নাম শুনলেই গা শিউরে ওঠার মতো আড়াই ডজনের বেশি শীর্ষ সন্ত্রাসীর নিয়ন্ত্রণে ছিল রাজধানী ঢাকার অপরাধজগৎ। ‘ক্রসফায়ারে’ পিচ্চি হান্নানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া অভিযানের একপর্যায়ে তাঁদের প্রকাশ্য তৎপরতা কমে আসে। অনেকে গ্রেপ্তার হন। বেশির ভাগই বিদেশে পালিয়ে যান। তবে তাঁদের নির্দেশে ঢাকায় মানুষ খুন হয়, চাঁদা ওঠে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বিদেশে বসে ‘বোতাম টেপেন’, আর ঘটনা ঘটে ঢাকায়। অপরাধজগৎ ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কোথাও মিলেমিশে, কোথাও মুখোমুখি অবস্থানে থেকে তৎপরতা চালাচ্ছেন।
ঢাকার ৩০ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অতীত কার্যক্রম ও বর্তমান অবস্থান নিয়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই সন্ত্রাসীদের মধ্যে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। কারাগারে আছেন ৭ জন। ১৭ জন বিদেশে অবস্থান করছেন। ২ জন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়নি।
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের যাঁরা বিদেশে পলাতক, তাঁদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। একই সঙ্গে তাঁদের হয়ে দেশে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
নাইম আহমেদ, সাবেক কমিশনার, ডিএমপি
২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশ করা শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় এই ৩০ সন্ত্রাসীর মধ্যে ২৩ জনের নাম ছিল।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে, বিদেশে থাকা ১৭ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্তত ৯ জন এখনো ঢাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত রয়েছেন। গত দুই বছরে অন্তত ১৯টি বড় অপরাধ সংঘটনে এঁদের সম্পৃক্ততার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এর বাইরে ছোট ছোট আরও অনেক ঘটনা রয়েছে। এসব ঘটনায় বিভিন্ন থানায় অন্তত ৩১টি মামলা, সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও অভিযোগ করা হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যানুযায়ী, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সব তৎপরতার মূল লক্ষ্য চাঁদাবাজি। বিদেশে থাকা সন্ত্রাসীরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় মতিঝিল, শাহজাহানপুর, পল্টন, মালিবাগ, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর, আদাবর ও মিরপুর এলাকায়। এঁদের কারও কারও রাজনৈতিক যোগাযোগও রয়েছে।
চাঁদাবাজির জন্য সন্ত্রাসীদের সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যে পরিণত হতে দেখা গেছে ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা, জমি ক্রয়-বিক্রয়, স্থাপনা নির্মাণ, ঠিকাদারি কাজ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও পোশাক কারখানাকে। এর বাইরে ফুটপাত, বাজার, বাড়ির মালিক, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং মাদক কারবারিও তাঁদের আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যানুযায়ী, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সব তৎপরতার মূল লক্ষ্য চাঁদাবাজি। বিদেশে থাকা সন্ত্রাসীরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় মতিঝিল, শাহজাহানপুর, পল্টন, মালিবাগ, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর, আদাবর ও মিরপুর এলাকায়। এঁদের কারও কারও রাজনৈতিক যোগাযোগও রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, চাঁদাবাজির জন্য শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনুসারীদের একটা অংশ প্রাথমিকভাবে চাঁদাবাজির জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র খোঁজে। এ জন্য ব্যবসা বা কাজের মালিক বা নিয়ন্ত্রক এবং তাঁর পরিবারের মুঠোফোন নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর দলনেতা কিংবা তাঁদের অনুসারীদের কেউ ইন্টারনেট নম্বর বা বিদেশি নম্বর থেকে চাঁদা চেয়ে ফোন করেন। পরবর্তী পর্যায়ে ওই ব্যক্তি ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে সংগ্রহ করা তথ্যগুলো উল্লেখ করে হত্যার হুমকি দেন। এতেও চাঁদা না মিললে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে হামলা, গুলি বা ককটেল ফাটানো হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা ভয়ে পুলিশকেও জানাতে চান না।
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর মিরপুরের রূপনগর এলাকার ইস্টার্ন হাউজিংয়ে আনিসুর রহমান (মন্টু) নামের এক ব্যবসায়ীর ছেলে মিজানুর রহমানকে লক্ষ্য করে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এর তিন মাস আগে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ পরিচয়ে বিদেশি একটি ফোন নম্বর থেকে কল করে আনিসুরের কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়।
আনিসুর রহমান ৭ মে প্রথম আলোকে জানান, ছেলেকে লক্ষ্য করে গুলির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার ফোন করে চাঁদা চায়। অন্যথায় তাঁর দুই ছেলেকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তিনি বলেন, ‘গুলির ঘটনার তদন্তে একদিন পুলিশের মিরপুর বিভাগের দুজন কর্মকর্তা আমার সামনে ছিলেন। সন্ত্রাসীরা তখন আমাকে ফোন করে। ফোন ধরে লাউড স্পিকার চালু করলে ফোনের ওপার থেকে বলা হয়, ‘‘তোর সামনে তো পুলিশ। তারা কিছুই করতে পারবে না।” বোঝা গেল, সন্ত্রাসীরা আমাকে নজরদারি করেছে। এ জন্য তাদের আলাদা লোকও রয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এভাবে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে এখনো শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে কোটি কোটি টাকার চাঁদা ওঠে। এর বড় অংশই যায় বিদেশে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পকেটে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খ. মহিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, পলাতক সন্ত্রাসীদের দেশে ফেরাতে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রচেষ্টা আছে। তিনি বলেন, ‘বিদেশ থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী পরিচয়ে কিছু ফোন কলের কথা মাঝেমধ্যে শোনা যায়। কিন্তু অধিকাংশ সময় দেখা যায়, পলাতক সন্ত্রাসীদের পরিচয়ে বিদেশি নম্বর দিয়ে অন্য কেউ ফোন করে হুমকি দিচ্ছে। এরপরও
যদি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা থাকে, অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।’
গুলির ঘটনার তদন্তে একদিন পুলিশের মিরপুর বিভাগের দুজন কর্মকর্তা আমার সামনে ছিলেন। সন্ত্রাসীরা তখন আমাকে ফোন করে। ফোন ধরে লাউড স্পিকার চালু করলে ফোনের ওপার থেকে বলা হয়, ‘‘তোর সামনে তো পুলিশ। তারা কিছুই করতে পারবে না।” বোঝা গেল, সন্ত্রাসীরা আমাকে নজরদারি করেছে। এ জন্য তাদের আলাদা লোকও রয়েছে।
মিরপুরের রূপনগর এলাকার ইস্টার্ন হাউজিংয়ে আনিসুর রহমান
মুখোমুখি মতিঝিলের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা
মতিঝিল এলাকার অপরাধজগতের আলোচিত নাম জাফর আহমেদ ওরফে মানিক ও জিসান আহমেদ। পুলিশের তথ্য বলছে, ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপের মামলার আসামি মানিক। বর্তমানে তাঁর অবস্থান কানাডায়। আর জিসান ২০০৩ সালে মালিবাগের একটি হোটেলে দুই পুলিশ হত্যা মামলার আসামি। ওই ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের মুখে ২০০৫ সালে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। এখন তাঁর অবস্থান দুবাইয়ে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। এই দুজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশি সংস্থা ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিশ’ জারি করা আছে।
চলতি বছরের শুরুতে বাড্ডা থেকে জিসানের নামে চাঁদাবাজির সময় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর আগে ২০১৪ সালে মানিকের বড় ভাই ফারুক আহমেদ, জিসানের সহযোগী আবিদ হোসেন ওরফে সৈকতসহ তাঁদের সহযোগীরা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এরও আগে ২০০৯ সালে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন জিসানের সেকেন্ড–ইন–কমান্ড হিসেবে পরিচিত কামরুল ইসলাম ওরফে বাপ্পী ওরফে মিয়া ভাই।
মানিক ও জিসান বিদেশে বসেই অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন। এ নিয়ে দুজন দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন।
অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে আলোচিত এই খুনের ঘটনায় জিসানের সম্পৃক্ততা পায় পুলিশ। এই ঘটনায় জিসানের অনুসারীদের অনেকে গ্রেপ্তার হন।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খানকে (মিল্কি) গুলশানে গুলি করে খুন করা হয়। এরপর মতিঝিল এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান, যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলামের (টিপু) হাতে। এরপর ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। তখন মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় জিসান ও টিপুর হাতে। ২০২২ সালের ২৪ মার্চ শাহজাহানপুরে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় টিপুকে।
অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে আলোচিত এই খুনের ঘটনায় জিসানের সম্পৃক্ততা পায় পুলিশ। এই ঘটনায় জিসানের অনুসারীদের অনেকে গ্রেপ্তার হন। অপর দিকে খালিদ জামিনে বের হলেও মামলা থেকে নিস্তার পেতে তিনি আপাতত চুপচাপ রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী মানিক মতিঝিল ও শাহজাহানপুর এলাকার অপরাধজগতে একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন।
টিপুকে খুন করার পর থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বিদেশ থেকে আমাকে অনবরত হুমকি দিয়েছে। পরিবার ও সন্তানদের নিয়ে এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছি।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, মতিঝিলে মানিকের উত্থানের চেষ্টায় জিসান বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আবার টিপুর মৃত্যুর পর তাঁদের দুজনের জন্যই প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ান টিপুর স্ত্রী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম (ডলি)। বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একটি অংশের ধারণা, ফারহানাকে সহযোগিতা করছেন যুবলীগ নেতা খালিদ। যার কারণে ফারহানা, খালিদ ও জিসানের ছবি দিয়ে মতিঝিল এলাকায় বেশ কিছু পোস্টার টাঙানো হয়েছে। এরপর ফারহানার বিরুদ্ধে এলাকায় একটি প্রচারপত্র ছড়ানো হয়। এই দুই ঘটনায় গত বছরের ৬ ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি শাহজাহানপুর থানায় দুটি জিডি করেন টিপুর স্ত্রী ফারহানা।
ফারহানা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিপুকে খুন করার পর থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বিদেশ থেকে আমাকে অনবরত হুমকি দিয়েছে। পরিবার ও সন্তানদের নিয়ে এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছি।’
শাহাদাত বিদেশে বসেই ঢাকার মিরপুর এলাকার অপরাধজগতের একাংশ নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁর তৎপরতার একটা বড় লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে মিরপুর এলাকার গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ।
মিরপুরের ত্রাস শাহাদাত
শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত হোসেন ওরফে সাধু ২০০২ সালে অবিভক্ত ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের মিরপুর থানার সাধারণ সম্পাদক হন। নামে ছাত্রনেতা হলেও একসময় হয়ে ওঠেন মিরপুরের ত্রাস। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, অপরাধজগৎ ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণের পথে তিনি যাকে পথের কাঁটা মনে করেছেন, তাদের অধিকাংশকেই খুন করেছেন। এর মধ্যে মিরপুরের স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মনির উদ্দিন হত্যাকাণ্ড অন্যতম। এ ঘটনায় ২০১৫ সালে শাহাদাতের ফাঁসির রায় হয়। এর আগে ২০০২ সালের ১০ মে কমিশনার সাইদুর রহমান (নিউটন) খুনের পর দেশ ছেড়ে ভারতে পালান এই সন্ত্রাসী।
জানা গেছে, শাহাদাত বিদেশে বসেই ঢাকার মিরপুর এলাকার অপরাধজগতের একাংশ নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁর তৎপরতার একটা বড় লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে মিরপুর এলাকার গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ।
মিরপুর অঞ্চলের স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, অপরাধজগতের আধিপত্য নিয়ে বর্তমানে শাহাদাতের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে আছেন কারাগারে থাকা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মো. আব্বাস আলী; যিনি পুলিশের তালিকায় ‘কিলার আব্বাস’ নামে পরিচিত। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি কাজের ভাগাভাগি নিয়ে শাহাদাত ও আব্বাসের অনুসারীরা বিবাদে জড়িয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো জানায়, রাজধানীর শ্যামলী, কল্যাণপুর, গাবতলী, দারুস সালাম, মিরপুর, পল্লবীসহ আশপাশের এলাকায় এখনো বিকাশের নামে চাঁদাবাজি হয়। স্থানীয় দুই জনপ্রতিনিধির সঙ্গে তাঁর সখ্য রয়েছে। এই এলাকার ক্ষমতাসীন দলের অনেক কমিটি গঠনের আগে বিকাশ ফোন করে তাঁর পছন্দের কথা জানান।
আতঙ্কের নাম বিকাশ
তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে দুজন হলেন প্রকাশ কুমার বিশ্বাস ও তাঁর ভাই বিকাশ কুমার বিশ্বাস।
ছাত্রলীগ নেতা জরিপ হত্যা, আগারগাঁওয়ে জোড়া খুনসহ বেশ কয়েকটি হত্যা ও চাঁদাবাজির মামলার আসামি ছিলেন বিকাশ। বিকাশ ১৯৯৭ সালে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। তবে কারাগারে থেকেও মিরপুরসহ রাজধানীর বড় অংশের অপরাধজগতে ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণ। দীর্ঘ ১২ বছর কারাভোগের পর ২০০৯ সালে জামিনে মুক্ত হন তিনি। এরপর বিদেশে পালিয়ে যান বিকাশ। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, দুই ভাই বিকাশ ও প্রকাশের অবস্থান এখন ফ্রান্সে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো জানায়, রাজধানীর শ্যামলী, কল্যাণপুর, গাবতলী, দারুস সালাম, মিরপুর, পল্লবীসহ আশপাশের এলাকায় এখনো বিকাশের নামে চাঁদাবাজি হয়। স্থানীয় দুই জনপ্রতিনিধির সঙ্গে তাঁর সখ্য রয়েছে। এই এলাকার ক্ষমতাসীন দলের অনেক কমিটি গঠনের আগে বিকাশ ফোন করে তাঁর পছন্দের কথা জানান।
নবী হোসেন দেশে নেই, অপরাধ আছে
ইন্টারপোলের রেড নোটিশভুক্ত আরেক আসামি নবী হোসেনও (৫৪) বিদেশে। হত্যাসহ ২০টির বেশি মামলার এই আসামি ২০০৭ সালে দেশ ছেড়ে পালান। তাঁকে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে দেখা গেছে বলে একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, নবীর অনুসারীরা মোহাম্মদপুর, বছিলা, আদাবর এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতিতে জড়িত বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
শ্যামলী ও মোহাম্মদপুরে কুপিয়ে টাকা ছিনতাই ও চাঁদাবাজি করার সময় র্যাব ও পুলিশের হাতে আটক অন্তত ছয়জন জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তাঁরা নবী হোসেনের নির্দেশে এসব অপরাধ করেন।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, নবীর চাঁদাবাজির মূল জায়গা হলো নির্মাণকাজ। এই খাত থেকেই প্রতি মাসে তাঁর দেড় কোটি টাকার মতো চাঁদা ওঠে। তা ছাড়া শিয়া মসজিদ থেকে শ্যামলী এলাকায় চলাচলকারী লেগুনা থেকে আদায় করা চাঁদার ভাগও তাঁর কাছে যায়।এই এলাকার আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী বাদল ওরফে কিলার বাদলের সঙ্গেও নবী হোসেনের সখ্য রয়েছে বলে জানা গেছে।
পিছিয়ে নেই কাফরুলের ইব্রাহিম
বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা না থাকলেও ব্যক্তিগত দাপটের জোরে কাফরুল থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহিম খলিল। ২০১৬ সালে জামিন পাওয়ার পর তিনি ভারতে পালিয়ে যান। বর্তমানে তাঁর অবস্থান ইতালিতে বলে গোয়েন্দা সূত্রগুলোর কাছে তথ্য রয়েছে। স্থানীয় লোকজন জানান, কাফরুল এলাকায় তাঁর ব্যাপক দাপট রয়েছে। এলাকার সরকারদলীয় বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ রয়েছে।
বিদেশে আরও ১০ শীর্ষ সন্ত্রাসী
অপরাধ করে দেশ ছেড়ে পালানো আরও ১০ শীর্ষ সন্ত্রাসী এখন বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে রাজধানীতে তাঁদের কিছু তৎপরতা দেখা গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, মশিউর রহমান (কচি), ত্রিমতি সুব্রত বাইন, ইমাম হোসেন ওরফে ফ্রিডম ইমাম ও মোল্লা মাসুদ ভারতে; আমিনুর রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগর যুক্তরাষ্ট্রে, আবদুল জব্বার (মুন্না) ও কামরুল হাসান ওরফে ছোট হান্নান জার্মানিতে আছেন। আরমান, শামীম আহমেদ ওরফে আগা শামীম ও কামরুল হাসান ওরফে ছোট হান্নান কোন দেশে আছেন, সে তথ্য পাওয়া যায়নি।
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের যাঁরা বিদেশে পলাতক, তাঁদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। একই সঙ্গে তাঁদের হয়ে দেশে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এর পরও নানা উপায়ে কেউ কেউ ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। তাঁদের হয়তো পাওয়া যাচ্ছে না। তবে তাঁদের হয়ে দেশে কাজ করছেন, অর্থাৎ যাঁরা ধরাছোঁয়ার মধ্যে আছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার নাইম আহমেদ
অ্যাপার্টমেন্টে জয়ের লাশ উদ্ধার
গত ১২ এপ্রিল তালাবদ্ধ অ্যাপার্টমেন্টের একটি কক্ষ থেকে মালয়েশিয়ায় পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী খোন্দকার তানভীর ইসলাম ওরফে জয়ের লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশ উদ্ধারের কয়েক দিন আগেই জয়ের মৃত্যু হলেও পরিবার-পরিচিতজনদের কেউ সেই খবর পাননি। এর আগে জামিন নিয়ে ভারতে পালিয়েছিলেন তিনি। ২০০৫ সালে ইন্টারপোল জয়ের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে। গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, এর পর থেকে ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে তিনি কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড এবং সর্বশেষ মালয়েশিয়াতেই ছিলেন।
মালয়েশিয়ায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল এমন একজন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরেই তাঁর মধ্যে একধরনের হতাশা কাজ করত। এই সময়ে বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হয়ে নিঃসঙ্গ ও বেপরোয়া জীবন যাপন করেন তিনি। একপর্যায়ে তাঁর শরীরে অনেক জটিল রোগ বাসা বাঁধে। মাঝেমধ্যেই তিনি বলতেন, “এটা কোনো জীবন না”।’
বিদেশে বসে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ঢাকায় অপরাধ সংগঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার নাইম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের যাঁরা বিদেশে পলাতক, তাঁদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। একই সঙ্গে তাঁদের হয়ে দেশে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এর পরও নানা উপায়ে কেউ কেউ ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। তাঁদের হয়তো পাওয়া যাচ্ছে না। তবে তাঁদের হয়ে দেশে কাজ করছেন, অর্থাৎ যাঁরা ধরাছোঁয়ার মধ্যে আছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, বিদেশে থেকে দেশে এ ধরনের অপরাধ সংঘটন একটি চেইনের মতো। এই চেইনের যেকোনো পর্যায়ের কার্যক্রম রুখে দিতে পারলে অপরাধ বন্ধ করা যায়।