁরা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন মাকে। প্রসবের জন্য তাঁরা কোনো অর্থ দাবি করেন না। পরিবারগুলো খুশি হয়ে যা দেয়, তাই নেন। আলোচকেরা বলেন, অনেক সময় চিকিৎসক স্বাভাবিক প্রসবের চেষ্টা না করে অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্ম (সিজারিয়ান সেকশন) দেওয়ার ব্যবস্থা নেন। এর ফলে একদিকে অযাচিত সি–সেকশন হচ্ছে, অপর দিকে রোগীর পকেট থেকে অতিরিক্ত টাকা চলে যাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে বেলা ১টার পর চিকিৎসক পাওয়া যায় না।
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলা থেকে আসা দাইমা খাদিজা বেগম বলেন, নানি ও মায়ের হাত ধরে তিনিও দাইমা হয়েছেন। ২৫ বছরে তাঁর হাতে দুই হাজারের মতো সন্তান প্রসব হয়েছে। তিনি প্রসবের সময়ের বিপদগুলো সম্পর্কে অবহিত আছেন।
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা থেকে আসা দাইমা মমতাজ বেগম বলেন, অন্তঃসত্ত্বা মায়ের হঠাৎ রক্তপাত শুরু হলে, মাথাব্যথা–চোখে ঝাপসা দেখলে, অতিরিক্ত জ্বর হলে, খিঁচুনি হলে এবং বিলম্বিত প্রসব—এই পাঁচটি লক্ষণকে বিপদের চিহ্ন হিসেবে শিখেছেন তাঁরা। এমন দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা হাসপাতালে গিয়ে প্রসব করাতে বলেন।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা থেকে আসা দাইমা মমতা বেগম এবং ঈশ্বরদী থেকে আসা সংগঠক আজমিরা খাতুন জানান, তাঁরা অন্তঃসত্ত্বা মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করতে ও পরিবারগুলোতে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করেন। মা যে ভারী জিনিস তুলতে পারবেন না, কল চেপে পানি আনতে পারবেন না, মায়ের বিশ্রাম প্রয়োজন—এসব দিকে খেয়াল রাখতে পরিবারগুলোকে উদ্বুদ্ধ করেন।
অনুষ্ঠানে সভাপ্রধানের বক্তব্য দেন স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক সামিনা চৌধুরী। তিনি বলেন, গ্রামে ৫৩ শতাংশ প্রসব দাইমাদের হাতে হচ্ছে। মাতৃমৃত্যুর বড় কারণ হচ্ছে বাড়িতে প্রসব। এর মধ্যে ২২ শতাংশ মাতৃমৃত্যু হয় রাস্তায়। হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে রক্তপাতের কারণে মৃত্যু হয়। প্রতি ১০০টি স্বাভাবিক প্রসবের মধ্যে ১৫টিতে জটিলতা থাকে। করোনার সময় যখন চিকিৎসকদের পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন দাইমারা এগিয়ে এসেছিলেন প্রসবে। প্রসবে সহায়ক ভূমিকা পালনের জন্য অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ পরীক্ষা করার মতো প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত দাইমাদের। তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত দাইমাদের জানান কী কী কারণে কোন অবস্থায় অন্তঃসত্ত্বা মায়ের অবস্থা জটিল আকার ধারণ করে।
অনুষ্ঠানে নারীপক্ষের প্রকল্প পরিচালক সামিয়া আফরিন বলেন, প্রসবব্যথা যেকোনো সময় উঠতে পারে। অনেক সময় সময়মতো সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক পাওয়া যায় না। দাইমারা নিঃস্বার্থভাবে অন্তঃসত্ত্বা মায়ের পাশে যেকোনো সময় এসে দাঁড়ান। দাইমাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। অন্তঃসত্ত্বা মায়ের বিপদচিহ্ন জানাতে দাইমাদের প্রশিক্ষণ আরও বাড়াতে হবে এবং প্রসবকালীন সহায়তার জন্য হাসপাতালের চিকিৎসকের সঙ্গে তাঁদের যোগসূত্র ঘটাতে হবে। তিনি দাইমাদের জন্য সম্মানী ভাতা চালুরও সুপারিশ করেন।
সভা সঞ্চালনা করেন নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার পরিচালক সীমা দাস সীমু।