বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা-ডলারের যে বিনিময় হার পদ্ধতি ঠিক করেছে, তার নাম ‘ক্রলিং পেগ’। আক্ষরিক বাংলা করলে হয়, এখন থেকে দেশের মধ্যে ডলারের দর লাফ দিতে পারবে না, কেবল হামাগুড়ি দিতে পারবে। আর সেই হামাগুড়ি দিতে হবে নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে। সীমার বাইরে যাওয়া যাবে না।
সীমাটা কী? আপাতত সেই সীমা হচ্ছে ১১৭ টাকা। এর নাম হচ্ছে ক্রলিং পেগ মিড-রেট বা মধ্যদর। ডলারের বিনিময়মূল্য এর আশপাশেই থাকতে হবে। অর্থাৎ বিনিময় হারের আর কোনো উচ্চসীমা বা নিম্নসীমা নেই, কিন্তু মধ্যসীমা আছে। এটাই মেনে চলতে হবে। বলা যায়, স্বাধীনতা আছে, তবে অবশ্যই তা নিয়ন্ত্রিত।
এতে অবশ্য ডলারের দর একবারেই লাফ দিয়েছে ৭ টাকা। গত মঙ্গলবার এই ডলারের দর ছিল ১১০ টাকা। বলে রাখা ভালো ২০২২ সালে ডলারের দর ছিল ৮৬ টাকা। সুতরাং প্রায় আড়াই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন বা লাফ দেওয়ার হার ৩৬ শতাংশ। আরও বেশি লাফ দেওয়া ঠেকাতেই নতুন এই ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি।
এর মধ্য দিয়ে দেশ একটি রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচার থেকেও রেহাই পেল। কারণ ডলার বিক্রি হচ্ছিল ১১৮-১১৯ টাকায়, আমদানিও এই দরে, ব্যাংক লেনদেন করছে একই দরে, অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক বলতে বলছে ১১০ টাকা। এখন সত্যটাই বলতে পারবে সবাই।
বিদেশি মুদ্রার বিনিময়ের বাজারে কোনো সরকারি হস্তক্ষেপ থাকবে না, এমনটাই আদর্শ মনে করা হয়। উন্নত দেশগুলো এই আদর্শ মেনে চললেও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে তা মানা সম্ভব হয় না। বিনিময় হারে কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না, এটাকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় ভাসমান বিনিময় হার বা ফ্রি ফ্লোটিং। অর্থাৎ বিনিময় হার সম্পূর্ণ বাজারভিত্তিক। বাজার ঠিক করে দেবে, বিনিময় হার কত হবে। চাহিদা আর জোগানই এখানে আসল নির্ধারক।
এখন সরকার যদি হস্তক্ষেপ করে, তাহলে কী হবে? তখন চিত্রটি হবে অন্য রকম। তখন বিনিময় হারের পদ্ধতিকে কয়েকটি ভাগ করা যায়। যেমন, বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট মানে আটকে রাখলে তাকে বলা হয় স্থির বিনিময় হার। একে পেগড বিনিময় হারও বলা যায়। প্রয়োজন অনুসারে এই হারকে পুনর্বিন্যস্ত বা সমন্বয় করে নতুন একটি হার ঠিক করা হয়। যাকে বলা হয় অ্যাডজাস্টেবল বিনিময় হার। আরেকটি হচ্ছে পরিচালিত বা ম্যানেজড বিনিময় হার। অর্থাৎ প্রয়োজন অনুসারে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিনিময় হার ঠিক করে দেয়। এই পদ্ধতিকে অনেকে নোংরা বা ডার্টি ফ্লোটিং রেটও বলে। কারণ, এর মাধ্যমে দেশগুলো নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে বিনিময় হারকে অপব্যবহার করে।
ক্রলিং পেগ আসলে স্থির বিনিময় হারেরই আরেকটি রূপ। অর্থাৎ বিনিময় হার স্থির করা আছে, সেই স্থির করা হারের আশপাশে ডলার বিনিময় করতে হবে সব পক্ষকে। এই যে মধ্যদর ১১৭ টাকা, এটি বাংলাদেশ ব্যাংক যেকোনো সময় বদল করতে পারবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর তা নির্ভর করবে। সাধারণত, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে, বিনিময় হার অস্থিতিশীল হওয়ার প্রবণতা থাকলে এবং মূল্যস্ফীতি উচ্চ হারে থাকলে কোনো দেশ ক্রলিং পেগ পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশ এই পরিস্থিতির মধ্যেই আছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই এই পদ্ধতি বেশি দেখা যায়।
বাংলাদেশ গত দুই বছরে বিনিময় হার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম করেনি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হলে ডলারের সরবরাহ কমে যায়। ফলে বাড়তে থাকে এর দর। দরের লাফ দেওয়া ঠেকাতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েও লাভ হয়নি। এমনকি চারটি দরও ঠিক করা হয়েছিল। এতে সংকট আরও বেড়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত আইএমএফের শর্ত মেনেই বিনিময় হারের নতুন পদ্ধতি ঠিক করতে হলো।
আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
নির্বাচনের আগে গত ১৬ অক্টোবর ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর একটি বৈঠক করেছিলেন। সেই বৈঠকে নির্বাচনের পর বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়েছিল। সেই বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গভর্নর বলেছিলেন, ‘বাজারভিত্তিক বিনিময় হারে যাওয়ার জন্য ভালো সময় দরকার। সেই ভালো সময় আসলে তিন বছর আগে ছিল। তখন না যাওয়া ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। এখন চলতি হিসাবে ঘাটতি, এখন আর্থিক হিসাবে ঘাটতি, এখন মোট যত ডলার আসছে, তার চেয়ে চলে যাচ্ছে বেশি। সুতরাং এ মুহূর্তে বাজারভিত্তিক বিনিময় হারে গেলে প্রতিদিনই ডলারের দর বাড়তেই থাকবে। তাই চলতি ও আর্থিক হিসাব ঋণাত্মক পরিস্থিতি নিয়ে বাজারভিত্তিক বিনিময় হারে যাওয়া মানে আত্মহত্যা করা। এখন আর্থিক হিসাব ইতিবাচক করার কাজ চলছে। এটা করতে পারলেই আমরা বাজারভিত্তিক হারে চলে যাব। এখন এটা নিয়ে কাজ চলছে আইএমএফের সঙ্গে। ক্রলিং পেগে যাওয়ার কাজ চলছে। একটা সীমার মধ্যে থাকতে হবে।’
সেই ক্রলিং পেগ অবশেষে হলো। তবে বলা রাখা ভালো অতীতের ভুলের মাশুল হচ্ছে এই ক্রলিং পেগ ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি। যেমন ২০১২ সালের জুন শেষে দেশে ১ ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮১ দশমিক ৮৭ টাকা। ২০২১ সালের জুন শেষে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৮৪ দশমিক ৮০ টাকা। এই ৯ বছরে টাকার অবমূল্যায়ন হয় মাত্র ৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। তারপরের তিন বছরে অবমূল্যায়ন করা হয় প্রায় ৪০ শতাংশ।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করলে রপ্তানির বাজার ধরে রাখতে চীন ইউয়ানের বড় অবমূল্যায়ন করে। বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা এই নীতি অনুসরণ করলেও বাংলাদেশ তখনো টাকার মান কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অর্থনীতির কঠিন এক সময়ে বড় হারে ঠিকই অবমূল্যায়ন করতে হলো। এর দায় আগের নীতিনির্ধারকদের। টাকার দর কৃত্রিমভাবে ধরে রেখে শক্তিশালী দেখানোর পেছনে অর্থনৈতিক চিন্তা কাজ করে কম। বরং সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই তা করা হয়। বাংলাদেশও তা-ই করেছে। আর এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে এখন।
দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি। সদ্য গঠিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এ এন হামিদুল্লাহ একটি বার্তা সংস্থাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। জাতীয় দৈনিকগুলোয় সেই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। তিনি সেখানে বললেন, ‘বাংলাদেশ স্টার্লিং এলাকায় যোগ দেবে। ১ পাউন্ডের সঙ্গে বিনিময়ের মাত্রা হবে ১৮ দশমিক ৯৬৭৭ টাকা। ভারত ও বাংলাদেশের মুদ্রার মান সমান হবে।’
পাকিস্তান সময়েও মধ্যবর্তী মুদ্রা ছিল ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং। এটা আর পরিবর্তন করা হয়নি। তবে বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রতিবেশী ভারতের মুদ্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। যদিও পাউন্ডের দর ছিল পাকিস্তান আমলের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশ শুরুতেই একলাফে টাকার অবমূল্যায়ন করেছিল ৩৩ শতাংশ।
যদিও তখন আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রা ছিল ডলার। ১৯৭২ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে পাউন্ডের বিনিময় হার ডলারের সঙ্গে ভাসমান বা ফ্লোটিং করা হয়। তখন দেশে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৭ দশমিক ২৭০২৭ টাকা। ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ড স্টার্লিংয়ের সঙ্গে বিনিময় হারকে সম্পর্কিত করাকেই বলা হয় পেগ।
স্বাধীনতার পর বিনিময়ে হারে বড় পরিবর্তন আসে ১৯৭৫ সালের ১৭ মে। ওই দিন টাকার বিপরীতে পাউন্ডের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয় ৩০ টাকা, যা আগে ছিল ১৮ দশমিক ৯৬৭৭ টাকা। অর্থাৎ একবারেই অবমূল্যায়ন ঘটে ৩৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এটাই সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনছবি : হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইট থেকে
সে সময়েই আনুষ্ঠানিক বিনিময় মুদ্রা হারের পাশাপাশি বাজারভিত্তিক সেকেন্ডারি বিনিময় মুদ্রাবাজার চালুর অনুমতি দেওয়া হয়। এতে কার্ব মার্কেটের উদ্ভব ঘটেছিল। সেই কার্ব মার্কেটে পাউন্ডের দাম ছিল আনুষ্ঠানিক দরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
বিনিময় হার ব্যবস্থায় প্রথম বড় পরিবর্তন আসে ১৯৮৩ সালের ১১ জানুয়ারি। সেই দিন পাউন্ডের পরিবর্তে মার্কিন ডলারকে মধ্যবর্তী মুদ্রা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। এর পরের পরিবর্তনটি ঘটেছিল ১৯৯৪ সালের ২৪ মার্চ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে চলতি হিসাবের লেনদেনে বাংলাদেশি টাকাকে রূপান্তরযোগ্য করা হয়। তবে মূলধন হিসাবে টাকাকে রূপান্তরযোগ্য করা হয়নি। অর্থাৎ মূলধন হিসাবে কোনো অর্থ বিদেশে নিয়ে যাওয়া যাবে না। কেবল চলতি লেনদেনে তা করা যাবে। এই পদ্ধতি এখনো চালু আছে।
২০০৩ সালের ২৯ মে বাংলাদেশ ব্যাংক স্থিরীকৃত মুদ্রা বিনিময় হারের পরিবর্তে টাকাকে ভাসমান মুদ্রা হিসেবে ঘোষণা দেয়। এর অর্থ হচ্ছে চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে ঠিক হবে মুদ্রার বিনিময় হার। অর্থাৎ তাত্ত্বিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপমুক্ত। যদিও তখনো মুদ্রা বিনিময় হার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতেই থাকে। আগের মতো তারা সরাসরি হস্তক্ষেপ না করে নিজেই মুদ্রাবাজারে কেনাবেচার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করা শুরু করে। অর্থাৎ কার্যত নিজের হাতেই রেখে দিয়েছে মুদ্রা বিনিময় হার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব। আর এ কাজটি করেছে আন্তরিক বাজারের রেট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন থেকেই বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। অর্থাৎ ভাসমান আসলে কখনোই হয়নি।
আর পরের পদক্ষেপ হচ্ছে ক্রলিং পেগ, যা করা হলো ২০২৪ সালের ৮ মে। এ নিয়ে গতকালই বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) বলা হয়েছে, ডলারের মধ্যবর্তী দাম ১১৭ টাকার আশপাশে থাকবে, আর তা যেন সর্বোচ্চ ১১৮ টাকার মধ্যে লেনদেন হয়।
খুব সহজ করে বললে বিনিময় হার দুই ধরনের। স্থির অথবা ভাসমান। আর এই ব্যবস্থা চালু হয় ১৯৭৩ সাল থেকে। তার আগে শুরুর ইতিহাসটা জানা যাক।
মূলত, যখন থেকে মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছে, তখন থেকেই বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ব্যবস্থার চালু। তবে সত্যিকার অর্থে বিশ্বের প্রথম বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় বাজার চালু হয়েছিল আমস্টারডামে, ৫০০ বছর আগে। বিনিময় হার নির্ধারণে স্বর্ণ মান ব্যবস্থা চালু হয় ১৮৭৫ সালে। অর্থাৎ একটি দেশের মজুতে যত সোনা আছে, ঠিক তত মুদ্রাই তারা ছাপতে পারবে। সোনাকে মান হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। কারণ, এটি দুষ্প্রাপ্য এবং নষ্ট হয় না। এই ব্যবস্থা ভেঙে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। কারণ, তখন দেশগুলোর প্রচুর অর্থের প্রয়োজন দেখা দেয়, ফলে মুদ্রা ছাপানো ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর ছিল না। স্বর্ণ মাননিয়ন্ত্রিত এই বিনিময় হার চালু ছিল ১৯১০-এর দশক পর্যন্ত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মুদ্রার চাহিদা বাড়লেও সোনার মজুত সে হারে বাড়েনি। ফলে সোনা মজুত অনুযায়ী নোট ছাপানোর জায়গা থেকে অনেক দেশই সরে আসে। অনেক ইউরোপীয় দেশ আইন করে যে তারা সোনার পাশাপাশি সোনা রূপান্তরযোগ্য অন্যান্য দেশের মুদ্রাও রিজার্ভ আকারে রাখা শুরু করে, বিশেষ করে ডলার ও পাউন্ড। তাতেও সমস্যার সমাধান হয় না। বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাড়াতে অনেক দেশই পর্যাপ্ত সোনা জমা না রেখেই নোট ছাপাতে শুরু করে। এসব জটিলতায় ১৯৩১ সালে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড প্রথম পরিত্যাগ করে গ্রেট ব্রিটেন। পরের পাঁচ বছরের মধ্যে বাকি দেশগুলোও এই পথ থেকে সরে আসে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে আর্থিক ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন ঘটে। ১৯৪৪ সালের ১ জুলাই যুক্তরাজ্যের নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উডস শহরের অর্থনৈতিক সম্মেলন থেকে উদ্ভব হয় ব্রেটন উডস ব্যবস্থার। এর লক্ষ্য ছিল স্থিতিশীল বিনিময় হার ব্যবস্থার প্রবর্তন। এ জন্য মুদ্রা অবমূল্যায়ন থেকে সরে আসার কথাও বলা হয়। তবে কোনো দেশ সমস্যায় ভুগলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। ব্রেটন উডস ব্যবস্থা তদারকির জন্যই আইএমএফ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৯৪৪ সালে ব্রেটনউডস সম্মেলনে বক্তব্য দেন অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস
এই ব্যবস্থারও অবসান ঘটে ১৯৭৩ সালে। এর শুরুটা ছিল ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট। ওই দিন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ব্রেটন উডস ব্যবস্থা বাতিল করে দেন। মার্কিন ডলার সোনায় রূপান্তরের ক্ষমতা বাতিল করার এই পদক্ষেপকে বলা হয় ‘গোল্ডেন উইন্ডো’ বন্ধ করা, যাকে অনেকে ‘নিক্সন শক’ বলে থাকেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বরে শেষ রক্ষা হিসেবে ওয়াশিংটনে বিশেষ এক বৈঠকে অংশ নেন শিল্পোন্নত ১০টি দেশের অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরেরা। এই বৈঠকে নতুন করে সমঝোতা হলেও তা ১৫ মাসের বেশি থাকেনি।
কেননা, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে সব দেশই তখন বিপদে। সংকট নিরসনে ব্রেটন উডস ব্যবস্থাও আর কাজ করছিল না। রপ্তানির প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে মুদ্রার অবমূল্যায়নে আগ্রহী অনেক দেশই। সেই অর্থনৈতিক সংকটে মার্কিন ডলার সোনায় রূপান্তরের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। ফলে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৩ সালের ১ মার্চ থেকে যে যার মতো করে বিনিময় ব্যবস্থা অনুসরণ করা শুরু করে। আর এভাবেই বিশ্বে যাত্রা শুরু হয় ভাসমান বা ফ্লোটিং বিনিময় হারের। আর যারা দুর্বল, তারা বেছে নেয় স্থির বিনিময় হারকে। সেই বিনিময় হারেই আরেক সংস্করণ ক্রলিং পেগ, যা বাংলাদেশ শুরু করল গতকাল। ভাসমান বিনিময় হার ব্যবস্থা চালুর ৫০ বছর পর।
আর এর মধ্য দিয়ে দেশ একটি রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচার থেকেও রেহাই পেল। কারণ ডলার বিক্রি হচ্ছিল ১১৮-১১৯ টাকায়, আমদানিও এই দরে, ব্যাংক লেনদেন করছে একই দরে, অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক বলতে বলছে ১১০ টাকা। এখন সত্যটাই বলতে পারবে সবাই।