আড়িপাতাপদ্ধতি বহাল রেখেই দেশে স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট–সেবা চালু করতে চাইছে সরকার। এতে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারকে (এনটিএমসি) তথ্য দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হবে। এ ছাড়া যখন–তখন সরকারের জারি করা আদেশও মেনে চলতে হবে স্যাটেলাইট কোম্পানিকে। বিটিআরসির এক খসড়া গাইডলাইনে এসব কথা বলা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত সরকারের সেই একচেটিয়া প্রভাব খাটানো এবং বিচার বিভাগীয় তদারকি এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা এই গাইডলাইনে দেখা যাচ্ছে। গণ–অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা বিবেচনা করলে খসড়াটি প্রশ্নবিদ্ধ।
সম্প্রতি স্টারলিংকের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেছে।
তিন বছর ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করার আগ্রহ দেখাচ্ছে বৈশ্বিক ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক। বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা স্পেসএক্সের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান স্টারলিংক। প্রচলিত ইন্টারনেট–সেবা মুঠোফোন টাওয়ার ও সাবমেরিন কেব্লনির্ভর হলেও স্টারলিংক কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে ইন্টারনেট–সেবা দেয়। এ কারণে পৃথিবীর দুর্গম অঞ্চলেও দ্রুতগতির ইন্টারনেট–সেবা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। বিশ্বের প্রায় ৫০টির বেশি দেশে স্টারলিংকের কার্যক্রম রয়েছে।
গত বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশে স্টারলিংকের প্রযুক্তি এনে পরীক্ষা করা হয়। সে সময় তৎকালীন মন্ত্রীদের সঙ্গে স্টারলিংকের বৈঠকও হয়েছিল।
সম্প্রতি স্টারলিংকের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেছে। স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানটিকে লাইসেন্স দিতে আগ্রহী সরকার। তাই বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) তাদের ওয়েবসাইটে মঙ্গলবার একটি খসড়া গাইডলাইন প্রকাশ করেছে।
বিটিআরসি প্রকাশিত প্রস্তাবিত গাইডলাইনটির নাম হচ্ছে, ‘নন–জিওস্টেশনারি অরবিট (এনজিএসও) স্যাটেলাইট সার্ভিসেস অপারেটর’। আগামী ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত এই গাইডলাইনের ওপর মতামত দেওয়া যাবে।
জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে যেভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল, তখন অনেকেই স্টারলিংকের পক্ষে ‘হ্যাশট্যাগ’ দিয়েছিলেন। কিন্তু বিটিআরসির খসড়ায় অভ্যুত্থান বিবেচনায় নতুন কোনো বিষয় নেই।
মুহাম্মদ এরশাদুল করিম, ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার আইন ও উদীয়মান প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ করতে এনটিএমসি বা বিটিআরসিকে তথ্য প্রদানের উদ্দেশ্যে লাইসেন্সধারীর সিস্টেমে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি থাকতে হবে।
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এনটিএমসিকে প্রয়োজন অনুসারে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত গেটওয়েতে প্রবেশাধিকার দিতে হবে। লাইসেন্সধারী এনটিএমসিকে আড়িপাতার সিস্টেমে যেকোনো প্রয়োজনীয় ডেটা প্রদানের ব্যবস্থা রাখবে।
নাশকতামূলক বা বেআইনি কার্যকলাপ শনাক্ত ও পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারবে কমিশন। সময়ে সময়ে কমিশনের কাছে প্রাসঙ্গিক তথ্য জমা দেওয়ারও নির্দেশ দেবে। ধ্বংসাত্মক বা বেআইনি কার্যকলাপে জড়িত এমন সাবস্ক্রিপশন থাকলে তা শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয় করার ব্যবস্থা থাকতে হবে লাইসেন্সধারীর।
লাইসেন্সধারী বিটিআরসি ও এনটিএমসির নির্দেশনা অনুযায়ী ইন্টারনেট প্রোটোকল ডিটেইল রেকর্ড (আইপিডিআর), লেনদেনের বিস্তারিত রেকর্ড (টিডিআর), কল ডিটেইলড রেকর্ড (সিডিআর) এক বছরের জন্য সংরক্ষণ করবে।
আইনানুগ আড়িপাতার পদ্ধতি থাকতে হবে এবং সরকারের এ–সংক্রান্ত নীতি মেনে চলতে হবে। এ ছাড়া কমিশন জাতীয় নিরাপত্তা বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সহ বেশ কিছু কারণে লাইসেন্সধারীকে পূর্ব নোটিশ ফ্রিকোয়েন্সির নিয়োগ বাতিল করতে পারবে।
লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানকে টেলিকম আইন ২০০১, ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি আইন ১৯৩৩, টেলিগ্রাফ আইন ১৮৮৫, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ (পরিবর্তিত সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩) মেনে চলতে হবে। এ ছাড়া কমিশন দ্বারা সময়ে সময়ে আদেশ, নীতি, সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে। এ ছাড়া সরকারের সংসদ দ্বারা যে কোনো অধ্যাদেশ, রুলস ও নীতি মেনে চলতে হবে।
নাশকতামূলক বা বেআইনি কার্যকলাপ শনাক্ত ও পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারবে কমিশন।
উল্লেখ্য, ব্যাপক সমালোচনার মুখে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সাইবার নিরাপত্তা আইন পাস করে। সে আইন নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়েছে, সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হবে।
স্যাটেলাইট ইন্টারনেট–সেবা হলেও দেশের ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) থেকে ব্যান্ডউইডথ নিতে হবে। খসড়ায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ডেটা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য লাইসেন্সধারীর গেটওয়ে আইআইজির সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, লাইসেন্সধারী সেবা দেওয়ার আগে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্যে অন্তত একটি গেটওয়ে সিস্টেম স্থাপন করবেন। তবে কমিশন লাইসেন্সধারীকে বাড়তি গেটওয়ে স্থাপন করতে উৎসাহিত করে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারী ব্যবহারকারীর কার্যক্রম ও পরিবেশন এই দেশের স্থানীয় গেটওয়ের মাধ্যমে হতে হবে।
এ বিষয়ে নেটওয়ার্ক ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ বলেন, দেশের ভেতরে এই স্যাটেলাইট ইন্টারনেট–সেবা মূলত ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের (আইএসপি) মতোই হবে। দেশে তাকে আইআইজি থেকেই ব্যান্ডউইডথ নিতে হবে। সরকারের এই নীতি অনুসরণ করলে পুরো দেশে যদি ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়, তবে স্যাটেলাইটে ইন্টারনেট দিয়েও কাজ হবে না।
বিটিআরসির গাইডলাইনে আরও বলা আছে, বাংলাদেশে ব্যবসা করতে হলে স্যাটেলাইট কোম্পানিকে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) নিবন্ধিত হতে হবে। বিদেশি প্রতিষ্ঠান হলে সরকারের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) নীতি মানতে হবে।
এই অপারেটরকে পাঁচ বছরের জন্য লাইসেন্স দেওয়া হবে। শর্ত ও নীতি মেনে পুনরায় নিবন্ধন নেওয়া যাবে। তারা ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম) সেবা, ব্রডকাস্টিং সেবা এবং স্যাটেলাইট আইএমটি বেজড সেবা দিতে পারবে না। সেবা বন্ধ করার বিষয়ে গ্রাহক ও কমিশনকে অন্তত ৩০ দিন আগে জানাতে হবে।
লাইসেন্স নেওয়ার আবেদন ফি ৫ লাখ টাকা, লাইসেন্স অধিগ্রহণ ফি ১০ হাজার ডলার, বার্ষিক নিবন্ধন ফি ৫০ হাজার ডলার, বছরে রাজস্ব ভাগাভাগি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হারে হবে। এ ছাড়া সেবা প্রদানের আগে ট্যারিফ প্ল্যান বিটিআরসি অনুমোদিত হতে হবে।
জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে টানা পাঁচ দিন সারা দেশ ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এ ছাড়া সরকার পতনের দিন ৫ আগস্টও আড়াই ঘণ্টার মতো ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়।
এই ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশতাদাতা ছিল এনটিএমসি, বিটিআরসি এবং সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক, যা সরকারি প্রতিবেদনেও উল্লেখ আছে।
বিটিআরসি প্রণীত প্রস্তাবিত গাইডলাইনেও উল্লিখিত পদধারী ব্যক্তিদের একচেটিয়া ক্ষমতা ও সরকারের মর্জির ওপর সেবা কার্যক্রমের শর্ত রয়েছে।
এ বিষয়ে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার আইন ও উদীয়মান প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ এরশাদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান যেসব সেবা রয়েছে সেখানে কী সুবিধা নেই যে নতুন সেবা আনতে হবে। জুলাই–আগস্টের অভ্যুত্থানে যেভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল, তখন অনেকেই স্টারলিংকের পক্ষে ‘হ্যাশট্যাগ’ দিয়েছিলেন। কিন্তু বিটিআরসির খসড়ায় অভ্যুত্থান বিবেচনায় নতুন কোনো বিষয় নেই।
প্রযুক্তির এই শিক্ষক বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতায় এখানে একচেটিয়া ক্ষমতা বিটিআরসি বা সরকারি কর্তাদের হাতে দিলে গ্রাহক কোনো সুফল পাবে না। এ ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন কমিটি জাতীয় কিছু থাকা উচিত, যেখানে খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও থাকবেন। পাশাপাশি বিচার বিভাগীয় তদারকিও থাকা প্রয়োজন।
মুহাম্মদ এরশাদুল করিম আরও বলেন, এখন যাঁরা ইন্টারনেট–সেবা দিচ্ছেন, তাঁরা স্টারলিংককে কীভাবে বরণ করবেন, তা নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকবে। আবার স্টারলিংকও সরকারের এত শর্ত মেনে লাইসেন্স নেবে কি না, সেটাও একটা দেখার বিষয়।