সর্বোচ্চ চাহিদার সময় মূলত তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হয়। কিন্তু ২৭ মাস ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই সরকারি নির্দেশনা মানছে না বেসরকারি খাতের ফার্নেস তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। ফলে লোডশেডিং করতে হয়েছে সারা দেশে। এ জন্য কোনো জরিমানাও দিতে হচ্ছে না বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে। উল্টো বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে ভাড়া নিচ্ছে।
চুক্তি অনুসারে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বছরে ১০ শতাংশ সময় নিজেরা বন্ধ রাখতে (আউটেজ) পারে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। তার মানে ১০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বছরে ৮৩৬ ঘণ্টা (৩৬.৫ দিন) বন্ধ রাখতে পারে। এর বাইরে বন্ধ রাখার সময় কেন্দ্রভাড়া পাবে না; বরং জরিমানা দিতে হবে তাদের। কিন্তু আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হলেও এর হিসাব করছে না পিডিবি।
হিসাব করা হলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বছরে কেন্দ্রভাড়ায় ৪০ শতাংশ খরচ কমত বলে মনে করছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া বিল জমতে থাকায় তারা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে অস্বীকৃতি জানাতে থাকে। তাদের দাবির মুখে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখার সময় হিসাব না করেই ২০২২ সালের জুলাই থেকে বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছে পিডিবি। বিদ্যুৎ বিভাগের অনুমোদন ছাড়াই পিডিবির বোর্ডে এ সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে নেন তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান। পরে সরকার বন্ড ছেড়ে বকেয়ার বেশির ভাগ শোধ করেছে। বর্তমানে বকেয়া অনেক কমে এসেছে। অথচ ওই নিয়মে এখনো সুবিধা পাচ্ছে বেসরকারি তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।
বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এভাবে উৎপাদন বন্ধ রাখতে পারে না, এটি চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাদের চুক্তি বাতিল করে জরিমানা আদায় করতে হবে।
এম শামসুল আলম, জ্বালানি উপদেষ্টা, ক্যাব
পিডিবির দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগের অনুমোদন ছাড়া পিডিবি এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, এটা অবৈধ। সাবেক চেয়ারম্যানের সঙ্গে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের বোঝাপড়া ছিল। এ কারণে তিনি তাঁদের সুবিধা দিয়েছেন।
এ অভিযোগের বিষয়ে মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বকেয়া বিল পরিশোধে পিডিবি হিমশিম খাচ্ছিল। তাই আউটেজের টাকা আদায় স্থগিত করা হয়েছিল, বাতিল করা হয়নি। না হলে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে পারত না। তাঁর দাবি, বিদ্যুৎ বিভাগের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগকে তা অবহিত করা হয়েছিল। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের লিখিত অনুমোদন ছাড়া পিডিবি চুক্তির শর্ত স্থগিত করতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি তিনি।
পিডিবি সূত্র বলছে, উৎপাদনের নির্দেশনা দিলেও কেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন করত না। ফলে ২০২২ সালের জুলাই থেকে দেশে ব্যাপক লোডশেডিং শুরু হয়। পিডিবির নতুন চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ধীরে ধীরে সবকিছু সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। বকেয়া বিল পরিশোধ করা হচ্ছে। বিল পরিশোধ করে আউটেজ আবার চালু করা হবে।
বর্তমানে বকেয়া অনেক কমে এসেছে। অথচ ওই নিয়মে এখনো সুবিধা পাচ্ছে বেসরকারি তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।
দেশে বর্তমানে কেন্দ্রভাড়াসহ ফার্নেস তেলচালিত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু আছে ৪০টি। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াটের কিছুটা বেশি। পিডিবি সূত্র বলছে, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বছরে কেন্দ্রভাড়া ৫৯ কোটি ডলার বা ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখার সময় হিসাব করা হলে বছরে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় করা যেত।
তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের একজন উদ্যোক্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, ৪৫ দিনের মধ্যে বিল দেওয়ার কথা থাকলেও ১৪০ থেকে ১৫০ দিন দেরি করেছে। তাই বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো যায়নি। এই দায় পিডিবির। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর আউটেজের হিসাব করার কোনো সুযোগ নেই। তবে বিল নিয়মিত হলে তাঁরা নভেম্বর থেকে চাহিদা মতো বিদ্যুৎ দেবেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চুক্তি অনুসারে সব বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্রভাড়া আছে, যা সরকারের তহবিল থেকে দিতে হয়। আবার পিডিবির চাহিদামতো বিদ্যুৎ দিতে না পারলে বিদ্যুৎকেন্দ্রকে জরিমানার বিধান আছে চুক্তিতে।
এ জন্য কোনো জরিমানাও দিতে হচ্ছে না বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে। উল্টো বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে ভাড়া নিচ্ছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবির ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়ার পেছনে। পরের অর্থবছরে এটি ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, নিজেরা ইচ্ছা করে বন্ধ রেখে কেন্দ্রভাড়া নিয়েছে, আবার মানুষকে লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি দিয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এভাবে উৎপাদন বন্ধ রাখতে পারে না, এটি চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাই তাদের চুক্তি বাতিল করে জরিমানা আদায় করতে হবে। আর বাড়তি যে ভাড়া পরিশোধ করা হয়েছে, তা হিসাব করে বকেয়া বিলের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।