বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার দুই দিন আগে ফাঁস করা প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করাতে টাকার বিনিময়ে চাকরিপ্রার্থীদের জন্য কক্ষ ভাড়া নিয়েছিলেন সৈয়দ আবেদ আলী।
ঢাকার সাভারের রেডিও কলোনিতে ওই কক্ষ ভাড়া নেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক এই গাড়িচালক।
শুধু আবেদ আলী নন, নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার ১৭ জনের মধ্যে আরও ৫ জন আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, চাকরিপ্রার্থীদের জন্য ঢাকা ও আশপাশে এমন নিরাপদ কক্ষ (চক্রের সদস্যদের ভাষায় বুথ) ভাড়া নিয়েছিলেন তাঁরা। মঙ্গলবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (সিএমএম) তাঁরা এই জবানবন্দি দেন বলে আদালত ও সিআইডি সূত্রে জানা গেছে।
সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, ২০০৫ সাল থেকে ক্যাডার ও নন–ক্যাডারের অন্তত ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা জড়িত।
সিআইডির গণমাধ্যম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আজাদ রহমান আজ বুধবার প্রথম আলোকে জানান, স্বাস্থ্য ক্যাডার, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইনস্ট্রাক্টর, গণপূর্তের উপসহকারী প্রকৌশলী, উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা, অডিটর, নার্সিংসহ অন্তত ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা জড়িত।
গত রবি ও সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে পিএসসির দুই উপপরিচালক, এক সহকারী পরিচালক ও সাবেক গাড়িচালকসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল মঙ্গলবার তাঁদের বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্টন থানায় সরকারি কর্ম কমিশন আইনে মামলা করেন সিআইডির একজন কর্মকর্তা।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলাম আজ প্রথম আলোকে বলেন, আদালত জবানবন্দি নিয়ে গ্রেপ্তার ছয়জনকে কারাগারে পাঠিয়েছেন। এ ছাড়া গ্রেপ্তার বাকি ১১ জনকে মঙ্গলবার আদালতে তোলা হলে শুনানি শেষে তাঁদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
সিআইডি কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, যাঁরা আদালতে জবানবন্দি দেননি এমন ১১ জনকে রিমান্ডে পাওয়ার জন্য আদালতে আবেদন করবেন তাঁরা।
সিআইডি ও আদালত সূত্র জানায়, আদালতে যাঁরা জবানবন্দি দিয়েছেন, তাঁরা হলেন পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী, পিএসসির ডেসপাস রাইডার মো. খলিলুর রহমান, পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম, পানির ফিল্টার ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন, তাঁর ছোট ভাই সায়েম হোসেন ও রাজধানীর বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লিটন সরকার।
মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আবেদ আলী বলেন, রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার আগে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র ও এর উত্তর অফিস সহকারী সাজেদুলের কাছ থেকে নিয়েছিলেন তিনি। ফাঁস করা প্রশ্নের উত্তর পড়ানোর জন্য নিয়োগ পরীক্ষার দুই দিন আগে দুই দিনের জন্য ৪০ হাজার টাকায় তিনি সাভারের রেডিও কলোনিতে একটি বড় কক্ষ ভাড়া নিয়েছিলেন। এই কক্ষে ৫০-৬০ জন চাকরিপ্রার্থীকে ফাঁস করা প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করিয়েছিলেন আবেদ আলী। এ জন্য একেকজনের কাছ থেকে তিনি সাত-আট লাখ টাকা করে নিয়েছেন।
আবেদ আলী আদালতকে বলেন, ছয়-সাত মাস আগে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর নিয়োগ পরীক্ষার আগে মিরপুরের শেওড়াপাড়া ও কাজীপাড়ার মাঝামাঝি স্থানে দুই দিনের জন্য একটি কক্ষ ভাড়া নেন তিনি। তখন ৪৪ জন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে তিনি চার লাখ টাকা করে নিয়েছিলেন। এ ছাড়া ২০০৫ সালে তিনি গণপূর্তের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষায় চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে ফাঁস করা প্রশ্নপত্র বিক্রি করে তিন লাখ টাকা করে নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১৫-১৬ জনের চাকরি হয়েছে।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে সাজেদুল ইসলাম বলেন, রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন তিনি পিএসসির এক সদস্যের কক্ষে থাকা ট্রাংক থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। এই প্রশ্নপত্র তিনি পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী ও পিএসসির ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমানের কাছে ৭৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেন।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, তিনি পানির ফিল্টার ব্যবসায়ী। পল্টনের কালভার্ট রোডের একটি বাড়ির দ্বিতীয় তলায় পানির ফিল্টারের গুদাম রয়েছে। তাঁর ব্যবসায় সহযোগিতা করেন তাঁরই ছোট ভাই সিদ্ধেশ্বরী কলেজের ছাত্র সায়েম হোসেন। পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম তাঁর (সাখাওয়াত) বন্ধু। সাজেদুল প্রায়ই তাঁর সঙ্গে দেখা করে চাকরিপ্রত্যাশী কেউ থাকলে জানাতে বলতেন তাঁকে। রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার ৪৪ জন প্রার্থীকে বৃহস্পতিবার তাঁর ওই গুদামকক্ষে রাখা হয়। রাতভর ওই চাকরিপ্রার্থীরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র মুখস্থ করে পরের দিন পরীক্ষা দিতে যান।
সায়েম হোসেন আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, পল্টনের কালভার্ট রোডের গুদামটি চাকরিপ্রার্থীদের পড়ানোর ‘বুথ’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তিনি এই বুথে চাকরিপ্রার্থীদের পড়াতে সহায়তা করতেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লিটন সরকার আদালতকে বলেন, তিনি ফাঁস করা প্রশ্নপত্র পাইয়ে দিতে চাকরিপ্রার্থীদের প্রলুব্ধ করতেন। টাকা পাওয়ার আশায় পরে ওই চাকরিপ্রার্থীদের তিনি পিএসসির ডেসপাস রাইডার খলিলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। গ্রেপ্তার জাহিদুল ইসলাম দুজন চাকরিপ্রত্যাশীকে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর শ্যামলী থেকে তাঁকে গ্রহণ করতে বলেন।
সিআইডি সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে পিএসসির ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান বলেন, তিনি রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন। ফাঁস করা প্রশ্নপত্র বিক্রি করে তিনি চাকরিপ্রত্যাশী ৫০-৬০ জনের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের চেক গ্রহণ করেন।
সিআইডির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার ১৭ জনের পরিবার ও নিকটাত্মীয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) আবেদন করবে সিআইডি।