বিদেশ থেকে টেলিফোন কল আনতে ১০ বছর আগে গড়ে ওঠা আইজিডব্লিউ অপারেটর ফোরামের (আইওএফ) সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিটিআরসি। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান এটির ‘হোতা’ ছিলেন এবং সিন্ডিকেটটি থেকে তাঁর প্রতিষ্ঠানেই ৬০০ কোটি টাকার বেশি গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ সিন্ডিকেটের কারণে গ্রাহকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সরকার রাজস্ব হারিয়েছে এবং বিশেষ গোষ্ঠী সুবিধা পেয়েছে। একসময় এ সিন্ডিকেটের অনুমোদন দিয়ে এখন অনিয়ম ও বাজার অস্থিতিশীলতার কথা বলে তা ভাঙতে চাইছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
হাতে হাতে যখন ইন্টারনেট ছিল না, তখন বিদেশ থেকে আইজিডব্লিউ (ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে) প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে দেশে ফোনকল আনার ব্যবসা ছিল জমজমাট। ইন্টারনেটের প্রসার ও ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে গত কয়েক বছরে এ ব্যবসা প্রায় তলানিতে নেমেছে।
বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, ২৪টি প্রতিষ্ঠানের আইজিডব্লিউ লাইসেন্স রয়েছে। বর্তমানে বিদেশ থেকে প্রতিদিন টেলিফোন কল আসে ১ কোটি মিনিটের কিছু বেশি, যা ১০ বছর আগে ছিল ১০ কোটি মিনিটের বেশি।
বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, ২৪টি প্রতিষ্ঠানের আইজিডব্লিউ লাইসেন্স রয়েছে। বর্তমানে বিদেশ থেকে প্রতিদিন টেলিফোন কল আসে ১ কোটি মিনিটের কিছু বেশি, যা ১০ বছর আগে ছিল ১০ কোটি মিনিটের বেশি।
টেলিযোগাযোগ খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, আইওএফ ছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনুমোদিত রাজস্ব ফাঁকির এক ব্যবস্থা। ক্ষমতাচ্যুত এ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সায়ে গড়ে ওঠে এ সিন্ডিকেট, যা নিয়ন্ত্রণ করতেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান। টেলিযোগাযোগ খাতের নানা পক্ষের বিরোধিতা সত্ত্বেও বিটিআরসি ২০১৫ সালের ২৪ জুন থেকে আইওএফের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফোনকল আনার নতুন নিয়মের অনুমোদন দেয় সরকার। এ নিয়মে ২৩টি আইজিডব্লিউ অপারেটরের মধ্যে মাত্র ৭টি কল টার্মিনেট বা গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। আন্তর্জাতিক ফোনকল নিয়ন্ত্রণের জন্য এই সাত প্রতিষ্ঠান নিজেরাই একটি কমন ইন্টারন্যাশনাল পয়েন্ট (সিআইপি) তৈরি করে।
এ–সংক্রান্ত চুক্তির পর কলরেট বাড়ানো হয় এবং বৈধ পথে বিদেশ থেকে ফোনকল আসা কমে অবৈধ ভিওআইপি কল বেড়ে যায়। এ নিয়ে ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আইওএফ কল টার্মিনেশন রেট বা হার দেড় সেন্ট থেকে বাড়িয়ে দুই সেন্ট নির্ধারণ করে। কল রেট বাড়ানো হলেও সরকার, মোবাইল অপারেটর ও ইন্টার এক্সচেঞ্জ অপারেটরদের (আইসিএক্স) মধ্যে দেড় সেন্ট দাম ধরেই রাজস্ব ভাগাভাগি হচ্ছে। ফলে টার্মিনেশন হারে বাড়তি মূল্যের সুফল পাচ্ছে শুধু আইজিডব্লিউ অপারেটররা।’
এ ছাড়া নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ও মানোন্নয়নে আইওএফের গড়া ‘মার্কেট ডেভেলপমেন্ট এক্সপেন্স (এমডিএস)’ নামের ফান্ডের টাকার প্রায় পুরোটাই নিয়েছে সালমানের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো কম্পিউটারস লিমিটেড।
আইওএফ নিয়ে বিটিআরসির সিদ্ধান্ত
বিটিআরসির সর্বশেষ বৈঠকে কল আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে আইওএফ এবং আইজিডব্লিউ অপারেটরদের মধ্যকার অপারেশনাল চুক্তির অনুমোদন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। এ বিষয়ে কমিশন একটি নির্দেশিকা জারি করবে।
বৈঠকে এই অপারটেরদের আইজিডব্লিউ হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করা, আন্ত–অপারেটর সংযোগ স্থাপন এবং কল আদান–প্রদানের জন্য সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক কল পরিচালনার ক্ষেত্রে নতুনভাবে কমন পয়েন্ট নির্ধারণ, নগদায়নযোগ্য ব্যাংক গ্যারান্টি গ্রহণ, একক এমএনপি সার্ভার ব্যবহার করে ডিপিং কার্যক্রম পরিচালনা, কলের সমতা বণ্টন এবং বিদেশি কল আদান–প্রদান ও মনিটরিং কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিটিআরসি তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে এখনো কিছু জানায়নি। তবে আইজিডব্লিউ ও আইওএফের মধ্যে চুক্তির সংস্কার নিয়ে বিটিআরসির সঙ্গে চিঠি চালাচালি চলছিল।
আসিফ রব্বানী, আইওএফের সভাপতি
আইওএফ সম্পর্কে বিটিআরসি বলেছে, অপারটেরদের মধ্যে আন্তর্জাতিক কল আদান–প্রদানের বাজারে শৃঙ্খলা বজায় রাখা, কল টার্মিনেশন মূল্য নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা হ্রাস ও অপারেটরদের রাজস্ব নিশ্চিত করা এবং অবৈধ পথে আন্তর্জাতিক কল আদান–প্রদান বন্ধে আইজিডব্লিউ ও আইওএফের মধ্যকার চুক্তিকে সরকার অনুমোদন দেয়। কিন্তু আইওএফ তার মূল উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি। সরকার কলরেট কমালেও দেশে আন্তর্জাতিক কলের ভলিউম কমেছে। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, আইজিডব্লিউ অপারেটরদের বকেয়া থাকছে। এ ছাড়া আইওএফ কমিশনের নির্দেশনার বাইরে গিয়ে কমিশন অনুমোদিত চুক্তিকে অনুমোদনহীনভাবে সংশোধন করেছে। পাশাপাশি এমডিএস ফান্ডের নামে গৃহীত অর্থ ব্যয়ে অস্বচ্ছতা রয়েছে।
উল্লেখ্য, আইজিডব্লিউ ও আইওএফের মধ্যকার ওই চুক্তি গত মার্চ মাসে শেষ হয়েছে।
আইওএফের সভাপতি আসিফ রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, বিটিআরসি তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে এখনো তাঁদের কিছু জানায়নি। তবে আইজিডব্লিউ ও আইওএফের মধ্যে চুক্তির সংস্কার নিয়ে বিটিআরসির সঙ্গে তাঁদের চিঠি চালাচালি চলছিল।
চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে আসিফ রব্বানী বলেন, ২০১৪ সাল পর্যন্ত আইজিডব্লিউ লাইসেন্স নিয়ে অনেকে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। এ ফাঁকি যাতে না দিতে পারে, সে উদ্দেশ্যেই ওই চুক্তি হয়। চুক্তির পর বিটিআরসির কাছে কারও কোনো বকেয়া থাকেনি দাবি করে তিনি বলেন, চুক্তি বাতিল হলে আইজিডব্লিউগুলো শৃঙ্খলার বাইরে চলে যাবে।
বেক্সিমকোর অ্যাকাউন্টে ৬০০ কোটি টাকার বেশি
বিটিআরসির আইজিডব্লিউ লাইসেন্সধারীর তালিকায় বেক্সিমকো নামের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। কিন্তু আইজিডব্লিউ অপারেটরদের ফোরামের মার্কেট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের টাকার অন্তত ৯৫ শতাংশ ঢুকেছে বেক্সিমকো কম্পিউটারস লিমিটেডের অ্যাকাউন্টে।
বিটিআরসি বলেছে, শুরু থেকে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এমডিএসের অ্যাকাউন্টে ৬৩১ কোটি ১৫ লাখ ৭৯ হাজার ২৭৬ টাকা জমা হয়। এর মধ্যে ৬২৫ কোটি ৮৩ লাখ ৫২ হাজার ৪৫৬ টাকা খরচ হয়েছে এবং ৫ কোটি ৩২ লাখ ২৬ হাজার ৮২০ টাকা রয়েছে। যে ৬২৫ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে, তার অন্তত ৯৫ শতাংশ বেক্সিমকো কম্পিউটারস লিমিটেড নামের অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে।
এ অর্থ একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যয় করার বিষয়ে অস্বচ্ছতা রয়েছে উল্লেখ করে বিটিআরসি তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চিঠি দিয়েছে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দলটির নেতারা লাভজনক খাত হিসেবে আইজিডব্লিউ লাইসেন্স নিতে শুরু করেন। লাইসেন্স নেওয়ার পরপর অনেকেই রাজস্ব ফাঁকি দিতে শুরু করেন। এমন ছয়টি আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠান থেকে বিটিআরসির অন্তত হাজার কোটি টাকা পাওয়া রয়েছে।
এই বেক্সিমকো কম্পিউটারস লিমিটেড আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও সাবেক সংসদ সদস্য সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান আইওএফ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন।
আইওএফ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এমডিএসের নামে যে টাকা দিতে হতো, সেটি তাঁরা আইওএফের নামের অ্যাকাউন্টেই দিতেন। তবে সেখান থেকে কোন অ্যাকাউন্টে অর্থ যেত, সেটার খোঁজ রাখতেন না। তবে তাঁরা জানান, এমডিএসের টাকা শুরুতে অবৈধ ভিওআইপি বন্ধে কিছুটা ব্যবহার হয়েছিল।
যেভাবে গড়ে ওঠে বিতর্কিত আইওএফ সিন্ডিকেট
আন্তর্জাতিক কল ব্যবসা একচেটিয়া করার উদ্যোগ আইওএফ সম্পর্কে ২০১৫ সালের ২৭ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিস্তারিত জানা যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাইসেন্সের নীতিমালা অনুযায়ী আইজিডব্লিউগুলো একই লাইসেন্সের আওতায় থাকার কথা থাকলেও আইওএফের পরিকল্পনায় টিয়ার-১ ও টিয়ার-২ নামে দুটি অসম স্তরে ভাগ করা হয়। টিয়ার-১–এ ১৬টি ও টিয়ার-২-এ ৭টি অপারেটর রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়। আইজিডব্লিউ ২৯টি অপারেটরের মধ্যে ২৩টি অপারেটরকে এ প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
প্রস্তাব অনুসারে এ খাতের সব লেনদেন টিয়ার-২ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হবে। টিয়ার-১-এর অপারেটরগুলো বিদেশ থেকে কল আনবে, কিন্তু গ্রাহক পর্যন্ত কল নিয়ে যেতে পারবে না। টিয়ার-২-এর মাধ্যমেই কল নিয়ে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদানের সব অর্থ হস্তান্তর করতে হবে সাতটি অপারেটরের মাধ্যমেই। পরে তারাই বিটিআরসি, আইসিএক্স, এএনএসের মতো সংস্থাগুলোর কাছে রাজস্বের অংশ হস্তান্তর করবে।
এই সাত অপারেটর হচ্ছে ইউনিক ইনফোওয়ে, ডিজিকন টেলিকমিউনিকেশনস, রুটস কমিউনিকেশনস, গ্লোবাল ভয়েস, মীর টেলিকম, বাংলা ট্র্যাক ও নভো টেলিকম। এর মধ্যে গ্লোবাল ভয়েসের মালিকানায় এ কে এম শামসুদ্দোহা থাকলেও এর সঙ্গে সালমান এফ রহমানের ছেলে শায়ান এফ রহমানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। এ ছাড়া বলা হয়, এ সাত প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব গুরুত্ব পেয়েছে।
সে সময়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিটিআরসির লাইসেন্সিং নীতিমালা অনুসারে প্রতিটি আইজিডব্লিউ তাদের রাজস্বের ৪০ শতাংশ বিটিআরসি, ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ আইসিএক্স ও ২২ দশমিক ৫ শতাংশ এএনএসের কাছে পরিশোধে দায়বদ্ধ। কিন্তু আইওএফ–ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট আইজিডব্লিউর কাছে রাজস্ব সরাসরি না নিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিতে সম্মতি দেওয়া হয়। এর ফলে প্রতি মাসে বৈদেশিক কল আদান-প্রদানের মাধ্যমে আয় করা ৩০০ কোটি টাকারও বেশি ওই বিতর্কিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নেওয়ায় সম্মতি দেওয়া হয়।
আইওএফ উদ্যোগটি বাজারের জন্য ক্ষতিকর হবে উল্লেখ করে টেলিযোগাযোগ খাতের অনেকেই আপত্তি জানিয়েছিল। সে সময়ে আইজিডব্লিউ খাতের উদ্যোক্তাদের নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো এক আবেদনে বলা হয়, উদ্যোগটি বাস্তবায়িত হলে ‘বিতর্কিত’ একটি গোষ্ঠী লাভবান হবে। এর মাধ্যমে সরকারি কর পরিশোধ না করে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার আশঙ্কার কথাও তুলে ধরা হয়। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় টেলিযোগাযোগসচিবের কাছে ব্যাখ্যা চায়। পরে ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর আবারও প্রস্তাবটি উপস্থাপন করা হলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২৬ ডিসেম্বর তা অনুমোদন করা হয়।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দলটির নেতারা লাভজনক খাত হিসেবে আইজিডব্লিউ লাইসেন্স নিতে শুরু করেন। লাইসেন্স নেওয়ার পরপর অনেকেই রাজস্ব ফাঁকি দিতে শুরু করেন। এমন ছয়টি আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠান থেকে বিটিআরসির অন্তত হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।