আবদুল মালেকের (৩৭) সঙ্গে দেখা হয়েছিল রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। ১ মের তপ্ত রোদেলা দুপুরে।
মহান শ্রমিক দিবসের সকাল থেকে একের পর এক লাল পতাকা মিছিল আসছিল তোপখানা রোড ধরে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে মিছিলগুলো আবার কদম ফোয়ারা সামনে দিয়ে ঘুরে চলে যাচ্ছিল।
পোশাকশ্রমিকদের এমনই এক মিছিলে ছিলেন মালেক।
সবার মধ্য থেকে মালেক আলাদাভাবে দৃষ্টি কেড়ে ছিলেন তাঁর পোশাক পরিচ্ছদের জন্য। আপাদমস্তক চটের তৈরি পোশাক তাঁর পরনে। পায়ে সুতলি ও চটের তৈরি চপ্পল। পাটের সুতোয় মিহি করে বুননের চট দিয়ে তৈরি পায়জামা-পাঞ্জাবি। এর ওপর কোটি। সেটিও চটের তৈরি। মাথায় জাতীয় পতাকার রঙের ফিতা বাঁধা। ফিতার ওপরে শোভা পাচ্ছে চটের কিস্তি টুপি। হাতে একটি ব্যাগ। সেটিও যে চটেরই হবে, তা অনুমেয়।
তপ্ত দুপুরে এমন পোশাকের কারণে অনেকের কৌতূহলী দৃষ্টি ছিল মালেকের দিকে। তবে সবার কৌতূহল মেটানোর মতো পর্যাপ্ত সময় ছিল না তাঁর হাতে। নাম-পরিচয় জানা, মোবাইল নম্বর বিনিময়, মোবাইলের ক্যামেরায় দ্রুত কয়েকটি ছবি তোলা—এ পর্যন্তই হলো। মিছিলের স্লোগানে গলা মিলিয়ে এগিয়ে গেলেন তিনি।
পরে মোবাইলেই কথা হয় মালেকের সঙ্গে। কথা বলে জানা গেল, সংগ্রামী তাঁর জীবন। টিকে থাকার জন্য শিশুকাল থেকেই তাঁর লড়াই-সংগ্রাম শুরু হয়। এই ‘জীবনযুদ্ধের’ সঙ্গে অধুনা যোগ করে নিয়েছেন পরিবেশ-প্রকৃতিকে দূষণ থেকে রক্ষা, পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার মতো সংগ্রাম। এ বিষয়ে নিজ উদ্যোগে, নিজের মতো করেই জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছেন তিনি। তাই এই সংগ্রাম তাঁর একান্ত নিজের।
গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন মালেক। কারখানার নাম বলতে চান না। অসুবিধা আছে। বেতন পান সাড়ে আট হাজার টাকা। অথচ ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজর টাকা।
মালেক জানালেন, তিনি চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক। অনেক কারখানায় তাঁর মতো চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক আছে। কিন্তু কেউ তা স্বীকার করবে না।
মালেক অবশ্য আগে একটি কারখানায় নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরিতেই কাজ করতেন। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন—এসবে যুক্ত থাকায় সেখান থেকে তাঁর চাকরি চলে যায়।
বেশ কিছু দিন বেকার ছিলেন। পরে এখনকার কারখানায় চুক্তিতে যোগ দেন। তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসীও পোশাকশ্রমিক। তিনি অন্য একটি কারখানার জ্যেষ্ঠ মেশিনচালক। বেতন সাড়ে ১৪ হাজার টাকা। দুজনে মিলে প্রায় ২৩-২৪ হাজার টাকা বেতন পান।
মালেক-জান্নাতুল দম্পতির দুটি সন্তান। বড় ছেলে আবদুল্লাহ আল মাহী গাজীপুরের শিরিচালা জামিয়া ইসলামিয়া মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসায় পড়ে। মেয়ে নাজমুন নাহারও একই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী।
মালেকের সঙ্গে তাঁর বৃদ্ধা মাও থাকেন। মোট পাঁচজনের সংসার। বাড়িভাড়াতেই চলে যায় ছয় হাজার টাকা। দুই সন্তানের পড়ার খরচ প্রায় ছয় হাজার টাকা। এই দুই খাতে ১২-১৩ হাজার টাকা চলে যায়। বাদবাকি টাকায় সংসার চলে না। এখন জিনিসপত্রের যে দাম। ফলে বাড়তি আয়ের জন্য কারখানার কাজ শেষে সন্ধ্যার পর রিকশা চালান মালেক।
১৯৮৭ সালে ফেনী সদর থানার পাপতা গ্রামে মালেকের জন্ম। বয়স যখন চার বছর, তখন তাঁর বাবা মারা যান। পাঁচ বছর বয়সে তাঁকে ভোলা সরকারি শিশুসদনে রেখে আসা হয়েছিল। সেখান থেকে তিনি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। তারপর পা বাড়ান পৃথিবীর পথে।
এতিমখানার পরিবেশটা মালেকের ভালো লাগছি না। তাই সেখান থেকে চলে আসেন। ভোলা শহরে এক চায়ের দোকানে পেটে-ভাতের চুক্তিতে চা তৈরির কাজ দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করেন তিনি। তারপর অনেক রকমের কাজকর্ম করে অবশেষে ঢাকায় চলে আসেন। কাজ শুরু করেন পোশাক কারখানায়।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করার বিষয়টি ২০২০ সালে মালেকের ভাবনায় আসে। গাজীপুরের পোশাকশ্রমিকেদের আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি প্রথম থেকেই যুক্ত ছিলেন। সে সময় পরিবেশ রক্ষা, পলিথিনের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব, পরিবেশবান্ধব পণ্যের ব্যবহার, বিশেষ করে সোনালি আঁশ হিসেবে খ্যাত পাটের পণ্যের ব্যবহার উৎসাহিত করা—এমন সব বিষয় নিয়ে গাজীপুরে কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠন বেশ কিছু কাজ করছিল। সেখান থেকেই মালেক প্রেরণা পান।
মালেক সিদ্ধান্ত নেন, পাটের পণ্যের প্রতি মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে কাজ করবেন। চট দিয়ে পোশাক তৈরির বিষয়টি তাঁর মাথায় আসে। যেই ভাবা, সেই কাজ। ২০২০ সালে স্থানীয় একটি দোকান থেকে তিন গজ চট কিনে একটি পাঞ্জাবি তৈরি করেন তিনি।
মালেক জানালেন, প্রথম দিকে দরজিরা কেউ এই পাঞ্জাবি বানাতে রাজি হচ্ছিলেন না। অনেক বলেকয়ে একজনকে রাজি করিয়ে পাঞ্জাবি তৈরি করেন। পরে পায়জামা, কোটি ও টুপি তৈরি করিয়ে নেন। প্রথম সেট তৈরি করতে তাঁর প্রায় ৪ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছিল। এখন তাঁর এমন আরেকটি সেট আছে। পায়ের চপ্পলটি নিজেই তৈরি করেছেন মালেক।
পোশাক তো তৈরি হলো, কিন্তু তা গায়ে দিয়ে পথে নামার ক্ষেত্রে প্রথম দিকে খানিকটা অস্বস্তিকর হয়েছিল মালেকের জন্য। বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানের ওজর-আপত্তি ছিল। ‘লোকে পাগল বলবে’—এমন সাবধানী বাণী দিয়েও তাঁরা মালেককে এই পোশাক পরে বাইরে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেননি। অগত্যায় তাঁরা মেনে নেন।
কর্মস্থলে তো এই পোশাকে যাওয়া যায় না। আবার বাড়তি আয়ের জন্য অফিস শেষে প্রায়ই রিকাশা নিয়ে বের হতে হয় তাঁকে। তখনও এই পোশাক পরার উপায় নেই। তাই এসবের ফাঁকে সপ্তাহে দুই-তিন দিন মালেক বিকেলে, সন্ধ্যায় বা ছুটির দিনগুলোয় চটের পোশাক গায়ে দিয়ে বের হন। তিনি গাজীপুরের বিভিন্ন সড়কের মোড়ে, বাজারে, বিপণিবিতানের সামনে ঘুরে ঘুরে মানুষকে পাটজাত পণ্যের ব্যবহারে উৎসাহিত করেন। পলিথিনের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরেন।
মালেক বললেন, সচেতনতা সৃষ্টিতে লিফলেট বিতরণ করতে পারলে ভালো হতো। তবে লিফলেট বানানোর মতো অর্থ তাঁর নেই।
সচেতনতা সৃষ্টির কাজে মালেক যখন বাইরে বের হন, তখন তাঁর হাতে একটা প্ল্যাকার্ড থাকে। এতে লেখা থাকে, পলিথিন বর্জন করুণ। পরিবেশ রক্ষা করুন। পাটজাত পণ্য ব্যব্যহার করুন।
মালেক বলেন, তাঁর কাজ লোকজনকে আহ্বান জানানো। এর চেয়ে বেশি কিছু করার সাধ্য তাঁর নেই। সবাই হয়তো তাঁর কথা শুনবে না। কিন্তু কেউ না কেউ তো শুনবে, গুরুত্ব দেবে। তাতেই তাঁর চলবে। তাঁর কাজ তিনি করে যাবেন।
এই কথা শুনে মনে হলো, সমাজে এমন কিছু দৃঢ় প্রতিজ্ঞার লোক থাকেন, যাঁদের অনেকে ‘একগুঁয়ে’ বলেন, মালেক তাঁদেরই একজন।